পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

আনলকে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরছে শপিংমলগুলি, গ্রাহকের আশায় রেস্তরাঁ মালিকেরা

By

Published : Jul 14, 2020, 5:52 PM IST

কেন্দ্রীয় ও রাজ‍্য সরকারের দেওয়া কোরোনা প্রতিরোধের সমস্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনেই সর্বসাধারণের জন্য খুলে গেছে শপিং মলের দরজা ৷ আগের মতোই বসে খাওয়ার জন্য খুলে গেছে রেস্তরাঁগুলিও । কিন্তু কোরোনা ভাইরাসের আতঙ্ক কাটিয়ে কি সাধারণ মানুষ শপিং মল বা রেস্তরাঁমুখী হচ্ছেন?

Shopping malls and Restaurant of Kolkata
স্বাভাবিক ছন্দে ফিরছে শপিংমলগুলি

কলকাতা, 14 জুলাই : কোরোনা আবহে 22 মার্চ জনতা কারফিউ থেকে শুরু হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলা লকডাউনে বন্ধ ছিল সব শপিং মল ও রেস্তরাঁ । প্রায় আড়াই মাস পর আনলক ওয়ানে 8 জুন থেকে সেগুলি খোলার ছাড়পত্র দিয়েছে রাজ‍্য সরকার । কেন্দ্রীয় ও রাজ‍্য সরকারের দেওয়া কোরোনা প্রতিরোধের সমস্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনেই সর্বসাধারণের জন্য খুলে গেছে শপিং মলের দরজা ৷ আগের মতোই বসে খাওয়ার জন্য খুলে গেছে রেস্তরাঁগুলিও । কিন্তু কোরোনা ভাইরাসের আতঙ্ক কাটিয়ে কি সাধারণ মানুষ শপিং মল বা রেস্তরাঁমুখী হচ্ছেন? খোঁজ নিতে কলকাতার একাধিক শপিং মল ও রেস্তরাঁ ঘুরে দেখল ETV ভারত ।

নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য শপিং মল খোলার অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক বলেই দাবি গ্রাহকদের ৷ গ্রাহক বন্দিতা লিঙ্কা বলেন, " প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জন্য খোলা দরকার ছিল । কতদিন আর বসে থাকব বাড়িতে ? দরকারি জিনিসগুলি তো নেওয়ার প্রয়োজন আছেই । তবে, COVID-19 পুরোপুরি কন্ট্রোলে আসার পর খুললেও ভালো হত ।"

বেহালার দীনেশ সিং বলেন, "বাড়ির কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার থাকে শপিং মলে । সেগুলির জন্য খোলাটা ঠিকই আছে ।"

শপিং মলে প্রবেশের লাইন

গ্রাহক রশ্মি জানা আবার শপিং মল খোলার পক্ষে সায় দিলেও রেস্তরাঁ খোলাটা এখনই ঠিক নয় বলে জানান তিনি । রশ্মি বলেন, "শপিং মল খোলাটাও ঠিক উচিত হয়নি । কিন্তু, মানুষের অনেক কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস শপিং মল থেকে কেনার দরকার পড়ে । তাই শপিং মল খোলাটা মেনে নেওয়া যায় ৷ তবে, সবাইকে অনুরোধ করব, প্লিজ বি সেফ । কিন্তু এখনই রেস্তরাঁ খোলার প্রয়োজনীয়তা ছিল না ৷"

