ETV Bharat / opinion

কেন ইরান ইজরায়েলে আক্রমণ করেছে, কতটা ভয়ঙ্কর এর ফলাফল ? - Israel Iran Tensions

author img

By ETV Bharat Bangla Team

Published : Apr 15, 2024, 2:31 PM IST

Iran-Israel conflict
কেন ইরান ইজরায়েলে আক্রমণ করেছে, কতটা ভয়ঙ্কর এর ফলাফল?

Iran–Israel Proxy Conflict: ইজরায়েল দামাস্কাসে ইরানের দূতাবাসের সামনে হামলা চালানোর প্রায় দুই সপ্তাহ পর তেহরান পাল্টা জবাবে তার সহায়কদের সামরিক শক্তিকে কাজে লাগানোর পরিবর্তে তার মাটি থেকে ইজরায়েলে আকাশপথে আক্রমণ শুরু করে । কোন পথে এগচ্ছে দুই দেশের সম্পর্ক? কতটা ভয়ঙ্কর এর ফলাফল? আলোচনায় অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল হর্ষ কাকর

নয়াদিল্লি, 15 এপ্রিল: ইজরায়েল দামাস্কাসে ইরানের দূতাবাসের সামনে হামলা চালানোর প্রায় দুই সপ্তাহ পর তেহরান পাল্টা জবাব দেয় এবং ইজরায়েলের কুদস ফোর্সের কমান্ডার-সহ 7 জন সেনাকর্মীকে হত্যা করে । ইরানে তার সহায়কদের সামরিক শক্তিকে কাজে লাগানোর পরিবর্তে তার মাটি থেকে ইজরায়েলে আকাশপথে আক্রমণ শুরু করে । ইরানের একজন মুখপাত্র বলেন, "সিরিয়ায় ইরানি দূতাবাসকে লক্ষ্য করে ইহুদিবাদী শক্তির করা অপরাধের জবাবে আমরা ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে অভিযান শুরু করেছি । অধিকৃত অঞ্চলে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন দিয়ে অভিযান চালানো হয়েছে ।"

জানা গিয়েছে, ইরানের ছোড়া 185টি ড্রোন এবং 35টি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র আকাশেই ধ্বংস হয়েছে এবং 110টি ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে 103টি ধ্বংস করেছে ইজরায়েল । দূরত্বের বিষয়টি বিবেচনা করে কয়েক ঘণ্টার আগাম বিজ্ঞপ্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জর্ডান এবং ইজরায়েলের সমন্বিত পদক্ষেপের কারণে এটি সম্ভব হয়েছে ৷ ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা মুখপাত্র উল্লেখ করেছেন, কিছু ক্ষেপণাস্ত্র নেভাটিম বিমানঘাঁটিতে আঘাত করলেও সেখানে কোনও হতাহতের ঘটনা ঘটেনি । ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরপরই বিমানঘাঁটি থেকে বিমান পরিচালনার ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয় ।

তেহরান সরকার এই বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে চাপের মধ্যেই ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইজরাইলও সচেতন ছিল যে ইরানের তরফে একটি হামলা আসন্ন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন মন্তব্য করেন, "আমি নিরাপদ তথ্য পেতে চাই না ৷ তবে আমার প্রত্যাশা দেরি না করে সবটাই তাড়াতাড়ি করা।"

ইজরায়েলের দাবি, হামলাটিতে একদিন দেরি হয়েছিল ৷ কারণ, এটি ইরানের সর্বোচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের দ্বারা অনুমোদিত হয়নি । এইভাবে, যখন আকাশপথে হামলা শুরু হয়েছিল, তখন এই নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না । নেতানিয়াহু টুইট করেন, ‘আমরা বাধা দিয়েছি, আমরা ফিরিয়ে দিয়েছি, আমরা একসঙ্গে জিতব ।’ ওয়াশিংটন এবং তেল আভিভ কি গোয়েন্দাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হামলার সম্ভাব্য সময়ের উপর তাদের প্রতিরোধ পরিকল্পনা করেছিল, নাকি ইরান ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেদের মুখ বাঁচাতে এমন একটি ইঙ্গিত দিয়েছিল, তা স্পষ্ট জানা যায়নি । চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইরান-পাকিস্তান আন্তঃসীমান্ত লড়াইও এই একই পথ অনুসরণ করেছিল । ইরান হামলা চালায়, পাকিস্তান পাল্টা জবাব দেয় ৷ তারপর কূটনীতির পথে উত্তেজনার অবসান ঘটে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয় ।

