ETV Bharat / state

ওরা ভাঙন উদ্বাস্তু, নদীপাড়ে প্লাস্টিকের ছাউনিতে বই ছেড়ে বিড়ি বাঁধছে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী

author img

By

Published : Oct 2, 2020, 6:15 PM IST

Updated : Oct 2, 2020, 8:42 PM IST

নদীর জলের চাপে যখন বাড়ি ভাঙে, তখন ঘর থেকে বইখাতাগুলিও বের করার সময় পায়নি রেজিনা, তারিকুলরা । তাই এখন নদীর পাড়ে প্লাস্টিকের নিচে বই ছেড়ে বিড়ি বাঁধছে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী জাহেদা ।

ganga destroys houses in Maldah
ganga destroys houses in Maldah

মালদা, 2 অক্টোবর : ভিটেমাটির সঙ্গে নদীগর্ভেই তলিয়ে গিয়েছে বৈষ্ণবনগরের একাধিক পড়ুয়ার স্বপ্ন । নদীর জলের চাপে যখন বাড়ি ভাঙে, তখন ঘর থেকে বইখাতাগুলিও বের করার সময় পায়নি রেজিনা, তারিকুলরা । তাই এখন নদীর পাড়ে প্লাস্টিকের নিচে বই ছেড়ে বিড়ি বাঁধছে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী জাহেদা । ভাঙা ঘরের অবশেষ থেকে স্বপ্ন খুঁজে বেড়াচ্ছে সহিদুর ।

চলতি মরশুমে গঙ্গা বারবার ছোবল মেরেছে বৈষ্ণবনগর থানার চিনাবাজার, দুর্গারামটোলা, বালুগ্রাম, পার অনুপনগরের মতো গ্রামগুলিতে । আগ্রাসি নদীর কোপে প্রথম পড়েছিল চিনাবাজার । গত 30 অগাস্ট ঘণ্টা দুয়েক গঙ্গার তাণ্ডবলীলা দেখেছিল সেখানকার মানুষ । ঘোলা জলে জায়গা নিয়েছিল প্রায় 75টি বাড়ি । দু'দিন পর একই ঘটনা ঘটে দুর্গারামটোলায় । নদীর পাকে চোখের সামনে তলিয়ে গিয়েছিল বহু বাড়ি । তবে গঙ্গার সবচেয়ে বড় ভাঙন হয় 21 সেপ্টেম্বর । কয়েক ঘণ্টার ভাঙনে তাসের ঘরের মতো ধসে পড়তে শুরু করে একের পর এক পাকা দালান । মুহূর্তের মধ্যে গৃহহীন হয়ে পড়ে একশোরও বেশি পরিবার । তাদের মধ্যে কিছু মানুষ আশ্রয় নিয়েছে এলাকার স্কুলে । তবে বেশিরভাগেরই ঠিকানা, কাছের কোনও আমবাগান কিংবা নদীপাড় । সেখানে এখন সার দেওয়া প্লাস্টিকের ছাউনি ।

চিনাবাজারের গঙ্গাপাড়ে তেমনই এক ছাউনির নিচে বসে একমনে বিড়ি বাঁধছিল জাহেদা খাতুন । বীরনগর হাইস্কুলে ক্লাস টেনে পড়ে সে । এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে । যেদিন গঙ্গা ওদের বাড়িটা নিজের খাতায় লিখে নিয়েছিল, সেদিন ঘর থেকে বইখাতাও বের করতে পারেনি জাহেদা । তার কথায়, "এবার আমি মাধ্যমিক দেব । গঙ্গায় ঘরবাড়ির সঙ্গে বইখাতাও চলে গিয়েছে । রোদ-বৃষ্টিতে এখন প্লাস্টিকের নিচে । দু'বেলা পেট ভরে খাবার জোটে না । একবেলা খাই, আরেকবেলা না খেয়েই কাটাই । পড়াশোনা এখন বন্ধ । কীভাবে জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা দেব জানি না । অনেক স্বপ্ন ছিল । আর কোনও উপায় নেই । গঙ্গায় সব চলে গিয়েছে । আমার বড় হওয়ার স্বপ্ন নদী গিলে নিয়েছে । হতাশা নিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কোনও কাজ নেই আমার । বই ছেড়ে এখন বিড়ি বাঁধতে বাধ্য হয়েছি । নইলে খাব কী ? বিড়ি বেঁধে দুটো পয়সা তো হাতে আসবে !"

