ETV Bharat / state

নিজে হাতে শিকড় উপড়ে মুছে দিচ্ছেন ঠিকানা, গঙ্গা ভাঙনে সর্বস্বান্ত বালুটোলার 200 পরিবার

author img

By

Published : Jul 15, 2021, 4:41 PM IST

Updated : Jul 15, 2021, 5:05 PM IST

বালুটোলা গ্রামের শ’দুয়েক পরিবার আজ বিপন্ন । ভোর হলেই চারদিকে কোদাল-বেলচা আর হাতুড়ির শব্দ । আশ্রয় ভাঙায় হাত লাগাচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মও । অথচ একসময় এই গ্রামের ধারেকাছেও নদীর চিহ্ন ছিল না । গঙ্গাস্নান করতে গ্রামবাসী পেরোত প্রায় দশ কিলোমিটার পথ । সেই গঙ্গাই এখন প্রায় ঘরে ধাক্কা মারছে । নদী আর বসতির মাঝখানে রয়েছে আর একচিলতে পাটের খেত ।

s
s

মালদা, 15 জুলাই : বাড়ির সামনে ট্র্যাক্টরটায় তোলা হচ্ছিল ভাঙা বাড়ির ইট । সেদিকেই একদৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন আবদুর রাজ্জাক । কোথায় ঘর বসাবেন, জানেন না । শুধু জানেন, গঙ্গা গিলে নিয়েছে তাঁর 50 বিঘা কৃষিজমি । বাড়ির পাশে 14 বিঘার একটি প্লটে এবার পাট লাগিয়েছিলেন । পলিমাটির গুণে নধর হয়ে উঠেছিল পাটের গাছ । কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি । সেই জমিও এখন নদীর পেটে । গঙ্গা ধেয়ে আসছে বাড়ির দিকে । তাই সময় থাকতেই ঘরের জিনিসপত্র সরাতে শুরু করেছেন । ভেঙে ফেলছেন তিল তিল করে তৈরি করা পাকা বাড়িটাও । কোথায় যাবেন, জানেন না ।

শুধু রাজ্জাক সাহেবই নন, এই ছবিটা এখন বালুটোলা গ্রামের শ’দুয়েক ঘরেই চোখে পড়ছে । ভোর হলেই চারদিকে কোদাল-বেলচা আর হাতুড়ির শব্দ । আশ্রয় ভাঙায় হাত লাগাচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মও । কখনও ক্লান্ত হয়ে পড়লে নদীর পানে তাকিয়ে খানিক বিশ্রাম । যেন গঙ্গাকে মেপে নেওয়ার পালা । অথচ একসময় এই গ্রামের ধারেকাছেও নদীর চিহ্ন ছিল না । গঙ্গাস্নান করতে গ্রামবাসী পেরোত প্রায় দশ কিলোমিটার পথ । সেই গঙ্গাই এখন প্রায় ঘরে ধাক্কা মারছে । নদী আর বসতির মাঝখানে রয়েছে আর একচিলতে পাটের খেত ।

s
ভাঙনে আশ্রয় হারাচ্ছে মানুষ

অথচ এতদিন বেশ সুখেই সংসার করছিলেন রাজ্জাক সাহেব । তিনি বলছেন, “এবার গঙ্গার পরিস্থিতি খুবই খারাপ । জমি-জায়গা তো গিলেছেই ৷ এবার আমাদের বাড়িও গিলতে আসছে সে । সময় থাকতেই আমরা বাড়ি ভেঙে নিচ্ছি । কিন্তু কোথায় যাব, জানি না । আমাদের আর কোনও ভিটে বেঁচে নেই । এবার আমার 50 বিঘা জমি নদীতে চলে গেল । 14 বিঘা প্লটের পাটখেত গঙ্গায় চলে গিয়েছে । আমি চাষবাস করে খাই । পাঁচ ছেলে আর দুই মেয়েকে লেখাপড়াও করাই । এক ছেলে ডাব্লিউবিসিএস কোচিং নিচ্ছে, একটি আরবিতে অনার্স নিয়ে পড়ছে, তৃতীয় ছেলে এবার স্নাতক স্তরে ভর্তি হবে । বড় মেয়েকে ডিএড করিয়েছি । এবার তাদের পড়াশোনা কিভাবে চালাব । এবার প্রায় কুড়ি দিন আগে থেকে ভাঙন শুরু হলেও তার তীব্রতা বেড়েছে পনেরো দিন আগে

।"

s
নিজে হাতে ভাঙতে হচ্ছে আশ্রয়

ক্ষোভ প্রকাশ করেন আবদুর ৷ বলেন, "এখনও পর্যন্ত কেউ আমাদের পরিস্থিতি দেখতে আসেনি । এলাকার বিধায়ককে সব জানানো হয়েছে । তিনিও আসেননি । বাড়ির ইট-কাঠ অন্যের জমিতে ফেলতে গেলেও তারা বাধা দিচ্ছে । আগে আমার ট্র্যাক্টর, পাওয়ার টিলার সব ছিল । সেসব দিয়ে নিজের জমি চাষ করতাম । এখন আমি ফকির ।”

গঙ্গার ছোবলে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে মনখুস বিবির 10 বিঘা জমি । এখন তিনি ভূমিহীন । স্বামী পক্ষাঘাতের শিকার । ছেলেরা সব আলাদা থাকে । গঙ্গা গিলে নেওয়ার আগে নিজের বাড়ি ভেঙে ফেলেছেন তিনিও । বলেন, “লদ্দি দুয়ারের পার্শে চলে এসেছে । জমি জায়গা, পাট পানি সব পড়ে গিয়েছে । হামি এখন খাটতে পারছি না । ঘরে একটা বুড়া আছে । তার প্যারালিসিস । ব্যাটারা সব ভিন্ন আছে । ওরা আপনার ছেলেপিলে নিয়ে খাচ্ছে । হামি যখন চাক্কাটা গড়ালছি তো পয়সাটাও পাই না যে মালটা কোথাও ফেলব কাহারি জাগাতে । এখন হামি চাহাছি যে দু’কাঠ্ঠা জায়গা দেন তো হামি সেখানে গিয়ে বসি । 10 বিঘা জমি চলে গিয়েছে । সরকারের একটা লোক কালকে এসেছিল । আজ একটা ত্রিপাল দিয়েছে । চারটা লোকে একটা ত্রিপালে হবে না ।”

পাশেই ছেলে কোলে দাঁড়িয়েছিলেন সোনাভান বিবি । তিনি বলেন, “ভাঙনের চোটে বাড়িঘর সব ভেঙে ফেলতে হচ্ছে । কোথায় থাকব জানি না । সরকার কোথাও জায়গা দিলে সবাই সেখানে বাড়িঘর নিয়ে গিয়ে ফেলবে । আমাদের বাড়িও ভাঙা পড়ে গিয়েছে । সবাই নিজেরাই বাড়ি ভেঙে নিচ্ছে । বহু ঘর নদীতে পড়ে গিয়েছে । তাই সময় থাকতে ঘর ভেঙে ফেলছি । কী খাব, তারও ঠিক নাই । বিঘা 12 জমি ছিল । নদীতে চলে গিয়েছে ।”

গঙ্গা ভাঙনে সর্বশান্ত মালদার বালুটোলা

শুধু সাধারণ গ্রামবাসীরাই নয় । গঙ্গার ছোবল থেকে বাঁচতে ঘর ভাঙছেন বালুটোলার পঞ্চায়েত সদস্য সফিকুল হকও । তিনি বলেন, “ভাঙন পরিস্থিতি খুবই খারাপ । এবার অন্তত 200 ঘর নদীতে চলে যাচ্ছে । সবাই গরিব মানুষ । অন্য কোথাও কারও জায়গাও কেনা নেই । এখন ভাঙা বাড়ির সামগ্রী অন্যের জমিতে ফেলছে সবাই । কেউ ফেলতে দিচ্ছে, অনেকে দিচ্ছে না । এখনও পর্যন্ত 100 ঘর নদীতে চলে গিয়েছে । শ’দুয়েক ঘর ভাঙা হচ্ছে । আমার বাড়িও ভাঙা হচ্ছে । পরিবারের বারো সদস্যকে নিয়ে কোথায় যাব জানি না । আজ কিছু ত্রিপল এসেছে । প্রত্যেককে একটা করে দেওয়া হয়েছে । কিন্তু তাতে কিছু হবে না । আমরা পুনর্বাসনের জায়গা চাই ।”

আরও পড়ুন: Erosion along the Ganga : মানিকচকে গঙ্গার ভাঙন রোধে কাজ শুরুর নির্দেশ সেচমন্ত্রীর

গতকালই এলাকা পরিদর্শন করে সেচ দফতরের প্রতিমন্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন জানিয়েছেন, এখনই কারও জন্য পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয় । সরকারি জায়গার দাবি করলেই হবে না । আগে সরকারি খাস জমি খুঁজতে হবে । পরিস্থিতি অনুযায়ী এই বিষয়ে তাঁরা ভাববেন ।

এখন গঙ্গাপাড়ে একটাই কথা এলোমেলো বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে । এই নদীই একসময় গ্রামবাসীদের আমির বানিয়েছিল । এখন সেই নদী তাদের ফকির বানিয়ে ছাড়ল ।

Last Updated : Jul 15, 2021, 5:05 PM IST
ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.