দুই দেশের কেউই কোনও দেশের নাগরিকদের হত্যা করেনি ৷ কিন্তু তাদের নিজেদের শরণার্থী বা জঙ্গি শিবিরে হামলা চালিয়েছে । ইজরায়েলের প্রতিবেশীরা এই সংঘাতকে বিস্তৃত হতে এবং এই অঞ্চলকে গ্রাস করতে বাধা দিতে পরস্পরের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে । এই সংঘাতের মধ্যে সরাসরি জড়িয়ে পড়তে না চেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বাধা দিয়েছে অনেকেই ৷ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী, ওমান, কুয়েত এবং কাতার একযোগে ওয়াশিংটনকে তাদের দেশে মার্কিন ঘাঁটি এবং ইরানের উপর আক্রমণ চালানোর জন্য তাদের আকাশসীমা ব্যবহারে নিষেধ করেছে । এই সিদ্ধান্ত বড় সংঘাত তৈরির বিকল্পগুলিকে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে ।

হামলা শুরু করার পরপরই ইরান ঘোষণা করে যে, তারা 'বিষয়টি (দামাস্কাস হামলার প্রতিশোধ) শেষ হয়েছে বলে মনে করেছে।' এই বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ‘ইজরায়েলি শাসক যদি আরেকবার ভুল করেন তাহলে ইরানের প্রতিক্রিয়া আরও অনেক বেশি কঠোর হবে। এটি ইরান ও ইজরায়েলি সরকারের মধ্যে একটি সংঘাত, যেখান থেকে আমেরিকাকে অবশ্যই দূরে থাকতে হবে।' এই বার্তা থেকেই স্পষ্ট যে, তেহরানের পদক্ষেপগুলি ইজরায়েলে প্রাণঘাতী হামলার পরিবর্তে সে দেশের পরিকাঠামোকে ধ্বংস করার লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়েছিল । পাশাপাশি, ইজরাইলে এই হামলা ছিল ইরানের সামরিক শক্তির প্রদর্শনও ।

Iran–Israel Proxy Conflict
তেহরান তার মাটি থেকে ইজরায়েলে আকাশপথে আক্রমণ শুরু করে ।

ইরান, প্যালেস্তাইন, লেবানন, সিরিয়া এবং ইরাক জুড়ে চলা উল্লাসই ইঙ্গিত দেয় যে, তেহরান তার লক্ষ্যে সফল হয়েছে । এই হামলা ইজরায়েলকে ইরানের পারমাণবিক ঘাঁটিগুলিকে লক্ষ্যবস্তু করার সুযোগ দিয়েছে যা তাদের একটি দীর্ঘ অমীমাংসিত অভিপ্রায়ও বটে ৷ তবে আকাশসীমার সীমাবদ্ধতা এবং এ ক্ষেত্রে আমেরিকা জড়িত না থাকার কারণে ইজরায়েলের অভিপ্রায়ে সাফল্য অর্জন সহজ হবে না । ইজরায়েলের এ ধরনের যে কোনও প্রচেষ্টা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে সংঘাত বাড়িয়ে দেবে । আরব দেশগুলি ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক বন্ধ করতে বাধ্য হবে ।