ফাঁকা রেস্তরাঁ

স্বাভাবিকভাবেই প্রয়োজনীয় জিনিসের চাহিদায় শপিং মলগুলিতে মানুষের আনাগোনা ধীরে ধীরে বাড়ছে ৷ দক্ষিণ কলকাতার লেক মলের ম‍্যানেজার পীযূষ সরকার বলেন, "শপিং মল খোলার জন্য কেন্দ্র এবং রাজ‍্য সরকার থেকে যা যা SOP দেওয়া হয়েছিল সমস্ত কিছু আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছি । স্বাস্থ্যকে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি । মলে প্রবেশ করার সময় প্রথমেই থার্মাল স্ক্রিনিং করা হচ্ছে । তাপমাত্রা ঠিক থাকলেই গ্রাহকদের প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে ৷ একইসঙ্গে হ্যান্ড স্যানিটাইজ়ারও দেওয়া হচ্ছে ৷ কিছু সময় পর পরই মলের সমস্ত টাচ-পয়েন্টগুলো যেমন, এসকেলেটরের বেল্ট, লিফ্টের বোতাম, টয়লেটের ফ্ল‍্যাশ বোতাম, বেসিনের ট‍্যাপগুলোর মতো সবকিছুকেই স‍্যানিটাইজ করা হচ্ছে । পুরো মলটাকে প্রতিদিন স‍্যানিটাইজ করছি । সামাজিক দূরত্বের জন্য ফ্লোরে স্টিকার দেওয়া আছে । 8 জুন মল খোলার পর থেকে আমরা মানুষের মধ্যে যে ভয় দেখেছিলাম সেটা আস্তে আস্তে কাটছে । প্রতিদিন মানুষের যাতায়াত যেভাবে বাড়ছে তাতে আমরা বিশ্বাস করছি খুব দ্রুত মলটা আগের মতো অবস্থায় চলে আসবে । "

আনলকে কী পরিস্থিতিতে রয়েছে শপিং মল ও রেস্তরাঁগুলি ?

COVID-19 প্রতিরোধের জন্য সমস্ত রকম সুরক্ষা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনেই চলছে অ্যাক্সিস মল । অ্যাক্সিস মলের আধিকারিক বলেন, "আমরা গেটে থার্মাল গান দিয়ে তাপমাত্রা মেপে ও হ্যান্ড স‍্যানিটাইজ় করার পর গ্রাহকদের প্রবেশ করতে দিচ্ছি । প্রত‍্যেকদিন মল স‍্যানিটাইজ করা হচ্ছে । প্রত‍্যেক দু'দিন অন্তর সব স‍্যানিটাইজ় করানো হচ্ছে । মাস্ক ছাড়া কাউকে ঢুকতে দিচ্ছি না । আমরা প্র‍ত‍্যেকটা দোকানের সামনে এবং ভিতরে মার্কিং করে দিয়েছি । সেখানেই দাঁড়াতে হবে । দোকানগুলিতে জামাকাপড়ের ট্রায়ালের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না ৷ যাদের যতটুকু দরকার তাঁরা ততটুকু করে বেরিয়ে যাচ্ছেন । কেউ রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে বা গল্প করলে তাঁদের দাঁড়াতে না করা হচ্ছে । এগুলো সব মেনে চলা হচ্ছে । যাঁরা মলে আসছেন তাঁদের থেকে আমরা প্রচণ্ড রকম সহযোগিতা পাচ্ছি । "

অ্যাক্সিস মলে মানুষের আনাগোনা কেমন সে প্রসঙ্গে ওই আধিকারিক বলেন, "আমরা ভালোই রেসপন্স পাচ্ছি । আগের মতো মানুষ তো কোনও মলেই আসছেন না । তবে, মানুষ এখন অনেক সচেতন হয়েছেন । আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করছেন । ধীরে ধীরে মানুষের আনাগোনা বাড়ছে । তবে, ফেস্টিভ্যাল আসার আগে যে শপিং স্প্রি শুরু হয় সেটা হতে এখনও সময় লাগবে । সরকারি নির্দেশে মাল্টিপ্লেক্স ও বার কাম রেস্টুরেন্টগুলি এখন বন্ধ আছে । শপিং মলে মাল্টিপ্লেক্স, রেস্টুরেন্ট, বার এগুলোই বেশিরভাগ ক্রাউড টানে । তবে, বর্তমান পরিস্থিতির বিচারে ফিডব‍্যাক ভালো আছে । আপ-ডাউন একটু হয় । কিন্তু, প্রথম থেকে দেখতে গেলে আমাদের গ্রাফটা ক্রমশ উপরের দিকে এগিয়ে গেছে ।"

