ETV Bharat / state

Independence Day 2023: গান্ধিজির চিঠিতে ফাঁসি রদ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর চার অনুগামীর

author img

By

Published : Aug 15, 2023, 2:17 PM IST

Updated : Aug 15, 2023, 5:33 PM IST

ETV Bharat
জ্যোতিষচন্দ্র বসুর বাড়ি

জ্যোতিষচন্দ্র বসু, হরিদাস মিত্র, পবিত্রমোহন রায় এবং অমরসিং গিল । ফাঁসির মঞ্চ থেকে সুভাষপন্থী চার বিপ্লবী ফিরেছিলেন গান্ধিজির চিঠিতে ৷ সুভাষ-মহাত্মার সম্পর্কের নানা ব্যাখ্যার মাঝে যে ঘটনা স্বাধীনতা ইতিহাসের অন্যতম দলিল ৷ তা নিয়েই সঞ্জয় অধিকারীর বিশেষ প্রতিবেদন ৷

চার সুভাষপন্থীর ফাঁসির হুকুম রদ হয়েছিল মহাত্মা গান্ধির পাঠানো চিঠিতে

কলকাতা, 15 অগস্ট: সময়টা গত শতাব্দীর চারের দশক । আজকের কলকাতার সঙ্গে তার আমূল পার্থক্য । চারদিক ফাঁকা, দক্ষিণ কলকাতা তো আরও জনবসতিহীন । সেখানেই একরাতে ব্রিটিশ পুলিশের গাড়ি এসে থামল একটি দোতলা বাড়ির সামনে । পাড়ায় সেসময় ব্রিটিশ পুলিশের গাড়ি মানেই ভীত-সন্ত্রস্ত গোটা এলাকা । পুলিশ অফিসার নেমেই দরজায় কড়া নাড়লেন । শঙ্কিত গৃহস্বামী দরজা খুলতেই পুলিশ অফিসার সার্চ ওয়ারেন্ট দেখিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন । প্রমাদ গুনলেন গৃহস্বামী ।

কাট টু প্রেজেন্ট:

শ্রাবণ মাসের মেঘলা আকাশ । রাস্তার মোড়ে মোড়ে পালন হচ্ছে 77তম স্বাধীনতা দিবস ৷ দেশপ্রিয় পার্কের উলটোদিকের রাস্তা ধরে 50 মিটার হাঁটলে ডানদিকে বিপিন পাল রোড। সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে 6-এ বাড়িটি । অবস্থান ঐতিহাসিক রমেশ মজুমদারের বাড়ির ঠিক পিছনে । গঠনশৈলীতে পুরনো ছাঁচ স্পষ্ট । বাড়িটি আজও বহন করে চলেছে রোমহর্ষক ঐতিহাসিক ঘটনার দলিল ।

ফ্ল্যাশব্যাক:

গৃহস্বামীকে নিয়েই বাড়ির অন্দরে ঢুকলেন পুলিশ অফিসার । পুলিশের ভারী বুট নৈশব্দ ভাঙছে আর আতঙ্কে চমকে উঠছেন গৃহস্বামী । অবশেষে পুলিশ পৌঁছল দোতলার সেই ঘরে । যেখানে লুকিয়ে রয়েছেন জ্যোতিষচন্দ্র বসু, হরিদাস মিত্র, পবিত্রমোহন রায় এবং অমরসিং গিল । চারজনেই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সিক্রেট সার্ভিসের সদস্য । হাতেনাতে ধরা পড়লেন চার বিপ্লবী । বাজেয়াপ্ত হল ওদের রেডিও সেটটি ।

অন্যদিকে নেতাজি তখন আজাদ হিন্দ বাহিনী নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছেন । ভারতে ব্রিটিশদের গতিপ্রকৃতি এবং পরিকল্পনা জানতে খুলেছিলেন আইএনএ সিক্রেট সার্ভিস । বাংলায় যার এজেন্ট ছিলেন এই চার যুবক। প্রত্যেকেরই বয়স পঁচিশের নীচে। তাদের মধ্যে সদ্য ওকালতি পাশ করা হরিদাস মিত্র আবার বিবাহিত । বিয়ে করেছেন এলগিন রোডের বিখ্যাত বসু পরিবারের মেয়ে বেলারানি বসুকে। তিনি সুভাষচন্দ্র বসুর ভাইঝি । ফলে ব্রিটিশ পুলিশের কেস সাজাতে কোনও অসুবিধা হল না । কলকাতায় বিচার হয়েছিল । বিচারক বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ধৃত চার যুবককেই মৃত্যুদণ্ড দিলেন ।

আরও পড়ুন: স্বাধীনতা আন্দোলনে কতজন বাঙালি জেল খেটেছিলেন, কতজনের হয়েছিল ফাঁসি, জানেন কি ?

হরিদাস মিত্রের মাত্র একবছর বিয়ে হয়েছে । তারমধ্যেই স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজিকে সাহায্য করার কারণে ফাঁসির সাজা ঘোষণা হয়েছে । স্বামীকে মৃত্যুর হাত বাঁচাতে মরিয়া চেষ্টা শুরু করলেন বেলারানি । মহাত্মা গান্ধির সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল । এলগিন রোডের বাড়িতে গান্ধিজি, জহরলাল নেহেরু আলোচনার জন্য আসলে অতিথি আপ্যায়নের দায়িত্ব বর্তাত বেলারানির উপরে । কিন্তু গান্ধিজিকে চিনলে তো হবে না । কোথায় তাঁকে পাওয়া যাবে ? অবশেষে জানা গেল গান্ধিজি রয়েছেন পুণেতে । মরিয়া বেলারানি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে ছুটলেন ।

