ETV Bharat / opinion

বিশ্ব উষ্ণায়ন অবশ্যম্ভাবী, থামবে না প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও; মোকাবিলার পথ শুধুই অভিযোজন

author img

By ETV Bharat Bangla Team

Published : Feb 19, 2024, 9:53 PM IST

Climate change adaptation strategies: বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে ৷ 1 ডিগ্রি থেকে এই বৃদ্ধি এখন 1.5 ডিগ্রিতে পৌঁছেছে ৷ হয়তো এই সীমাও ছাড়িয়ে যাবে ৷ বিশ্ব উষ্ণায়নের মোকাবিলায় মানুষকে অভিযোজনের কৌশল গ্রহণ করতে হবে ৷ পড়ুন সিপি রাজেন্দ্রনের বিশেষ রিপোর্ট ৷

ETV Bharat
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অভিযোজনই সবচেয়ে ভালো পথ

হায়দরাবাদ, 19 ফেব্রুয়ারি: পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে ৷ বিজ্ঞানীরা অনেক দিন ধরেই এবিষয়ে সচেতন করছেন ৷ শিল্পায়নের আগে অর্থাৎ 1850-1900 সাল পর্যন্ত বিশ্বের সব দেশে তাপমাত্রা গড়ে 1 ডিগ্রি করে বৃদ্ধি পেয়েছে ৷ তবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির আর 1 ডিগ্রিতে সীমাবদ্ধ নেই । তাও বেড়ে 1.5 ডিগ্রি হয়েছে ৷ গত 2016, 2017, 2019 এবং 2023 সালে কখনও কখনও 1.5 ডিগ্রি উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে ৷ আন্তর্জাতিক স্তরে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, উষ্ণতা বৃদ্ধি 1.5 ডিগ্রিও ছাড়িয়ে যাবে ৷ আর 2024 সালে তার কিছুটা আভাস পাওয়া যাবে ৷

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, 2050 সালে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাবে ৷ বেঁচে থাকার জন্য আশপাশ কীভাবে ঠান্ডা রাখা যায়, তার উপায় খুঁজে বের করতে হবে মানুষকে ৷ অতিরিক্ত উষ্ণতায় আঞ্চলিক এবং বিভিন্ন ঋতুতে তাপমাত্রা চরম পর্যায়ে পৌঁছবে ৷ তাতে দুই মেরু অঞ্চলের বরফের স্তর আরও কমে যাবে ৷ হিমালয় পর্বতমালাও তার মধ্যে ৷ ঘন ঘন ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হবে ৷ উদ্ভিদ থেকে পশু, মানুষ সবার দৈনন্দিন জীবনে প্রভূত প্রভাব পড়বে ৷

ইতিমধ্যে আমরা ভারত ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ভূমিধস, দাবানল, হড়কাবান, ঘূর্ণিঝড়ের খবর পাচ্ছি ৷ আর এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনা ক্রমশ বেড়ে চলেছে ৷ এতে মানবজীবনের বিশাল ক্ষতি তো হচ্ছেই, পাশাপাশি বিপুল অর্থনৈতিক লোকসানেরও মুখোমুখি হতে হচ্ছে ৷ রাষ্ট্রসংঘের সাম্প্রতিক ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল সতর্ক করেছে, বিশ্ব উষ্ণায়ন শুরু হয়ে গিয়েছে ৷ আগামী শতক, আগামী হাজার বছর পর্যন্ত এই পরিবর্তন, বিশেষত সমুদ্র, হিমবাহ এবং বিশ্বজুড়ে সমুদ্রস্তরে ওঠা-নামা আর বদলানো সম্ভব নয় ৷

তাই বৈজ্ঞানিকরা গবেষণা করে যে সতর্কবাণী দিচ্ছেন তা পরিষ্কার ৷ তাঁদের মতে, গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের হার কমাতে আমরা যা-ই করি না কেন জলবায়ু পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী ৷ তবে আমরা শুধু এর প্রভাবকে কমাতে পারি মাত্র ৷ আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্দিমত্তা ব্যবহার করে নতুন গবেষণাতেও একই তথ্য পাওয়া গিয়েছে ৷ জলবায়ু পরিবর্তন একটা চ্যালেঞ্জ ৷ এর মোকাবিলা করতে সমাজকে অভিযোজনের পথে হাঁটতে হবে ৷ পরিবর্তনকে গ্রহণ করার মানসিকতা দেখাতে হবে ৷

জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় রাষ্ট্রসংঘের 'কনফারেন্স অফ পার্টিস' গঠিত হয়েছে ৷ এখানে অংশগ্রহণকারী দেশগুলি তাপমাত্রা 1.5 ডিগ্রি বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা করতে পারে ৷ কার্বন নির্গমনের ডেডলাইন নিয়ে দেশগুলির মধ্যে বিতর্ক চলছে ৷ এভাবে বিতর্ক চলতে পারলে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা 1.5 ডিগ্রি বৃদ্ধি কেউ আটকাতে পারবে না ৷ এই পরিস্থিতিতে অভিযোজনের কৌশলকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে ৷ কার্বন নির্গমন হ্রাস নিয়ে দীর্ঘ পরিকল্পনার কথা আমরা তাও শুনতে পাই ৷ তবে এই অভিযোজনের কৌশল নিয়ে অনেক কম কথা হয় ৷

সমাজকে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হবে ৷ তেমন একটা সমাজ গড়ে তুলতে হবে ৷ আর এর জন্য জলবায়ু পরিবর্তনে অভিযোজনই সবচেয়ে ভালো পথ ৷ প্যারিস চুক্তিতে অভিযোজন নিয়ে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে ৷ এতে অভিযোজনের ক্ষমতা বৃদ্ধি, সহ্যক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করে তোলা, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িত ক্ষণভঙ্গুরতাকে কমানোর কথা বলা হয়েছে ৷

বিশ্ব উষ্ণায়নে পরিবেশ, সমাজ, জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি-সহ আরও অনেক কিছু উপরেই প্রতিকূল প্রভাব পড়বে ৷ সেই প্রতিকূল প্রভাব হ্রাসে সমাজ নানাভাবে চেষ্টা করতে পারে ৷ জলবায়ু পরিবর্তনে অভিযোজনের কৌশল সেই কাজকর্মগুলি করার কথা বলছে ৷ এই প্রভাবগুলির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বাস্তবসম্মত সমাধান প্রয়োজন ৷ তাতে বিশ্বের প্রতিটি সম্প্রদায়, অঞ্চল, প্রত্যেকটি দেশকে অংশ নিতে হবে ৷ একেকটি জায়গায় জলবায়ু পরিবর্তনে একেক রকম প্রভাব পড়বে ৷ তাই প্রত্যেক গোষ্ঠীকে তাদের বসবাসের এলাকা অনুযায়ী অভিযোজন কৌশল গ্রহণ করতে হবে ৷

এই সমাধান পুনর্ব্যবহারযোগ্য উৎস থেকে শক্তি উৎপাদন থেকে বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধার পর্যন্ত বিশাল বিস্তৃত ৷ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের মোকাবিলায় নতুন প্রযুক্তির বদলে মানুষ প্রকৃতি-নির্ভর সমাধান গ্রহণ করতে পারে ৷ মাঝেমধ্য়েই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ার খবর পাওয়া যায় ৷ এর ফলে সমুদ্রে জলস্ফীতি হয় ৷ আর তার ফলে সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলগুলি ডুবে যায় ৷ বাস্তুতন্ত্রকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হলে তা এই ধরনের ঘটনায় বর্মের মতোই কাজ করবে ৷

