ETV Bharat / city

নেই স্পনসর, কোরোনায় কাটছাঁট পুজোর বাজেটে

author img

By

Published : May 9, 2020, 10:09 PM IST

Updated : May 11, 2020, 8:48 PM IST

Durga Puja in Kolkata
কলকাতার দুর্গাপুজো

হাতে সময় সময় বেশি নেই । পুজোর বাকি আর সাড়ে চার মাস । এত কম সময়ে কতটা মিটবে কোরোনার আতঙ্ক? কতটা স্বাভাবিক হবে জনজীবন? থাকছে প্রশ্ন । এত কম সময় সাড়ম্বরে পুজো আদৌ কি সম্ভব?

কলকাতা, 9 মে : ক্যালেন্ডারের পাতা বলছে 22 অক্টোবর মহাষষ্ঠী । পুজোর বাকি আর মাত্র সাড়ে চার মাস । কিন্তু ঢাকে কাঠি পড়বে কি না এখন তা নিয়েই তৈরি হয়েছে সংশয় । কারণ, শিয়রে কোরোনা । ক্যালেন্ডারে 22 অক্টোবর লেখা থাকলেও এবার কলকাতায় কতগুলি দুর্গাপুজো করা সম্ভবপর হবে তা নিয়ে শুরু হয়েছে বহু জল্পনা । কোরোনা পরিস্থিতিতে ইতিমধ্যেই একের পর এক বড় বড় পুজোর উদ্যোক্তারা পুজোর বাজেট কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ।

অন্যদিকে স্বল্প বাজেটের দুর্গাপুজোর উদ্যোক্তা কমিটিগুলিরও মাথায় হাত । তাহলে কি এবছর পুজোর নিয়ম-রক্ষা করতে ঘট পুজো করতে হবে? সেই আশঙ্কার প্রহর গুনছেন কলকাতার অলিতে গলিতে হওয়া ছোটো দুর্গাপুজো কমিটিগুলি ।

তিলোত্তমার উত্তর ও দক্ষিণ মিলিয়ে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় তিন হাজারেরও বেশি দুর্গাপুজো হয় । কিন্তু এবছর পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা । টানা লকডাউনে বদলেছে অনেককিছুই । বন্ধ কারখানা । বন্ধ সড়ক পরিবহন । জীবনের স্বাভাবিক ছন্দটাই মলিন হয়ে গেছে লকডাউনের সামনে । সবকিছু যেন হঠাৎ করে থমকে দাঁড়িয়েছে ।

হাতে সময় সময় বেশি নেই । পুজোর বাকি আর সাড়ে চার মাস । এত কম সময়ে কতটা মিটবে কোরোনার আতঙ্ক? কতটা স্বাভাবিক হবে জনজীবন? থাকছে প্রশ্ন । এত কম সময় সাড়ম্বরে পুজো আদৌ কি সম্ভব?

কোরোনার থাবা দুর্গাপুজোতেও, বাজেট কমাচ্ছে একাধিক পুজো কমিটি

উত্তর কলকাতার নামীদামী পুজো কমিটিগুলি ইতিমধ্যেই বাজেট কমিয়ে অর্ধেক করে ফেলেছে । একটা বড় পুজো করতে গেলে, শুধুমাত্র চাঁদা তুলে সে টাকায় দুর্গাপুজো সম্ভব নয় । দুর্গাপুজো জাঁকজমকপূর্ণভাবে করতে প্রচুর কর্পোরেট সংস্থা বিনিয়োগ করে । এই সময় ছোট-বড়-মাঝারি সব পুজোই বিজ্ঞাপন পায় বহু সংস্থা থেকে । কিন্তু এবছর কোরোনার দাপটে বিশাল অঙ্কের আর্থিক ধাক্কার মুখে কর্পোরেট সংস্থাগুলি । নেই বিজ্ঞাপন । নেই বিজ্ঞাপনদাতাদের নিয়ে পুজো উদ্যোক্তাদের হুড়োহুড়ি ।