অন্যদিকে, অধুনা বাংলাদেশের যশোর থেকে জ্যোতিষচন্দ্র বসুর বাবা কলকাতায় এসেছিলেন ছেলের প্রাণভিক্ষার আর্জি নিয়ে । বেলারানির সঙ্গী হলেন একপ্রকার জোর করেই । যদিও পুণে পৌঁছেও সহজে দেখা পাওয়া গেল না গান্ধিজির । তিনদিন অপেক্ষার পর অবশেষে মিলল সুযোগ । বেলারানিকে চিনতে পারলেন গান্ধিজিও । কিন্তু জ্যোতিষচন্দ্র বসুর বাবা অচেনা । তিনি কী বলতে চাইছেন তা বুঝতে পারছিলেন না স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম প্রাণপুরুষ । কারণ, একে বাংলা তার ওপর পদ্মাপাড়ের টান । এই অবস্থায় পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করলেন বেলারানি । স্বামী হরিদাস মিত্র এবং বাকি তিন সহযোগীর প্রাণ বাঁচাতে গান্ধিজিকে উদ্যোগী হতে অনুরোধ করলেন ।

যদিও প্রথমটায় তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন গান্ধিজি ৷ বলেছিলেন, ‘তিনি সরকারের সঙ্গে যুক্ত নন, তাহলে সরকার তাঁর কথা কেন শুনবে ?’ কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেলারানির নাছোড়বান্দা মনোভাবে রাজি হলেন । হরিদাস মিত্র এবং বাকি তিন বিপ্লবীর মৃত্যুদণ্ড রোধ করার আর্জি জানিয়ে চিঠি পাঠালেন বড়লাটকে । যদিও সেই চিঠি লিখলেও উত্তর আসে না । এদিকে ফাঁসির দিন ক্রমশ এগিয়ে আসছে । শেষ পর্যন্ত ফাঁসির তিনদিন আগে এল বড়লাটের চিঠি । প্রথমে স্থগিত এবং পরে বাতিল হল মৃত্যুদণ্ড ।

আরও পড়ুন: পার্লামেন্ট হাউসে ভগৎ সিং-বটুকেশ্বর দত্তদের বোমা বর্ষণ ও খণ্ডঘোষের সেই পাতাল ঘর

ফের ফেরা যাক বর্তমানে:

কালীঘাট মন্দিরের পেছনে কালী লেনের দু’নম্বর বাড়িতে থাকেন জ্যোতিষচন্দ্র বসুর মেয়ে মিঠু মিত্র । নিজের বাবার বিষয়ে মুখ খুলতে কুণ্ঠাবোধ করেন । তার কারণ আত্মপ্রচারের লোভের অনীহা । অনেক অনুরোধে মুখ খুললেন ৷ মিঠু মিত্র বললেন, “আমার বাবা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী । আজাদ হিন্দ ফৌজের সিক্রেট সার্ভিসে কাজ করার অপরাধে ফাঁসির সাজা শোনানো হয়েছিল । কথা বের করার জন্য বরফের ওপর শুইয়ে রাখত ব্রিটিশ পুলিশ ৷ কিন্তু আমার শ্বশুর এবং বেলারানি মিত্রের মরিয়া চেষ্টা ও মহাত্মা গান্ধির চিঠিতে ফাঁসি রোধ করেছিলেন তদানীন্তন বড়লাট এবং ব্রিটিশ সরকার ।”

গান্ধিজির চিঠি এবং ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফিরে আসার অভিজ্ঞতা:

মিঠু মিত্রের স্বামী পল্লব মিত্র স্বাধীনতার ইতিহাসের গবেষক এবং সংবাদপত্রের প্রাক্তন কর্মী । শ্বশুরের একাধিক কর্মকাণ্ড তিনি সংকলন করেছেন । সরকারি মহাফেজ খানা থেকে জোগাড় করেছেন গান্ধিজির সাতটি চিঠি । 1931 সালে ভগৎ সিংয়ের ফাঁসি রদ করার জন্য দেশবাসী গান্ধিজিকে অনুরোধ করলেও তিনি রাজি হননি । অথচ 11 বছর পরে নেতাজির ভাইঝির অনুরোধে উদ্যোগী হলেন । গান্ধি এবং সুভাষের সম্পর্কের নানা ব্যাখ্যা রয়েছে । কোন কারণে গান্ধিজি এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন তা অজানা । তবে শোনা যায়, হরিদাস মিত্রের সুভাষ-যোগ রয়েছে বলেই ফাঁসি আটকাতে উদ্যোগী হয়েছিলেন মহাত্মা ।

আজও অন্তরালে হরিদাস মিত্র:

রাজ্যের বর্তমান সরকারের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রর বাবা হরিদাস মিত্র । সিদ্ধার্থশংকর রায়ের মন্ত্রীসভার সদস্য ছিলেন তিনি। নির্বাচিত হয়েছিলেন খড়দা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে । বেলারানি মিত্রর নামে রয়েছে বেলানগর স্টেশন । হাওড়া-বর্ধমান লাইনের এই স্টেশনটি জনবহুল । অথচ নামের আড়ালে যে স্বাধীনতার ইতিহাস জড়িয়ে, আমরা অনেকেই জানি না । যেমন জানি না 6-এ বিপিন পাল রোডের এই বাড়িটিকে । সরকারের স্বীকৃতি হিসেবে ফলক থাকলেও তা বিস্মৃতির আড়ালে । সাধে কি নীরদ সি চৌধুরী লিখেছেন, ‘আত্মঘাতী বাঙালি’ ।

আরও পড়ুন: অমৃত আজাদিতেও আদিবাসী সমাজে উপেক্ষিত 'নেহরুর বউ' বুধনি মেঝান

Last Updated :Aug 15, 2023, 5:33 PM IST
ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.