মৃত্যু মানে বিচ্ছেদ ৷ প্রিয়জন যদি সময়ের আগে চলে যায়, সেই বেদনা হয়তো কোনওভাবে প্রকাশ করা সম্ভব নয় ৷ বিশেষত সেই প্রিয়জনের যদি 18 থেকে 20 বছরে মৃত্যু হয় তাহলে দু:খের অভিঘাত আরও বাড়ে ৷ দেশে-কালে বিভিন্ন সম্প্রদায় শোক প্রকাশ করে নিজের নিজের রীতি-নীতি মেনে ৷ উদ্দেশ্য একটাই, ওই যুবক বা যুবতীর অতৃপ্ত আত্মা যেখানেই থাকুক না কেন, যেন শান্তি পায়, আরাম পায় ৷ জীবনচক্র অসম্পূর্ণ রেখে বিয়ের বাসনা পূরণ না করেই মৃত্যুর কাছে যাদের হার মানতে হয়েছে তাঁদের জন্য নেওয়া হয় বিশেষ উদ্যোগ ৷
হিমালয়ের কয়েক জায়গায় এমন 18-20 বছর বয়সি অবিবাহিত যুবকের মৃত্যু হলে তাঁকে বর হিসেবে ধরা হয় ৷ মানুষ তাঁর জন্য চিৎকার করে, হাহাকার করে ৷ একইভাবে মৃত কুমারী মেয়েদের কনে হিসেবে মনে করা হয় ৷ তাঁদের জন্য চিৎকার করে শোক প্রকাশ করাই রীতি ৷ যেন এই যন্ত্রণার কোনও শেষ নেই ৷ ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিতে না-পারার যন্ত্রণা আজীবন তাড়া করে ফিরবে বাবা-মাকে ৷ তাই এই বেদনা উপশমের নানা উপায় খুঁজে ফেরে মানুষ ৷
কোথাও আবার বাবা-মা তাঁদের এই দায়িত্ব পালন করতে মৃত ছেলে-মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করেন ৷ শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এমন প্রথা চালু রয়েছে কর্ণাটক ও কেরলের উপকূলীয় অঞ্চলগুলিতে ৷ বলা হয়, কার সঙ্গে কার বিয়ে হবে, তা স্বর্গেই ঠিক করা হয়ে থাকে ৷ পৃথিবীতে সেই অনুযায়ী ছেলেটির সঙ্গে মেয়েটির বিয়ে হয় ৷ এই প্রবাদ যেন এই দু'টি উপকূলীয় রাজ্যের ভাবনার সঙ্গে মিলে যায় ৷ এখানে মানুষ বিশ্বাস করে, বিয়ের স্বাদ না পেয়ে কারও মৃত্যু হওয়া খুবই দুঃখের, তা একেবারে কাম্য নয় ৷ কিন্তু বিয়ের ভাবনা এখানে এতটাই শক্তিশালী যে মৃত্যুও তাকে রুখতে পারে না ৷ ধুমধাম করে মৃতদের বিয়ে দেওয়া হয় ৷ বেঁচে থাকলে যেমনটি হত ৷
এই বিশ্বাস থেকেই মৃতদের বিবাহ একটা প্রথায় রূপান্তিরত হয়ে গিয়েছে ৷ যে সব পরিবারের সন্তান অল্প বয়সে বিয়ের আগেই মারা গিয়েছেন, সেই পরিবারগুলি এই প্রথা মানে ৷ তাঁরা মৃত ছেলে বা মেয়ের বিয়ে দেন ৷ এই প্রথাকে 'প্রেথা মাদুভে' বা ভূতের বিয়ে বলা হয় ৷ যত দিন না এই বিয়ে হবে, ততদিন পর্যন্ত মৃত মেয়ে বা ছেলের আত্মা অতৃপ্ত হয়ে ঘুরে বেড়াবে ৷ তাই সেই আত্মাকে শান্ত করার একটা চেষ্টা তাঁদের এই বিয়ের আয়োজন ৷
এর জন্য উপযুক্ত পাত্র বা পাত্রীর সন্ধান চেয়ে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় ৷ সম্প্রতি এমন একটি অবাক করা বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল কর্ণাটকের দক্ষিণ কন্নড় জেলার উপকূলীয় মেঙ্গালুরু শহরে ৷ এই বিজ্ঞাপন দিয়ে বাবা-মা এক ভূতুড়ে বরের সন্ধান চেয়েছেন ৷ বহুদিন হল তাঁদের মেয়ের মৃত্যু হয়েছে ৷
বাবা-মা জানিয়েছেন, তাঁদের মৃত মেয়ের জন্য একজন পাত্র চাই, যে কি না 30 বছর আগে মৃত ৷ কারণ পাত্রী মেয়ের মৃত্যুও হয়েছে 30 বছর আগে ৷ ভূতুড়ে বিয়েতে রাজি এমন পরিবারের পাত্রকে বানগেরা জাতের হতে হবে ৷ তাহলে মেয়েটির পরিবার 'প্রেথা মাদুভে' করবে ৷
- এই 'প্রেথা মাদুভে' কী এবং কীভাবেই বা এই বিয়ে হয় ?
এই বিয়ে দিয়ে বাবা-মা, পরিজন তাঁদের মৃত সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান, মৃত আত্মার শান্তি কামনা করেন ৷ এই এলাকার মানুষের বিশ্বাস, মৃতদের বিয়ের সময় তাঁদের সন্তানদের আত্মা তাঁদের কাছে আসে ৷ একজন জ্যোতিষ এই বিয়ের জন্য় শুভ দিন, সময় গণনা করে বলে দেন ৷ এরপর বিয়ের দিন অগ্নিকুণ্ডের সামনে পুরোহিত মন্ত্রোচ্চারণ করতে থাকেন ৷ ধাপে ধাপে নিয়ম মেনে ধর্মীয় আচার পালন করা হয় ৷ মাটি দিয়ে দু'টি মূর্তির মতো তৈরি করা হয় ৷ মনে করা হয়, একটি পাত্র এবং আরেকটি পাত্রী ৷
মৃত পাত্রীর জন্য নির্দিষ্ট মূর্তিকে গয়না দিয়ে সাজানো হয় ৷ তাতে কালো মুক্ত পরিয়ে এবং জেসমিন ফুলের মালা পরানো হয় ৷ যেমনটি কনের ক্ষেত্রে হয় ৷ আর বরের পাত্রটিকে পুরুষের বিয়ের পোশাক পরিয়ে, মাথায় পাগড়ি পরিয়ে দেওয়া হয় ৷ একেবারে আসল বরের মতো ৷
ওই সাজানো বর-বউকে বিয়ের মণ্ডপে আনা হয় ৷ এরপর মৃত বর ও কনের ভাই-বোনেরা তাঁদের হয়ে এই রীতিনীতিগুলি পালন করেন ৷ আসল বিয়ের মতোই মৃত বর ও কনে মালা বদল করে ৷ কনেকে সিঁদুরও পরান বর ৷
বিয়ের পর্ব শেষে থাকে জমজমাট ভূরিভোজ ৷ বিয়েটা হয় বরের বাড়িতে ৷ কনেকে সেখানে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দেওয়া হয় ৷ ছেলে-মেয়েদের মৃত্যু হলেও তাঁদের আত্মার বিয়ে হয়েছে ৷ তাই দুই পক্ষ একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন ৷ উৎসব-অনুষ্ঠানে একে অন্যের বাড়ি গিয়ে দেখা করেন ৷ যেমনটা হত, তাঁদের ছেলে ও মেয়েটি বেঁচে থাকলে ৷