বাংলার অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে দুর্গাপুজোর একটা বড় ভূমিকা থাকে । প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ জড়িয়ে আছে এই দুর্গাপুজোর অর্থনীতির সঙ্গে । কেউ প্রতিমা বানান, কেউ প্রতিমার শাড়ি তৈরি করেন , কেউ বা প্রতিমার গয়না তৈরি করেন, আবার কেউ মণ্ডপসজ্জা, প্রতিমার কাঠামো তৈরি থেকে শুরু করে মাটি কাটার কাজের সঙ্গেও জড়িত । এতটাই বিশাল ক্ষেত্রজুড়ে অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে দুর্গাপুজো । শুধুমাত্র প্রত্যন্ত গ্রাম বাংলার কয়েক হাজার মানুষ জড়িয়ে রয়েছে এই দুর্গাপুজোর সঙ্গে । দুর্গাপূজার সময় রাস্তার দু'ধারে আলোকসজ্জার কাজ করেন যে ইলেকট্রিশিয়ানরা, তাঁদের কাজ থাকবে তো এ-বছর? দুর্গাপুজোর সময়টাই রাস্তার দু'ধারে যাঁরা ছোট ছোট খাবারের দোকান নিয়ে বসেন, তাঁদেরও কি আর দেখা যাবে এ-বছর? যদিও বা বসেন খাবারের পসরা সাজিয়ে, তাও বিশেষ লাভের মুখ দেখার সম্ভাবনা একেবারেই কম ।

উত্তর কলকাতার অন্যতম বড় পুজোগুলির মধ্যে একটি হল কাশী বোস লেনের দুর্গাপূজা । পুজো কমিটির সম্পাদক সৌমেন দত্ত জানিয়েছেন, "গত বছরের তুলনায় এ-বছর বাজেট প্রায় অর্ধেক করা হয়েছে । প্রতি বছর যেভাবে পুজো হয়, এ-বছর সেভাবে করা সম্ভব হবে না । বড় করে পুজো করতে যে বাজেট লাগে, এ-বছর সেই বাজেট নেই । যে কর্পোরেট সংস্থাগুলির বিজ্ঞাপনে দুর্গা পুজোর আয়োজন করা হয়, সেই কর্পোরেট সংস্থাগুলি কতটা বিনিয়োগ করতে পারবে তা নিয়েও সংশয় রয়েছে ।" পাশাপাশি সামাজিক দূরত্বও বা কীভাবে বজায় রাখা হবে, তা নিয়েও সংশয় থেকে যাচ্ছে । সৌমেনবাবু বলেন, "পুজোর মত এত বড় একটা বিষয় সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে করা যাবে না । তাহলে সামাজিক দূরত্ব মেনে কীভাবে কাজ হবে আগামী দিনে ?"

এ-দিকে ঢাকি, শ্রমিক, পটুয়া সকলেই আসে জেলা থেকে । পুজোর আড়ম্বর বাদ গেলে সমস্যায় পড়বেন এই দরিদ্র মানুষগুলিও । কারণ দুর্গাপুজোর এই চার দিনই তাদের সারাবছরের সিংহভাগ রোজগারটা হয় । লকডাউনে পুজো কমিটির তরফ থেকে এলাকার মানুষ দরিদ্র মানুষদের খাদ্য সামগ্রী দেওয়া হচ্ছে । তাই পুজোর বাজেট কমিয়ে মানুষের বিপদের দিনে পাশে দাঁড়াতেই উদ্যোগী হয়েছে পুজো কমিটি গুলি । সৌমেন দত্ত জানিয়েছেন, "আমাদের বৃহত্তর পরিবারের অংশ ওরা । সেই পরিবারকে বাদ দিয়ে তো পুজো করা সম্ভব নয় । "

হাতিবাগান সর্বজনীন দূর্গোৎসব কমিটির সম্পাদক শাশ্বত বসু জানিয়েছেন, "হাতে খুবই কম সময় । লকডাউন উঠে যাওয়ার পর জনজীবন আবার স্বাভাবিক হওয়ার পরেই শুরু করা যাবে দুর্গাপূজার প্রস্তুতি । অন্য সময় এখন থেকে থিম শিল্পীদের নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়ে যায় । শুরু হয়ে যায় ছোটোখাটো কাজও । বাজেট নিয়ে চলে বিস্তর আলোচনা । কিন্তু এবছর কিছুই নেই । পুজোয় যেসব বড় বড় কর্পোরেট সংস্থার বিজ্ঞাপন দেয় সেগুলি মূলত দিল্লি-মুম্বাই থেকেই আসে । কিন্তু দিল্লি বা মুম্বাইয়ে বর্তমানে যা অবস্থা তাতে বিজ্ঞাপন আসার বা কর্পোরেট সংস্থার অর্থ বিনিয়োগের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ ।" তাঁর মতে, বাজেট না কমিয়ে পুজো করা এবছর সম্ভব হবে না । তবে তিনি আশাবাদী দুর্গাপুজো হবেই । হয়তো আড়ম্বর আর জৌলুসে কিছুটা ভাটা পড়বে । তবে নিয়ম রীতি মেনে পুজো হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী তিনি ।