অ্যাক্সিস মল কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী-

  • গতবছর পুজোর সময় 70-72 হাজার মানুষ এসেছেন মলে
  • উইকেন্ড ও পুজোর সময় বাদ দিয়ে অন্যান্য দিনগুলিতে প্রতিদিন 30-35 হাজার মানুষের আনাগোনা ছিল
  • শনি ও রবিবার দিন প্রতি মানুষ হত 42-45 হাজার

আনলক ওয়ানে শপিং মল খোলার পর এখনও পর্যন্ত সর্বনিম্ন 9 হাজার মানুষ এসেছে অ্যাক্সিস মলে । সেটা অবশ্য শপিং মল খোলার প্রথম দিকে । পরে অবশ্য মানুষের আনাগোনা আরও বেড়েছে ।

  • অ্যাক্সিস মলে বর্তমানে উইকেন্ড বাদ দিয়ে প্রতিদিন 10-13 হাজার মানুষ আসেন
  • শনি ও রবিবার দিন প্রতি 12-15 হাজার মানুষ আসে

শপিং মলে মানুষের যাতায়াত বাড়লেও রেঁস্তরাগুলির ক্ষেত্রে চিত্রটা অন্যরকম ৷ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরও ফাঁকাই থাকছে বেশিরভাগ সময় ৷

শহরের নামী এক রেস্তরাঁ মার্কোপোলোর ম‍্যানেজার কল্লোল বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় বলেন, "পরিস্থিতি খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয় । আমাদের অতিথিরা যে আসছেন না তাও নয় । কিন্তু সামগ্রিকভাবে একটা ভীতির পরিবেশ তৈরি হয়ে গেছে ৷ নিরন্তর একটা প্রচারও হচ্ছে ৷ তার একটা প্রভাব তো রয়েছে । কিন্তু সরকার যখন খোলার অনুমতি দিল তখন আমরা তো ধরেই নেব পরিস্থিতি নিশ্চয়ই অনুকূল হয়েছে যার জন্য আমাদের অপারেট করতে বলা হচ্ছে । দুর্ভাগ্যবশত, যেহেতু কোরোনা-ভীতিটা যাচ্ছে না তাই মানুষের থেকে যে সাড়া পাওয়ার আশা করেছিলাম সেটা হচ্ছে না । আমরা অতিথিদেরও বলছি, আপনারা আসুন, নির্দ্বিধায়, নিঃসঙ্কোচে আসুন । যে আনন্দটা করতেন আগে, সেটা এখনও করুন ৷"

মার্কোপোলো কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে-

  • আগে কোনও বিশেষ দিনে 100-130 জনের মতো গেস্ট আসত
  • বর্তমানে কোনও বিশেষ দিনে 20-25 মতো গেস্ট আসছে

মানুষের রেস্তরাঁয় না আসার পিছনে আর একটি কারণ আছে বলে মনে করছেন মার্কোপোলোর ম্যানেজার ৷ কল্লোলবাবু বলেন, "আমাদের এখানে বার কাম রেস্টুরেন্ট ফেসিলিটি রয়েছে । এই রকম প্রচুর রেস্তরাঁ রয়েছে । কিন্তু এখন আলকোহলিক ড্রিঙ্কস আমরা সার্ভ করতে পারছি না । এটা ব্যবসায়িক দিক থেকে একটা বড় পিছিয়ে যাওয়ার ব্যাপার । আমার মনে হয়, খুব গুরুত্ব সহকারে সরকারের এই বিষয়টা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার সময় এসেছে । এটা চালু করলে কিন্তু সরকারেরও রাজস্ব আদায় হবে । মানুষকে যদি পাড়ার বা স্থানীয় দোকান থেকে কিনে খেতে অনুমতি দেওয়া হয় তো এইখানে আমাদের কী দোষ? এখানে কোন যুক্তিতে এটা হচ্ছে সেটা একটা আলোচনার বিষয়বস্তু ।"

