জম্মু ও কাশ্মীর, 23 মে: কয়েকদশক ধরে কাশ্মীর ভোট থেকে দূরে থেকেছে ৷ প্রাপ্ত ভোটের হারে তালিকার নীচের দিকে থেকেছে উপত্যকা ৷ ভোটের দিনটি ছিল বাড়িতে থাকার দিন ৷ কারণ ভোট দেওয়া এবং আঙুলে কালি লাগানোর মানে একজনের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা ৷ তবে এই লোকসভা নির্বাচনে জম্মু-কাশ্মীরে প্রাপ্ত ভোটের হার বেড়েছে ৷
পঞ্চম দফায় 20 মে বারামুল্লা লোকসভা কেন্দ্রে ভোট ছিল ৷ প্রায় 60 শতাংশ ভোট পড়েছে, যা 1967 সালের লোকসভা ভোটের পর থেকে সর্বোচ্চ ৷ 2019 সালের লোকসভা নির্বাচনে বারামুল্লা আসনে 34.89 শতাংশ ভোট পড়েছিল ৷ একসময় এই এলাকাটিকে জঙ্গি অধ্যুষিত বলে মনে করা হত ৷ সেখানে এখন মানুষ নিজের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে বেরিয়ে এসেছে ৷ যেমন পাট্টান, হ্যান্ডওয়ারা এবং এমনকী ত্রেহগাম বিধানসভা এলাকাগুলিতে 60 শতাংশেরও বেশি ভোট পড়েছে ৷ ত্রেহগাম জেকেএলএফ-এর প্রতিষ্ঠাতা মকবুল ভাটের জন্মস্থান ৷
এই ঘটনা ভারতের জন্য খুবই আনন্দের ৷ ব্রিটিশ শাসন শেষ হওয়ার পর সরকার গঠনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটি কাশ্মীরে প্রায় ছিল না বললেই চলে ৷ বিশেষত 1987 সালের পর থেকে ৷ সারা দেশে যখন গণতান্ত্রিক উৎসব চলছে, তখন কাশ্মীর ছিল যেন ধূধূ মরুভূমি ৷ হয়তো উপত্যকার রাস্তায় রক্ত ছড়িয়ে রয়েছে ৷ প্রচার হত না ৷ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের সঙ্গে ভোটারদের দেখাসাক্ষাৎ ছিল বিরল ঘটনা ৷
শাসক এবং যারা শাসিত, তাদের মধ্যে যোগাযোগের একটা বিশাল অভাব ছিল ৷ এরপর বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলি যখন ভোট বয়কটের ডাক দিল, তখন এই দূরত্ব আরও বাড়ল ৷ ভোট দিলে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলির রোষের মুখে পড়তে হতে পারে ৷ এমনকী তাতে জীবনের ঝুঁকিও বাড়তে পারে ৷ তাই মানুষ ভোট দেওয়া থেকে দূরে থাকল ৷
এই বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলির উত্থান ঘটেছিল নির্বাচন থেকে ৷ তারা জানত, একটা ভোট কোনও রাজনৈতিক নেতার জন্য কতটা মূল্যবান ৷ হিজবুল মুজাহিদিনের প্রধান সৈয়দ সালাহুদ্দিন এবং হুরিয়াতের প্রাক্তন প্রধান সৈয়দ আলি শাহ গিলানির মতো মানুষরা 1987 সালের নির্বাচনে প্রার্থী হলেন ৷ তাঁদের জন্য জেলে থেকেই পোলিং এজেন্ট হিসেবে প্রচার করলেন মহম্মদ ইয়াসিন মালিক ৷
তাঁরা মুসলিম ইউনাইটেড ফ্রন্ট বা এমইউএফের প্রতীক কলম ও কালির দোয়াতে লড়েছিলেন ৷ এক দশক পরে ওই একই প্রতীকে প্রার্থী হয়েছিলেন পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি বা পিডিপি-র মুফতি মহম্মদ সৈয়দ ৷ বর্তমানে তাঁর মেয়ে মেহবুবা মুফতি পিডিপির প্রধান ৷ তিনি জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ৷