চোরবাগান সর্বজনীন দুর্গাপুজোর সম্পাদক জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখেও একই কথা । জানুয়ারি মাস থেকেই পুজোর প্রস্তুতি আস্তে আস্তে শুরু হয়ে গেছিল । বলে রাখা ভাল, উত্তর কলকাতার অন্যতম নামী পুজোর মধ্যে একটি চোরবাগান সর্বজনীন । গতবারেও একাধিক পুরস্কার পেয়েছিল চোরবাগানের পুজো । পুজো কমিটির সম্পাদক জয়ন্তবাবু বলেন, "স্টুডিয়োতে ছোট ছোট হাতের কাজ শুরু হয়েছিল । কিন্তু কোরোনার সংক্রমণে থমকে গেছে প্রস্তুতির কাজ । এখন পূজোর কাজ বন্ধ রেখে এলাকার দুস্থ মানুষদের পাশে দাঁড়ানোটা সবথেকে বড় কর্তব্য আমাদের । পুজো হয়ে যাবে । পুজো কখনও বন্ধ হয় না, আগামী দিনেও বন্ধ হবে না । কিন্তু এই সময় যেসব মানুষদের সাহায্যের প্রয়োজন তাদের পাশে থাকাটা আমাদের সব থেকে বড় কর্তব্য । আমরা নিয়মিত রান্নাবান্না করে খাবার তুলে দিচ্ছি গিরিশ পার্ক থানা ও জোড়াসাঁকো থানার পুলিশ কর্মীদের কাছে । তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে খাবার বিলি করে দিচ্ছেন । "

একই ছবি দক্ষিণ কলকাতাতেও । ত্রিধারা হোক বা নাকতলা । সর্বত্রই কাটছাঁট চলছে বাজেটে । ত্রিধারা সম্মেলনীর পুজো দক্ষিণ কলকাতার অন্যতম সেরা দুর্গাপুজোগুলির মধ্যে একটি । পুজো কমিটির সম্পাদক দেবাশীষ কুমার জানিয়েছেন, "বাজেট নিয়ে আমরা এখন চিন্তা ভাবনা করছি না । যে কঠিন সময়ের মধ্যে আমরা রয়েছি, আগে সেই পরিস্থিতির সঙ্গে লড়তে হবে । পুজো পরের বিষয় । তবে পুজো হবে অবশ্যই । কিন্তু জৌলুস আগের মতো আর থাকবে না ।"

যোধপুর পার্ক 95 দুর্গাপুজো দক্ষিণ কলকাতা আরও একটি বিখ্যাত পুজো। পুজো কমিটির তরফে রতন দে জানিয়েছেন, "এই পুজো যত বড় করে হয় এবছর সেইভাবে করা সম্ভব হবে না । এখন মানুষকে সাহায্য করাটাই সবচেয়ে বড় কাজ আমাদের কাছে । তাই পুজোর বাজেট অনেকটাই কমিয়ে আনা হয়েছে । তাই যত ছোটো করে নিয়ম রক্ষা হয় সেভাবেই কিছু একটা করা হবে ।"

নাকতলা উদয়ন সংঘের তরফে বাপ্পাদিত্য দাশগুপ্ত জানিয়েছেন, "পুজো নিয়ে এখন আমরা চিন্তাভাবনা করছি না । কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছি । তাই ক্লাবের পক্ষ থেকে এলাকার দরিদ্র দুস্থ মানুষদের পাশে দাঁড়ানো হয়েছে । ক্লাবের পক্ষ থেকে দু'বেলা রান্না করে ফুটপাতবাসী ও ভবঘুরেদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে । পুজো নিশ্চয়ই হবে, কিন্তু তবে প্রতিবছরের মতো এত বিশাল আয়োজন করা সম্ভব নয় । বাজেট অনেকটাই কমানো হয়েছে ।"

পুজো এমন জৌলুসহীন হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে গ্রামবাংলার দরিদ্র শিল্পীরা । সারা বছর বসে থাকেন পুজোর আশায় । হাজার হাজার মানুষ দুর্গাপুজোকে ঘিরে তৈরি হওয়া এই আর্থিক কর্মযজ্ঞের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন । তাই একটা আর্থিক ধাক্কা আসতে চলেছে বলেই অনুমান করছেন পর্যবেক্ষকরা ।

Last Updated :May 11, 2020, 8:48 PM IST
ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.