মার্কোপোলোর তথ্য অনুযায়ী, লকডাউনের আগে মোট আয়ের 30-35 শতাংশ আসত অ্যালকোহলিক পানীয় থেকে । পাশাপাশি যাঁরা বার ফেসিলিটি উপভোগ করতেন তার সঙ্গে খাবারও অর্ডার করতেন । তাই অ্যালকোহলিক পানীয়র সঙ্গে খাবারের বিক্রিও বাড়ত । সেটা এখন পুরোপুরি বন্ধ ।

মানুষের তেমন সাড়া না মেলায় তাই কলকাতার বহু রেস্তরাঁ 8 জুন খোলার পরেও বন্ধ হয়ে গেছে । কারণ কাস্টোমারের অভাবে রেস্তরাঁ চালানোর খরচ তুলতে পারছে না তারা ‌। কলকাতায় প্রায় 600 রেস্তরাঁ হোটেল অ্যাসোসিয়েশনের সদ‍স‍্য । অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি সুদেশ পোদ্দার বলেন, " অনেক রেস্টুরেন্ট 8 জুন থেকে খুলেছিল আনলকের পরে । কিন্তু, গ্রাহক খুবই কম ছিল । তাতে AC-র খরচ, কর্মীদের বেতনও উঠছিল না । সেই জন্য অনেক রেস্টুরেন্ট খুলে তারপরে আবার বন্ধ করে দিয়েছে । যেহেতু, বার খোলেনি সেই জন্য এইগুলো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে । বার খুলে দেওয়া হলে গ্রাহকের সংখ্যা আরও বাড়বে । যারা খুলে রেখেছে তাদেরও খুব একটা গ্রাহক আসছে না । হোম ডেলিভারি হোক বা বসে খাওয়া সব মিলিয়ে ব্যবসার অবস্থা খুব একটা ভালো নয় । এই পরিস্থিতিতে মোটামুটি রেস্টুরেন্ট ইন্ডাস্ট্রির সাস্টেনেবিলিটা নেই এখন আর । খুবই বাজে অবস্থা ।"

এই পরিস্থিতিতে ব্যবসা বাঁচিয়ে রাখার একটাই পথ দেখতে পাচ্ছেন রেস্তরাঁর মালিকরা । তা হল, খাদ‍্যের সঙ্গে অ্যালকোহোলিক পানীয় সার্ভ করার ছাড়পত্র । ইতিমধ্যেই হোটেল অ্যাসোসিয়েশনের তরফে অ্যালকোহোলিক পানীয় সার্ভ করার অনুমতির আবেদন চেয়ে রাজ‍্য সরকারকে চিঠি দেওয়া হয়েছে । কিন্তু সেই চিঠির কোনও উত্তর এখনও পর্যন্ত তাঁরা পাননি বলেই জানাচ্ছেন সুদেশবাবু । তিনি বলেন, "গ্রাহকরা এমনিই আসছেন না । তাঁরা ভয় পাচ্ছেন । তার মধ্যে বাইরে না যাওয়ার, বাইরে না খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা । তারও একটা প্রভাব পড়ছে রেস্তরাঁগুলির উপর । সবমিলিয়ে ইন্ডাস্ট্রির উপর প্রভাব পড়ছে । তবে, বার খুললে প্রচুর গ্রাহক আসবে ৷ বিক্রিও বাড়বে ।

কথায় আছে এক যাত্রায় পৃথক ফল । বর্তমান পরিস্থিতিতে শপিং মল ও রেস্তরাঁ ক্ষেত্রে সেই প্রবাদই সত‍্যি প্রমাণ হচ্ছে ৷ ফলে যেখানে ধীরে ধীরে শপিং মলে মানুষের আনাগোনা বাড়ছে তখন মুখ ফ্যাকাসে করেই বসে থাকতে হচ্ছে রেস্তরাঁগুলিকে ৷

ABOUT THE AUTHOR

...view details