কৃষিবিজ্ঞানীরা উল্লেখ করেছেন, জলবায়ুর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কৃষি পদ্ধতি তৈরি করা প্রয়োজন ৷ এর জন্য অ্যাগ্রো-ইকোলজিক্যাল প্রযুক্তির উপর নির্ভর করতে হবে ৷ কম জল, কম সার এবং কম কর্ষণের সাহায্যে চাষ করা দরকার ৷ বিভিন্ন ধরনের বুনো শস্যের বীজ জমিতে ছড়িয়ে দেওয়া অথবা নতুন হাইব্রিড জাতীয় শস্যের উৎপাদনের প্রস্তাব দিয়েছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা ৷ এতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাব বা নতুন কোনও কীটনাশক ব্যবহারে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়, তা থেকে কোনও কৃষককে বাঁচানো যাবে ৷ আবার অনেক সময় একটি মাত্র শস্যের ফলনে নির্ভর করে থাকলে এবং সেই চাষ বন্ধ হলে কৃষককে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় ৷ তবে কৃষি বিজ্ঞানীদের মত, এই সমস্যারও সমাধান মিলবে ৷

বিভিন্ন ধরনের বুনো শস্য অথবা নতুন ধরনের হাইব্রিড বীজ ব্যবহার কোনও একটি ছোট্ট এলাকার আবহাওয়ায় অনেকটাই উপকারী হবে ৷ তবে এই ধরনগুলি নোনা জল, খরা অথবা কীটনাশকে কেমন আচরণ করবে, তা ভালোভাবে পরীক্ষা করে নিতে হবে ৷ এর জন্য স্থানীয়দেরও সচেতন হতে হবে ৷ কার্বন নির্গমন হ্রাসে বিনিয়োগ প্রয়োজন ৷ বিশেষত, সবচেয়ে ক্ষণভঙ্গুর ক্ষেত্রে ৷ আর এর জন্য সমাজ এবং সরকারের মধ্যে সহযোগিতা নিশ্চিত করা অবশ্যপ্রয়োজন ৷ এর মধ্যে গ্রিন টেকনোলজি বা সবুজ প্রযুক্তি কার্যকর করতে হবে, যা বিপুল লাভের প্রতিশ্রুতি দিতে পারে ৷

তবে গরিব-প্রান্তিক শ্রেণির অভিযোজন ক্ষমতা অনেকটাই কম হবে ৷ এই ক্ষমতা বৃদ্ধিতে তাদের দারিদ্র্যতা হ্রাস করে, অর্থনীতি এবং লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণের পাঠ দিতে হবে ৷ পাশাপাশি প্রাকৃতিক বাধাবিঘ্নের সঙ্গে তারা কীভাবে লড়বে, তার জন্য চিরাচরিত ও প্রচলিত জ্ঞান, দৈনন্দিন অভ্যাস সম্পর্কিত জ্ঞান দেওয়া, পড়াশোনার মান উন্নত করা প্রয়োজন ৷ এই ধরনের পদক্ষেপ না করলে সামাজিক পরিবর্তন হওয়া মুশকিল হবে ৷

2023 সালের 5 জুলাই ইউএন ফাউন্ডেশনের একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে ৷ সিওপি21 এবং সিওপি26 এর মধ্যে গ্লোবাল গোল অন অ্যাডাপটেশনে তেমন একটা উন্নতি হয়নি ৷ এই ধরনের বৈঠকের সিরিজের সর্বশেষ বৈঠকে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জগুলির মোকাবিলা করতে বিশ্বের লক্ষ্য নিয়ে আলোচনা করা হয় ৷ গত বছর দুবাইতে সিওপি 28 বৈঠক হয় ৷ সেখানে আমাদের অভিযোজন কৌশলগুলি আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য একটি প্রয়োজনীয় প্ল্যাটফর্মের কথা বলা হয়েছিল ৷

অভিযোজন সংক্রান্ত যে কোনও আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে জলবায়ু নির্ভর অর্থনীতি ৷ দক্ষিণ গোলার্ধের অনুন্নত দেশগুলি দুর্যোগের জন্য আরও কোটি কোটি অর্থ চাইছে ৷ যদিও বর্তমানে 700 মিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতিই দেওয়া হয়েছে ৷ সিওপি28-এ যে অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তা প্রয়োজনের ধারেকাছেও আসে না ৷ আগামী বছরগুলিতে এই ব্যবধানকে দূর করাটাই চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে ৷ কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘমেয়াদে, নিষ্ক্রিয় থাকার খরচ অভিযোজনমূলক পদক্ষেপগুলি করার খরচের চেয়ে অনেক বেশি হবে ৷

আরও পড়ুন:

  1. বায়ুদূষণে এগিয়ে কলকাতায় পর্যাপ্ত দূষণ মাপক যন্ত্রই নেই, বলছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা
  2. জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বের কাছে বড় চ্য়ালেঞ্জ, সামিটে একমত রাষ্ট্রনেতারা
  3. রোগের নাম ‘জলবায়ু পরিবর্তন’, প্রথম আক্রান্ত সত্তরের বৃদ্ধা

হায়দরাবাদ, 19 ফেব্রুয়ারি: পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে ৷ বিজ্ঞানীরা অনেক দিন ধরেই এবিষয়ে সচেতন করছেন ৷ শিল্পায়নের আগে অর্থাৎ 1850-1900 সাল পর্যন্ত বিশ্বের সব দেশে তাপমাত্রা গড়ে 1 ডিগ্রি করে বৃদ্ধি পেয়েছে ৷ তবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির আর 1 ডিগ্রিতে সীমাবদ্ধ নেই । তাও বেড়ে 1.5 ডিগ্রি হয়েছে ৷ গত 2016, 2017, 2019 এবং 2023 সালে কখনও কখনও 1.5 ডিগ্রি উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে ৷ আন্তর্জাতিক স্তরে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, উষ্ণতা বৃদ্ধি 1.5 ডিগ্রিও ছাড়িয়ে যাবে ৷ আর 2024 সালে তার কিছুটা আভাস পাওয়া যাবে ৷

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, 2050 সালে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাবে ৷ বেঁচে থাকার জন্য আশপাশ কীভাবে ঠান্ডা রাখা যায়, তার উপায় খুঁজে বের করতে হবে মানুষকে ৷ অতিরিক্ত উষ্ণতায় আঞ্চলিক এবং বিভিন্ন ঋতুতে তাপমাত্রা চরম পর্যায়ে পৌঁছবে ৷ তাতে দুই মেরু অঞ্চলের বরফের স্তর আরও কমে যাবে ৷ হিমালয় পর্বতমালাও তার মধ্যে ৷ ঘন ঘন ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হবে ৷ উদ্ভিদ থেকে পশু, মানুষ সবার দৈনন্দিন জীবনে প্রভূত প্রভাব পড়বে ৷

ইতিমধ্যে আমরা ভারত ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ভূমিধস, দাবানল, হড়কাবান, ঘূর্ণিঝড়ের খবর পাচ্ছি ৷ আর এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনা ক্রমশ বেড়ে চলেছে ৷ এতে মানবজীবনের বিশাল ক্ষতি তো হচ্ছেই, পাশাপাশি বিপুল অর্থনৈতিক লোকসানেরও মুখোমুখি হতে হচ্ছে ৷ রাষ্ট্রসংঘের সাম্প্রতিক ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল সতর্ক করেছে, বিশ্ব উষ্ণায়ন শুরু হয়ে গিয়েছে ৷ আগামী শতক, আগামী হাজার বছর পর্যন্ত এই পরিবর্তন, বিশেষত সমুদ্র, হিমবাহ এবং বিশ্বজুড়ে সমুদ্রস্তরে ওঠা-নামা আর বদলানো সম্ভব নয় ৷

তাই বৈজ্ঞানিকরা গবেষণা করে যে সতর্কবাণী দিচ্ছেন তা পরিষ্কার ৷ তাঁদের মতে, গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের হার কমাতে আমরা যা-ই করি না কেন জলবায়ু পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী ৷ তবে আমরা শুধু এর প্রভাবকে কমাতে পারি মাত্র ৷ আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্দিমত্তা ব্যবহার করে নতুন গবেষণাতেও একই তথ্য পাওয়া গিয়েছে ৷ জলবায়ু পরিবর্তন একটা চ্যালেঞ্জ ৷ এর মোকাবিলা করতে সমাজকে অভিযোজনের পথে হাঁটতে হবে ৷ পরিবর্তনকে গ্রহণ করার মানসিকতা দেখাতে হবে ৷

জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় রাষ্ট্রসংঘের 'কনফারেন্স অফ পার্টিস' গঠিত হয়েছে ৷ এখানে অংশগ্রহণকারী দেশগুলি তাপমাত্রা 1.5 ডিগ্রি বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা করতে পারে ৷ কার্বন নির্গমনের ডেডলাইন নিয়ে দেশগুলির মধ্যে বিতর্ক চলছে ৷ এভাবে বিতর্ক চলতে পারলে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা 1.5 ডিগ্রি বৃদ্ধি কেউ আটকাতে পারবে না ৷ এই পরিস্থিতিতে অভিযোজনের কৌশলকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে ৷ কার্বন নির্গমন হ্রাস নিয়ে দীর্ঘ পরিকল্পনার কথা আমরা তাও শুনতে পাই ৷ তবে এই অভিযোজনের কৌশল নিয়ে অনেক কম কথা হয় ৷

সমাজকে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হবে ৷ তেমন একটা সমাজ গড়ে তুলতে হবে ৷ আর এর জন্য জলবায়ু পরিবর্তনে অভিযোজনই সবচেয়ে ভালো পথ ৷ প্যারিস চুক্তিতে অভিযোজন নিয়ে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে ৷ এতে অভিযোজনের ক্ষমতা বৃদ্ধি, সহ্যক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করে তোলা, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িত ক্ষণভঙ্গুরতাকে কমানোর কথা বলা হয়েছে ৷

বিশ্ব উষ্ণায়নে পরিবেশ, সমাজ, জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি-সহ আরও অনেক কিছু উপরেই প্রতিকূল প্রভাব পড়বে ৷ সেই প্রতিকূল প্রভাব হ্রাসে সমাজ নানাভাবে চেষ্টা করতে পারে ৷ জলবায়ু পরিবর্তনে অভিযোজনের কৌশল সেই কাজকর্মগুলি করার কথা বলছে ৷ এই প্রভাবগুলির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বাস্তবসম্মত সমাধান প্রয়োজন ৷ তাতে বিশ্বের প্রতিটি সম্প্রদায়, অঞ্চল, প্রত্যেকটি দেশকে অংশ নিতে হবে ৷ একেকটি জায়গায় জলবায়ু পরিবর্তনে একেক রকম প্রভাব পড়বে ৷ তাই প্রত্যেক গোষ্ঠীকে তাদের বসবাসের এলাকা অনুযায়ী অভিযোজন কৌশল গ্রহণ করতে হবে ৷

এই সমাধান পুনর্ব্যবহারযোগ্য উৎস থেকে শক্তি উৎপাদন থেকে বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধার পর্যন্ত বিশাল বিস্তৃত ৷ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের মোকাবিলায় নতুন প্রযুক্তির বদলে মানুষ প্রকৃতি-নির্ভর সমাধান গ্রহণ করতে পারে ৷ মাঝেমধ্য়েই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ার খবর পাওয়া যায় ৷ এর ফলে সমুদ্রে জলস্ফীতি হয় ৷ আর তার ফলে সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলগুলি ডুবে যায় ৷ বাস্তুতন্ত্রকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হলে তা এই ধরনের ঘটনায় বর্মের মতোই কাজ করবে ৷

কৃষিবিজ্ঞানীরা উল্লেখ করেছেন, জলবায়ুর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কৃষি পদ্ধতি তৈরি করা প্রয়োজন ৷ এর জন্য অ্যাগ্রো-ইকোলজিক্যাল প্রযুক্তির উপর নির্ভর করতে হবে ৷ কম জল, কম সার এবং কম কর্ষণের সাহায্যে চাষ করা দরকার ৷ বিভিন্ন ধরনের বুনো শস্যের বীজ জমিতে ছড়িয়ে দেওয়া অথবা নতুন হাইব্রিড জাতীয় শস্যের উৎপাদনের প্রস্তাব দিয়েছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা ৷ এতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাব বা নতুন কোনও কীটনাশক ব্যবহারে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়, তা থেকে কোনও কৃষককে বাঁচানো যাবে ৷ আবার অনেক সময় একটি মাত্র শস্যের ফলনে নির্ভর করে থাকলে এবং সেই চাষ বন্ধ হলে কৃষককে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় ৷ তবে কৃষি বিজ্ঞানীদের মত, এই সমস্যারও সমাধান মিলবে ৷