জাহেদার আব্বা ইলিয়াস শেখ বলেন, "এবার ভাঙনে আমার বাড়ি চলে গিয়েছে নদীতে । দিনমজুরি করে খাই । লকডাউনের শুরু থেকে কাজ নেই । কোরোনা সব গোলমাল করে দিয়েছে । কোথাও কাজ নেই । টাকাপয়সা নেই । নতুন ঘর দেওয়ার ক্ষমতা নেই । সরকার একটা ত্রিপল দিয়েছে । সেটাই এখন আমাদের ঠাঁই । প্রশাসন কোনওদিন খাবার দিচ্ছে, কোনওদিন না খেয়েই থাকতে হচ্ছে । আমার তিন মেয়ে, তিন ছেলে । সবাই পড়াশোনা করে । এখন তাদের পড়া বন্ধ । স্কুল খুললেও তাদের আর পড়াতে পারব না ।"

গঙ্গা ভাঙনে সহিদুরদের পাকা বাড়ির অর্ধেক নদীতে পড়ে গিয়েছে । বাকি অংশে নিজের স্বপ্ন যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে সে । সহিদুর রহমান কালিয়াচক জামিয়া ইব্রাহামিয়া মাদ্রাসার ফাজিল (উচ্চ মাধ্যমিক) বিভাগের ছাত্র । সে বলে, "একে কোরোনার জেরে লকডাউন, তার উপর গঙ্গার ভাঙনে বাড়ি ধসে যাওয়া । কী করব, কোথায় যাব, সেটাই বুঝতে পারছি না । মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই । পেটে খাবার নেই । পড়াশোনার কথা আর স্বপ্নেও আসছে না । গঙ্গার জন্য এখানকার ছেলেমেয়েরা বড় হওয়ার স্বপ্নটাই দেখতে পারে না । নিজের স্বপ্ন, বাবা-মায়ের স্বপ্ন, সবই গঙ্গা ভেঙে খানখান করে দিয়েছে । আর পড়াশোনা হবে কি না জানি না । সেই সম্ভাবনাই বেশি ।" কথা বলতে বলতে চোখে জল সহিদুরের আব্বা রবিউল শেখের । পেশায় কৃষক । তিনি বলেন, "আমার চার ছেলেমেয়ে । গরিব হলেও তাদের সবাইকে পড়াশোনা করাচ্ছিলাম । কিন্তু গঙ্গার ভাঙনে সব চলে গিয়েছে । এখন আমি ফকির । রাতে ঘুম হয় না । সন্তানদের লেখাপড়া আর কীভাবে চলবে ? কোনও সাহায্য পেলে ওরা পড়তে পারবে । নইলে নয় । গঙ্গাই ওদের ভবিষ্যৎ শেষ করে দিল ।"

ভিটেমাটির সঙ্গে নদীগর্ভেই তলিয়ে গিয়েছে বৈষ্ণবনগরের একাধিক পড়ুয়ার স্বপ্ন

নদীপাড়েই দাঁড়িয়েছিল বীরনগর হাইস্কুলের ক্লাস টেনের ছাত্রী সেমি খাতুন । সঙ্গে সাউথ মালদা কলেজের প্রথম বর্ষের ওয়াহিদা খাতুন । ওয়াহিদা বলে, "স্বপ্নকে এখন মাটির নিচে পুঁতে দিতে হয়েছে । এলাকার প্রায় সবার বাড়িই নদীতে তলিয়ে গিয়েছে । অনেকে এখনও আশ্রয় পায়নি । পড়াশোনা হবে কোথা থেকে ? মাথার ওপর ছাদ আর পেটে খাবার না থাকলে কি পড়াশোনা হয় ?" সেমি বলে, "আমরা কিছু চাই না । শুধু থাকার একটা জায়গা, আর পড়াশোনাটা করতে চাই ।" দু"জনেরই বক্তব্য, খাবার জুটুক আর না জুটুক, কিন্তু এলাকায় শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সরকার কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করুক । তারা শুধু সেটাই চায় । শুধু তারাই নয়, এটা এখন ভাঙন ভিটের সব ছেলেমেয়েরই দাবি ।

Last Updated : Oct 2, 2020, 8:42 PM IST
ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.