ঘুরে দাঁড়ানোই জীবনের মন্ত্র, অ্যাসিড আক্রান্ত পিয়ালি যেন "ফিনিক্স"

author img

By

Published : Mar 7, 2020, 7:38 PM IST

Updated : Mar 7, 2020, 8:23 PM IST

acid-victim Piyali

2005 সালের এক আকস্মিক দুর্ঘটনায় পুড়ে গিয়েছিল শ্যামনগরের পিয়ালি দত্তের জীবন৷ সেই পিয়ালিই আজ তাঁর মতো অন্য অ্যাসিড আক্রান্তদের অনুপ্রেরণা৷

কলকাতা, 7 মার্চ : আচমকা রাত নেমেছিল জীবনে। যে কালো রাত ফুরোবে না, আর কোনও দিন ভোর হবে না বলে ভেবেছিলেন পিয়ালি। আর পাঁচজন অ্যাসিড আক্রান্তের যেমন হয় আর কী! অন্যদিকে যুদ্ধ চলছিল মনের ভিতরে। বিপুল অন্ধকারে আত্মার তলানি আলোটুকু জ্বেলে পথ খুঁজছিলেন তিনি। এদিকে সমাজের নিরন্তর উপহাস বিঁধত কাঁটার মতো। শেষ পর্যন্ত পিয়ালির হার না মানা মনোভাবই জিতল৷ নিজেকে যেমন তিনি নতুন করে খুঁজে পেলেন, সেইসঙ্গে তাঁর মতো হতভাগ্য অ্যাসিড আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ানোর ব্রত নিলেন ৷ "আমি নারী, আমিও পারি"-র জলজ্যান্ত উদাহরণ শ্যামনগরের পিয়ালি দত্ত ৷ যিনি আজ অ্যাসিড আক্রান্তদের নিয়ে কাজ করা এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সক্রিয় কর্মী।

সংস্থার নাম- অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়া ৷ পিয়ালি এখানে নিজের দুঃখ ভুলে অন্যের দুঃখ মোছার কাজে ব্যস্ত৷ পিয়ালি যাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তাঁদের কেউ স্বামীর ছোড়া অ্যাসিডে পুড়েছেন, প্রেম প্রস্তাবে “না" বলায় কারও ভাগ্যে জুটেছে অ্যাসিড হামলা। কেউ হয়ত কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়ে শ্বশুর-বাড়ির নির্দয় আক্রমণের শিকার। এঁদের সাহস ফিরিয়ে দেওয়াই অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়ার কাজ। যে কঠিন কাজের অন্যতম যোদ্ধা আজ শ্যামনগরের পিয়ালি। কিন্তু তাঁর জীবনে অ্যাসিড-অন্ধকার নামল কীভাবে?

সেটা 2005 সাল। মূল ঘটনার সঙ্গে কোনও যোগই ছিল না পিয়ালির৷ অন্যের “দোষে" সাজা পেতে হয়েছিল তাঁকে। পিয়ালিদের বাড়ির ভাড়াটে "কাকু" অ্যাসিড ছুড়েছিল তার স্ত্রীর দিকে। সেই অ্যাসিডের বেশ কিছুটা এসে পড়ে পিয়ালির মুখে। মুহুর্তে জ্বলেপুড়ে গিয়েছিল বালিকা বয়স! লোডশেডিঙের মতো অন্ধকার নেমেছিল জীবনে। হাসপাতাল থেকে ফিরে আয়নায় পোড়া মুখটাকে দেখে চিনতেই পারছিলেন! তবুও কিছুদিন পর সাহস করে ওই ঝলসানো চেহারা নিয়েই স্কুলে যেতে শুরু করেন পিয়ালি। প্রথমদিকে উপহাস জুটত। পরবর্তীকালে পিয়ালির অদম্য সাহসের জন্যই হয়ত পাশে দাঁড়ান স্কুলের সহপাঠী ও শিক্ষিকারা৷ ফলে, স্কুলবেলা বোঝা হয়ে ওঠেনি পিয়ালির কাছে। কিন্তু, সমাজ ছাড়বে কেন 'দুর্বলতা'কে!

কী বলছেন অ্যাসিড আক্রান্তদের অনুপ্রেরণা পিয়ালি

যুবতি পিয়ালি নির্মম বাস্তবের মুখোমুখি হন কলেজে পড়তে গিয়ে। নৈহাটির ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র কলেজে পড়তে গিয়ে দুমড়েমুচড়ে গিয়েছিল ভিতরটা। অ্যাসিড আক্রান্ত হওয়ার পরেও যে মেয়েটা ফিরে পেয়েছিলেন প্রাণোচ্ছ্বল স্কুলজীবন, সেই তিনিই কলেজে এসে মরমে মরে যেতে শুরু করেন। কলেজে তীব্র উপহাস শুরু হয় তাঁকে নিয়ে। পিয়ালিকে নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা! যেমন, প্রেম, কুপ্রস্তাব- এমন কিছুই কি পুড়িয়েছে পিয়ালির মুখ ও শরীর! এইসব শুনতে শুনতে মনের দিক থেকে যেন খাদের কিনারে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন পিয়ালি। তবুও, নিজের সঙ্গে শেষ লড়াইটা লড়ছিলেন ৷ এমন সময় তাঁর পাশে এসে দাঁড়ান অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়ার অন্যতম দিব্যলোক রায়চৌধুরি। তিনিই পিয়ালিকে মুক্তির পথ দেখান ৷ এবং যুদ্ধে জিতে যান শ্যামনগরের পিয়ালি ৷

অ্যাসিড আক্রান্তদের নিয়ে কাজ করা দিব্যলোকবাবু বলেন, “অ্যাসিড আক্রমণের মতো অপরাধ আর হয় না। মনে রাখতে হবে অ্যাসিড শুধুমাত্র শরীর পোড়ায় না, জ্বালা ধরায় মনেও। অনেকেই সেই চ্যালেঞ্জ নিতে পারেন না। অনেক সময়ই বেছে নেন আত্মহত্যার পথ।" দিব্যলোকবাবু আক্ষেপের সুরে বলেন, "অনেক প্রচার হয়েছে। গড়ে উঠেছে আন্দোলন। কিন্তু, তার পরেও অ্যাসিড হামলা থামেনি। দেশের মধ্যে সবথেকে বেশি অ্যাসিড হামলার শিকার হন পশ্চিমবঙ্গের মেয়েরাই। বিনা দোষে একটি মেয়ে অ্যাসিড হামলার শিকার হবে, আর যে হামলা করবে, সে কিছুদিন পরেই মুক্তি পেয়ে ঘুরে বেড়াবে, চাপ দেবে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য৷ এই জিনিস চলতে পারে না। এসবের বিরুদ্ধেই আমাদের আন্দোলন।"

অ্যাসিড আক্রান্ত হওয়ার পরেও জীবন যুদ্ধে জয়ী পিয়ালি বলেন, “আজও নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। বাঁকা চোখে দেখে সমাজ। এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। জীবনযুদ্ধে পিছিয়েপড়া সব নারীকে বলব, শেষ হয় না কিছু। ঘুরে দাঁড়াতে হয়। লড়াই করতে হয়। রাতের পরই আসে সকাল।"

Last Updated :Mar 7, 2020, 8:23 PM IST
ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.