ইরানের প্রতিক্রিয়াকে বালাকোটে হামলার সঙ্গেও তুলনা করা যেতে পারে । ভারত বালাকোটে আঘাত হেনে পাকিস্তানকে মুখ রক্ষার প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধ্য করেছিল । পাকিস্তান ভারতের মাটিতে বোমা ফেলে প্রতিশোধ নিলেও দিল্লির কড়া পদক্ষেপ থেকে বাঁচতে উইং কমান্ডার অভিনন্দনকে বিনা শর্তে মুক্তি দিয়েছিল । ভারতের পরবর্তী নীরবতার কারণে পাকিস্তান অবশ্য তাদের জয়ের দাবি করে ।

তবে, পাকিস্তানের সীমানা পেরিয়ে তাদের 'ঘরে ঢুকে হামলা' করে ভারত তার প্রতিবেশী দেশকে কড়া বার্তা দিয়েছিল । বর্তমানে, আরব দেশগুলিজুড়ে চলা উল্লাসও একই কারণে । একটি বড় সমস্যা হল, ইজরায়েলে অস্ত্র হস্তান্তরকে মার্কিন কংগ্রেস আর আটকাতে পারবে না, যা নেতানিয়াহুর জন্য একটি বড় সুবিধার বিষয় । ইউরোপ থেকে সমর্থন ইঙ্গিত দেয় যে, ইরান অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হবে ৷ তবে ইজরায়েল এ ক্ষেত্রে উত্তেজনা এড়াতে চাপের মধ্যে থাকবে । বাইডেন প্রশাসন স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, তারা ইজরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও ইরানের ওপর কোনও হামলায় অংশ নেবে না । মার্কিন প্রশাসন ইরানের উপর ইজরায়েলি পালটা হামলারও বিরোধিতা করেছে । আমিরিকা দাবি করেছে, ইজরায়েল যদি কোনও হামলা চালায়, তাহলে তার জন্য আমেরিকার কোনও প্রয়োজনীয় সমর্থন পাবে না ।

নেতানিয়াহু জানেন যে তাঁর সরকার ততদিন টিকে থাকতে পারে যতদিন এই সংঘাত চলছে । কারণ, ইজরায়েলে ইতিমধ্যেই তাঁর পদত্যাগের দাবি উঠেছে । তেহরান প্রদত্ত সুযোগ কাজে লাগিয়ে তার উপদেষ্টাদের মধ্যে 'হক' বা এমন ব্যক্তিদের বৃদ্ধির সুপারিশ করছে যাঁরা রাজনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তির ব্যবহারকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেন । তেল আভিভ যদি প্রতিশোধ না নেয়, তাহলে ইরান গর্ব করবে যে তারাই একমাত্র আরব রাষ্ট্র যারা ইসরায়েলে আঘাত হেনেছে এবং তাদের তার পরেও নীরব থাকতে বাধ্য করেছে । তবে ইজরায়েল প্রতিশোধের কথা অস্বীকার করেনি ৷ বরং বলেছে, 'যখন সঠিক সময় হবে' তারা পাল্টা আঘাত হানবে ।

নেতানিয়াহুকে ইজরায়েলের অগ্রাধিকার সম্পর্কে স্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে । হয় ইজরায়েলকে গাজায় মনোনিবেশ করতে হবে এবং এর বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে ৷ নয়তো এই সংঘাতকে আরও দীর্ঘায়িত করতে হবে । তবে এই সংঘাত দীর্ঘায়িত হলে তা ইজরায়েলকে বিচ্ছিন্ন করে রাখবে, দেশটি ক্রমে তার বর্তমান সমর্থনও হারাতে পারে । পাশাপাশি, ইজরায়েল মার্কিন সতর্কতা উপেক্ষা করে সে দেশের সমর্থনের আশ্বাস দিয়েছে যা তারা কাজে লাগাতে পারে ৷ এর ফলে এটি একটি সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি করছে ৷ যদিও বাস্তবে ওই সংঘাতে জড়িত হওয়ার কোনও ইচ্ছাই তাদের নেই ।

