মালদা, 6 ডিসেম্বর: যে দেশের দাপটে মালদার চাষিদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছিল, সেই চিনেই জেলার রেশম গুটি রফতানি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার ৷ উদ্যোগটা নেওয়া হয়েছিল বেশ কিছুদিন আগেই ৷ চিন-জাপানের রেশমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মিহি ও উন্নত মানের সুতো তৈরির জন্য আনা হয়েছিল বিশেষ মেশিন ৷ তার মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার পরেই এ বার জেলার রেশম গুটি ও সুতো বিদেশে রফতানি করার চেষ্টা শুরু করে দিল জেলা প্রশাসন ৷
জেলাশাসক নীতিন সিংহানিয়া বলেন, “রাজ্য সরকার মালদার রেশম শিল্পকে চাঙ্গা করতে লাগাতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ৷ এ বার জেলার রেশম গুটি ও সুতো চিনের বাজারে রফতানি করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে ৷ এর জন্য বেশ কয়েকটি রফতানিকারক সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করা হয়েছে ৷ তারাও জেলার রেশম বিদেশে রফতানিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে ৷ সব কিছু ঠিকঠাক চললে এই জেলায় রেশম শিল্পে জোয়ার আসবে ৷ উপকৃত হবেন চাষি, রিলার থেকে শুরু করে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকে ৷ উপকৃত হবে জেলার অর্থনীতিও ৷”
রেশম উৎপাদিত এলাকাতেই বাড়ি রাজ্যের মন্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিনের ৷ তিনি বলেন, “মালদার রেশম শিল্পকে শুধু বাঁচানোই নয়, এই শিল্পকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে তৎপর রাজ্য সরকার ৷ তার জন্য ইতিমধ্যে ইংরেজবাজারের মধুঘাট এলাকায় একটি সিল্ক পার্ক তৈরি করা হয়েছে ৷ জেলার রেশম বিদেশে রফতানি করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার ৷ জেলা প্রশাসন সেই প্রক্রিয়া শুরু করেছে ৷ রেশম শিল্পে এই জেলার সোনালি অতীত ফিরিয়ে আনতে রাজ্য সরকার বদ্ধপরিকর ৷”
মালদা জেলার রেশম ইতিহাস অতি প্রাচীন ৷ মুঘল আমলে এখানকার রেশমি কাপড় যেত সুলতানদের দরবারে ৷ তার প্রামাণ্য নথিও রয়েছে ৷ একটা সময় এই জেলার রেশম পাড়ি দিত মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে ৷ তবে সময়ের সঙ্গে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে ৷ আবহাওয়ার প্রতিকূলতা, পুরনো প্রযুক্তি, সরকারি নিষ্পৃহতা-সহ বিভিন্ন কারণে রেশম চাষ থেকে মুখ ফেরাতে শুরু করেন কৃষকরা ৷ এভাবেই একসময় খাদের ধারে এসে দাঁড়িয়েছিল এই শিল্প ৷ তবে সম্প্রতি পরিস্থিতির বদলেছে ৷ রাজ্য ও কেন্দ্র, দুই সরকারই জেলার সোনালি রেশমি যুগ ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ নেয় ৷
প্রথমে রেশম চাষের পরিধি আবার বাড়ানোর চেষ্টা করা হয় ৷ এই মুহূর্তে জেলায় প্রায় 21 হাজার একর জমিতে তুঁতের চাষ করা হচ্ছে ৷ এই শিল্পে জেলাবাসীর অংশগ্রহণও বেড়েছে ৷ এখন প্রায় 61 হাজার পরিবারের গ্রাসাচ্ছদন হয় এই শিল্পে ৷ প্রতি বছর গড়ে 1500 মেট্রিক টন কোকুন উৎপাদিত হচ্ছে ৷ বর্তমানে এই জেলায় তিন ধরনের রেশম সুতোর উৎপাদন হচ্ছে ৷ পুরনো দিনের হলুদ রঙের নিস্তরি সুতো, উন্নত মানের সাদা রঙের বাইভোল্টাইন সুতো এবং এই দুই প্রজাতির মিশ্রণে উৎপাদিত এফ-1 প্রজাতির হালকা ঘিয়ে রঙের সুতো ৷ তবে বাইভোল্টাইন সুতোর চাহিদা এবং দামই সবচেয়ে বেশি ৷
সাম্প্রতিক সময়ে চিন, জাপান এবং কোরিয়ার উন্নত মানের রেশমের দাপটে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছিল মালদার এই ঐতিহ্য ৷ মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রাচীন কাঠের ঘাইয়ে তৈরি সুতো ৷ এই সুতো তুলনায় মোটা ৷ গুণমান ভালো নয় ৷ তাই সুতোর বাজারে বাকি দেশগুলির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারত না ৷ কয়েক মাস আগে সেই সমস্যাও দূর করেছে রাজ্য সরকার ৷ জেলায় নিয়ে আসা হয়েছে মাল্টি এন্ড রিলিং মেশিন ৷ প্রতিটি মেশিনে রয়েছে 10টি এন্ড এবং 10টি পয়েন্ট ৷ অর্থাৎ আগে যে কোকুনে একটি সুতো তৈরি হত, এ বার সেই কোকুনে 100টি সুতো তৈরি হচ্ছে ৷ এই মিহি সুতোই এ বার বিশ্ব বাজারে চিন-জাপান-কোরিয়াকে পাল্লা দিতে তৈরি ৷
গত সেপ্টেম্বর থেকে রাজ্য রেশম দফতরের যুগ্ম অধিকর্তা (উত্তরবঙ্গ) অরূপ ঠাকুর ইটিভি ভারতকে জানিয়েছিলেন, রাজ্যের মোট রেশমের 70 শতাংশ যেহেতু মালদা জেলায় উৎপাদিত হয়, তাই সেখানেই প্রথমে মাল্টি এন্ড রিলিং মেশিন বসানো হয়েছে ৷ এ বার তাঁরা রাজ্যের রেশম সুতো বিদেশে রফতানি করতে পারবেন ৷ সম্বৃদ্ধ হবে মালদার অর্থনীতি ৷ আয় বাড়লে চাষি ও সুতো তৈরির কারিগররাও এই শিল্পে উৎসাহিত হবেন ৷ পরে মালদায় আরও উন্নত অটোমেটিক রিলিং মেশিন বসানোর পরিকল্পনাও রয়েছে তাঁদের ৷ তবে সে ক্ষেত্রে অনেক চিন্তাভাবনা করে এগোতে হবে ৷ কারণ, ওই মেশিনে শুধুমাত্র বাইভোল্টাইন ছাড়া অন্য প্রজাতির কোকুন ব্যবহার করা যাবে না ৷
এই উদ্যোগেরই এ বার সুফল পাওয়ার লক্ষ্যে আরও অগ্রসর হয়েছেন প্রশাসনিক কর্তারা ৷ মালদা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগ সফল হলে এই জেলার রেশমের হৃতগৌরব ফিরে আসা শুধু সময়ের অপেক্ষা বলে মনে করছেন রেশম চাষ ও শিল্পের সঙ্গে জড়িত সবাই ৷
আরও পড়ুন: