এক থেকে 14 বছরের মধ্যের বাচ্চাদের মধ্যে অন্ত্রের কৃমি এবং মাটি থেকে পরিবাহিত কৃমি (এসটিএইচ) থেকে হওয়া সংক্রমণ রোধ করার লক্ষ্যে আমাদের দেশে বছরে দুই বার জাতীয় কৃমিনাশক দিবস পালিত হয় । এই দু’টি দিন হল 10 ফেব্রুয়ারি এবং 10 অগাস্ট । শিশুদের মধ্যে, বিশেষ করে যারা গ্রামে থাকে, তাদের মধ্যে এই সংক্রমণ একটি অতি সাধারণ ঘটনা ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-এর মতে ভারতের 24 কোটি 10 লাখ শিশু, যাদের বয়স 1 থেকে 14 বছর, তাদের মধ্যে এই ধরনের কৃমির সংক্রমণের আশঙ্কা যথেষ্ট । এদের যদি সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করানো হয়, তা হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে বাধ্য ।
জাতীয় কৃমিনাশক দিবসের মূল লক্ষ্য কী?
ভারতের জাতীয় স্বাস্থ্য পোর্টাল (এনএইচপি) বলছে এই দিনের লক্ষ্য 1 থেকে 19 বছর বয়সি সব বাচ্চার শরীর থেকে কৃমি নাশ করা । এই সব বাচ্চাদের নাম স্কুলে নথিভুক্ত থাকতেও পারে আবার নাও থাকতেও পারে । এই কাজে ব্যবহার করা হবে স্কুল এবং অঙ্গনওয়ারি কেন্দ্রগুলিকে । এই দিবসের বৃহত্তর লক্ষ্য হল বাচ্চাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন, পুষ্টির তথ্য যাচাই এবং জীবনমানের উন্নতির জন্য উন্নত মানের শিক্ষার ব্যবস্থা করা ।
মাটি থেকে পরিবাহিত কৃমি বা এসটিএইচ এবং কৃমিনাশ সম্পর্কে আরও ভালো করে বুঝতে আমরা কথা বলেছিলাম হায়দরাবাদের রেনবো চিলড্রেনস হাসপাতালের কনসালট্যান্ট নিউরোলজিস্ট এমডি, এমআরসিপিসিএইচ (ব্রিটেন) বিজয়ানন্দ জামালপুরির সঙ্গে ।
কৃমিনাশের গুরুত্ব
- বাচ্চাদের যদি সঠিক সময়ের ব্যবধানে কৃমি নাশ করানো হয় তাহলে শরীরের সঠিক বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পুষ্টির সঠিক মাত্রায় শোষণ হবে ।
- স্কুলে বাচ্চার মনোযোগ এবং উৎসাহ বাড়বে ।
- সমাজের প্রতিটি স্তরে বহু দিন ধরে চলা কৃমি সংক্রমণের মাত্রা হ্রাস পাবে ।
- পেটের বিভিন্ন রোগ এবং রক্তাল্পতার আশঙ্কা অনেকটাই কমবে ।
- এর ফলে বাচ্চার উৎসাহ এবং কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ।
এসটিএইচ কীভাবে ছড়িয়ে পড়ে
ডক্টর বিজয়ানন্দের ব্যাখ্যা, মাটি থেকে পরিবাহিত হেলমিন্থ বা পরজীবী কৃমি খুব সহজেই দূষিত খাবার বা দূষিত হাতের মাধ্যমে শরীরে ছড়িয়ে পড়ে । সাধারণভাবে যে কৃমিগুলি দেখা যায় সেগুলি হল, গোলকৃমি, ফিতাকৃমি এবং আঁকশিকৃমি । কোনও সংক্রামিত ব্যক্তি যখন খোলা জায়গায় শৌচকর্ম করেন, তখন তাঁর মলের মাধ্যমে পরিণত কৃমির ডিম মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে । দূষিত মাটির মাধ্যমে বিভিন্ন ভাবে সংক্রমণ ঘটাতে পারে । যেমন, ভালো করে না ধুয়ে শাকসবজি বা ফল খেলে বা শাক সবজি ভালো করে রান্না করে না খেলে বা খাওয়ার আগে হাত না ধুলে বা সংক্রামিত শৌচাগার ব্যবহার করলে বা দূষিত জল খেলে ইত্যাদি ।
আরও পড়ুন, ‘গিফটেড চাইল্ড’–দের জন্য জন্য পুষ্টি
এই কৃমিগুলি ঠিক কী করে?