বিভিন্ন ধরনের বুনো শস্য অথবা নতুন ধরনের হাইব্রিড বীজ ব্যবহার কোনও একটি ছোট্ট এলাকার আবহাওয়ায় অনেকটাই উপকারী হবে ৷ তবে এই ধরনগুলি নোনা জল, খরা অথবা কীটনাশকে কেমন আচরণ করবে, তা ভালোভাবে পরীক্ষা করে নিতে হবে ৷ এর জন্য স্থানীয়দেরও সচেতন হতে হবে ৷ কার্বন নির্গমন হ্রাসে বিনিয়োগ প্রয়োজন ৷ বিশেষত, সবচেয়ে ক্ষণভঙ্গুর ক্ষেত্রে ৷ আর এর জন্য সমাজ এবং সরকারের মধ্যে সহযোগিতা নিশ্চিত করা অবশ্যপ্রয়োজন ৷ এর মধ্যে গ্রিন টেকনোলজি বা সবুজ প্রযুক্তি কার্যকর করতে হবে, যা বিপুল লাভের প্রতিশ্রুতি দিতে পারে ৷

তবে গরিব-প্রান্তিক শ্রেণির অভিযোজন ক্ষমতা অনেকটাই কম হবে ৷ এই ক্ষমতা বৃদ্ধিতে তাদের দারিদ্র্যতা হ্রাস করে, অর্থনীতি এবং লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণের পাঠ দিতে হবে ৷ পাশাপাশি প্রাকৃতিক বাধাবিঘ্নের সঙ্গে তারা কীভাবে লড়বে, তার জন্য চিরাচরিত ও প্রচলিত জ্ঞান, দৈনন্দিন অভ্যাস সম্পর্কিত জ্ঞান দেওয়া, পড়াশোনার মান উন্নত করা প্রয়োজন ৷ এই ধরনের পদক্ষেপ না করলে সামাজিক পরিবর্তন হওয়া মুশকিল হবে ৷

2023 সালের 5 জুলাই ইউএন ফাউন্ডেশনের একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে ৷ সিওপি21 এবং সিওপি26 এর মধ্যে গ্লোবাল গোল অন অ্যাডাপটেশনে তেমন একটা উন্নতি হয়নি ৷ এই ধরনের বৈঠকের সিরিজের সর্বশেষ বৈঠকে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জগুলির মোকাবিলা করতে বিশ্বের লক্ষ্য নিয়ে আলোচনা করা হয় ৷ গত বছর দুবাইতে সিওপি 28 বৈঠক হয় ৷ সেখানে আমাদের অভিযোজন কৌশলগুলি আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য একটি প্রয়োজনীয় প্ল্যাটফর্মের কথা বলা হয়েছিল ৷

অভিযোজন সংক্রান্ত যে কোনও আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে জলবায়ু নির্ভর অর্থনীতি ৷ দক্ষিণ গোলার্ধের অনুন্নত দেশগুলি দুর্যোগের জন্য আরও কোটি কোটি অর্থ চাইছে ৷ যদিও বর্তমানে 700 মিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতিই দেওয়া হয়েছে ৷ সিওপি28-এ যে অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তা প্রয়োজনের ধারেকাছেও আসে না ৷ আগামী বছরগুলিতে এই ব্যবধানকে দূর করাটাই চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে ৷ কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘমেয়াদে, নিষ্ক্রিয় থাকার খরচ অভিযোজনমূলক পদক্ষেপগুলি করার খরচের চেয়ে অনেক বেশি হবে ৷

আরও পড়ুন:

  1. বায়ুদূষণে এগিয়ে কলকাতায় পর্যাপ্ত দূষণ মাপক যন্ত্রই নেই, বলছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা
  2. জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বের কাছে বড় চ্য়ালেঞ্জ, সামিটে একমত রাষ্ট্রনেতারা
  3. রোগের নাম ‘জলবায়ু পরিবর্তন’, প্রথম আক্রান্ত সত্তরের বৃদ্ধা
ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.