ভারত অবশ্য তার পক্ষ থেকে সংযমের আহ্বান জানিয়েছে । এর বিদেশ দফতরের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘আমরা অবিলম্বে উত্তেজনা হ্রাস, সংযমের চেষ্টা, হিংসা থেকে সরে আসা এবং কূটনীতির পথে ফিরে আসার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।' ডঃ জয়শঙ্কর ইজরায়েল এবং ইরান উভয়েরই তার প্রতিপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং দুই পক্ষকেই সংযমের পথে এগতে অনুরোধ করেছেন। কাতার, পাকিস্তান, ভেনিজুয়েলা এবং চিন, অন্যদের মধ্যেও শান্তির আহ্বান জানিয়েছে এবং হামলার জন্য ইরানের সমালোচনা করতে অস্বীকার করেছে ।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিটেন, ফ্রান্স, মেক্সিকো, চেক প্রজাতন্ত্র, ডেনমার্ক, নরওয়ে এবং নেদারল্যান্ডস ইরানের হামলার নিন্দা করেছে । জি 7 একটি যৌথ বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে, 'আমরা ইরান এবং তার সহযোগীদের হামলা বন্ধ করার দাবি করছি।' রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরী বৈঠকে ‘উত্তেজনা কমানোর ওপর জোর দেওয়া’ ছাড়া বাস্তবে আর কোনও ফলাফল মেলেনি । যখন পশ্চিমাদেশগুলি এবং ইজরায়েল ইরানকে সংঘাত বৃদ্ধির জন্য অভিযুক্ত করেছে তখনও তেহরান তার কার্যলাপ চালিয়ে যাচ্ছে । রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়া ও চিন থাকলে ইরানের বিরুদ্ধে কোনও সমাধানসূত্রে পৌঁছানো সম্ভব নয় ।

রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ইরানের দূতাবাস চত্বরে ইজরায়েলের হামলার নিন্দাও করেনি । রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব বলেছেন, ‘বিশ্ব বা এই অঞ্চলের কোনও দেশেরই আরেকটি যুদ্ধের সামর্থ্য নেই ।' পাকিস্তান তার ইরান-পাকিস্তান পাইপলাইনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যে ছাড়ের প্রত্যাশা করেছিল, তা আর পাবে না ৷ ফলে পাকিস্তানের আর্থিক দুর্দশা আরও প্রকট হবে । যদি 2024 সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই পাইপলাইনটির কাজ সম্পূর্ণ না হয়, তবে তার জন্য 18 বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়ে যাবে ।

পাইপলাইনের কাজে দেরি হয়েছে ৷ কারণ, পাকিস্তান ইরানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের আশঙ্কা করছে । ইতিমধ্যে ইডরায়েল এবং হামাসের মধ্যে আলোচনা আবার থমকে গিয়েছে৷ দীর্ঘ সাত মাস ধরে চলা সংঘাতে ইজরায়েলের কাছে সামান্যই বিকল্প অবশিষ্ট রয়েছে ৷ তেহরান হরমুজ প্রণালীর কাছে ইসরায়েল-যোগ থাকা একটি জাহাজকে আটক করেছে যাতে 17 জন ভারতীয় রয়েছেন । ওই জাহাজের ভারতীয় কর্মীদের মুক্তির জন্য কূটনৈতিক স্তরে আলোচনা চলছে । ইরান এবং ইজরায়েল উভয়ই বাণিজ্যিক ফ্লাইটের জন্য তাদের আকাশসীমা পুনরায় উন্মুক্ত করায় সম্ভাবনা তৈরির প্রথমিক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে । এই সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হওয়ার আগে আর কোনও উত্তজনার সৃষ্টি হয় কি না, সেটাই দেখার বিষয় ৷

আরও পড়ুন:

  1. ভারতীয়দের মুক্তি চেয়ে ইরানে ফোন জয়শঙ্করের, কথা বললেন ইজরায়েলের বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গেও
  2. ইরান-ইজরায়েল দ্বন্দ্বের জের, তেল আভিভের সব উড়ান আপাতত স্থগিত করল এয়ার ইন্ডিয়া
  3. ইরানের এয়ারস্ট্রাইকের জের, দেশের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত ইজরায়েলের
ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.