আমাদের বিশেষজ্ঞ জানালেন, আমাদের শরীরে কৃমি ঢোকার পর তা অন্ত্রে প্রবেশ করে । এরপর সেখানে পাকাপাকি ভাবে বসবাস শুরু করে । সেখান থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করতে শুরু করে । এ ছাড়াও তারা অন্ত্রের ভিতরের স্তরের মারাত্মক ক্ষতি করে । এর ফলে আমাদের শরীরের শোষণ ক্ষমতা হ্রাস পায় । এর ফলে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হয় । এর ফলশ্রুতি হিসাবে হয় রক্তাল্পতা । পুষ্টি সঠিক ভাবে না পাওয়ার ফলে অপুষ্টিজনিত নানা সমস্যা দেখা দেয়। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রে শারীরিক ও মানসিক বিকাশ থমকে যায় ।
অবস্থা মারাত্মক হলে অন্ত্র আটকে যেতে পারে । এমনকী, অন্ত্রে অস্ত্রোপচারেরও প্রয়োজন হতে পারে । আর তাই পর্যায়ক্রমে কৃমিনাশ খুবই প্রয়োজন । কৃমি সংক্রমণ ঠেকাতে বিশেষ করে বাচ্চাদের বছরে এক বার করে কৃমিনাশ করানো অবশ্যই উচিত ।
কী ধরনের লক্ষণ দেখা যায়
ডক্টর বিজয়ানন্দ বলছেন, আপনি যদি আশঙ্কা করেন যে আপনি এবং আপনার সন্তান অন্ত্রের কৃমির সংক্রমণে ভুগছেন, তা হলে আপনি এই সব লক্ষণগুলি খেয়াল করুন—
- ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া ।
- রক্তাল্পতা ।
- কোনও কাজে উৎসাহ না পাওয়া এবং কর্মক্ষমতা হ্রাস পাওয়া ।
- বিরক্তি ভাব বেড়ে যাওয়া ।
- অতিরিক্ত ক্লান্তিভাব ।
- পেটে যন্ত্রণা ।
- ডায়ারিয়া বা কোষ্টকাঠিন্য ।
- খিদে না হওয়া ।
- স্কুলে বিভিন্ন পাফরম্যান্স কমে যাওয়া ।
কখনও আবার এই সব কৃমি মলের মাধ্যমেও বেরিয়ে যেতে পারে।
আমাদের বিশেষজ্ঞের মতে, ‘‘বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এই সংক্রমণ অনেক বেশি পরিমাণে দেখা গেলেও এই সংক্রমণ বড়দের মধ্যেও হতে পারে। এগুলি শুধুমাত্র যে সংক্রামক তা-ই নয়, এগুলি বছরের পর বছর শরীরের মধ্যে থেকে যেতে পারে এবং শারীরিক বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি ধ্বংস করতে পারে । তাই এর উপদ্রবে বাচ্চার কর্মক্ষমতা চোখে পড়ার মতো কমে যেতে পারে । তবে এটা না তো ভয়ঙ্কর রোগ, না তো এটা প্রাণ সংশয় ঘটাতে পারে । কিন্তু এটি বহু দূরারোগ্য রোগের জন্ম দিতে পারে যেমন অন্ত্রে আটকে যাওয়া বা মারাত্মক ধরনের রক্তাল্পতা হওয়া ইত্যাদি ।’’
আরও পড়ুন, জ়িঙ্কের প্রয়োজনীয়তা, ঘাটতি, লাভ এবং উৎস
সংক্রমণ ঠেকাতে কী করণীয়
এই সংক্রমণ থেকে বাঁচতে ভারতের জাতীয় স্বাস্থ্য পোর্টাল (এনএইচপি) বেশ কয়েকটি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার কথা বলেছে । যেমন—
খোলা জায়গায় শৌচকর্ম না করা ।
বারে বারে হাত ধোওয়া । বিশেষ করে খাওয়ার আগে এবং শৌচ করার পরে ।
জুতো এবং চটি যতটা সম্ভব বেশি ব্যবহার করা ।
পরিষ্কার এবং নিরাপদ জলে ফল এবং শাক সবজি ভালো করে ধুয়ে ব্যবহার করা ।
ভালো করে রান্না করা খাবার খাওয়া ।