সেবার ভোটে পরাজিত হয়েছিল এমইউএফ ৷ এর জন্য ন্যাশনাল কনফারেন্সের রিগিংকে দায়ী করেছিল তারা ৷ এনসি দলের প্রধান ফারুক আবদুল্লা ৷ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল কনফারেন্সের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হয়ে ভোটে লড়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করল ৷ একই ভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদকে সমর্থন করতে বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলিও সংঘবদ্ধ হল ৷ এখানে অশনি সংকেত দেখল উপত্যকা! 1987 সালের পর থেকে উপত্যকায় যতগুলি ভোট হয়েছে, তাতে বিশাল নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল ৷ ভোট পড়েছিল খুব কম ৷ নির্বাচনী প্রচারে প্রায় কাউকে দেখা যায়নি ৷
ফল হল, নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার পর থেকে উপত্যকায় একটা উদ্বেগের পরিবেশ তৈরি হয়ে গেল ৷ 1987 সালের পর থেকে 2024 সালের আগে পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক মানুষ ভোট দিত না ৷ 30 বছরেরও বেশি সময় মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করেনি ৷ কাশ্মীরের প্রথম বারের ভোটারের বয়স 50 বছর হতে পারে ৷ যা বাকি ভারতের থেকে একেবারে আলাদা ৷
যে জায়গাগুলি আগে খালি থাকত, সেই রাস্তাগুলিতে বুথে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ভোটাররা ৷ তাঁদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেবেন ৷ এই ভোটে আরেকটা ছবি, একসময় রাজনৈতিক-ধর্মীয় গোষ্ঠীর নেতারা ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকতেন ৷ বাকিদেরও সেটাই করতে বলতেন ৷ এবার তাঁরাও ভোট দানে আগ্রহ দেখিয়েছেন ৷
শুধু ভোটাররাই নয়, ভোটের কাজে নিযুক্ত সরকারি আধিকারিকরাও যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে এই ভোটে ৷ অতীতে এরকম বহু ভোটকর্মী কর্তব্যরত অবস্থায় তাঁদের প্রাণ হারিয়েছেন ৷ ওই ভোটকর্মী কোনও একটি নির্দিষ্ট দলের অনুগামী হলে তাঁর পরিবারের প্রকাশ্যে শোক প্রকাশের অধিকার ছিল না ৷ নীরবে মৃতদের সমাধি দিয়ে দেওয়া হত ৷
ভোট শেষ না হওয়া পর্যন্ত বুথে বুথে থাকা শিক্ষকরা এবং সরকারি আধিকারিকরা প্রাণ হাতে করে থাকতেন ৷ তাঁদের পরিবার তাঁদের নিরাপদে বাড়ি ফিরে আসার জন্য প্রার্থনা করতেন ৷ ভোটের পর কালি লাগানো আঙুল দেখতে পেলে সেই আঙুল কেটে বাদ দিয়ে দেওয়া হত ৷ ভোটকর্মীরা কাশ্মীরের রাস্তায় রাস্তায় মৃত্যুর নৃত্য দেখতে পেতেন ৷
2024 সালে তার একেবারে উলটো ৷ কাশ্মীরের রাজনৈতিক ইতিহাসে এবার দারুণ ভোট পড়েছে বলা যেতেই পারে ৷ 2019 সালের 370 ধারার অবলুপ্তি ঘটেছে ৷ তার প্রায় পাঁচ বছর পরে এই ভোট অবাক করার মতো ৷ এখন দেশের অন্য সব জায়গার মতো এখানেও ভোটের উদযাপন হচ্ছে ৷ তবে এটা বোঝা দরকার যে, ভোট দিতে মানুষ উৎসাহিত হল কেন ? প্রশ্ন এটাই যে মানুষ কি বদল চেয়ে ভোট দিচ্ছে নাকি রাজ্য ফিরে পাওয়ার জন্য ?
আরও পড়ুন: