হায়দরাবাদ, 9 এপ্রিল: সদ্য রিয়েলিটি শো ইন্ডিয়ান আইডল 15-এর ট্রফি জিতে বাড়ি ফিরেছেন বাংলার মেয়ে মানসী ঘোষ ৷ 20 বছর পর এই রিয়েলিটি শোয়ে বাংলা এনেছে জয়ের ট্রফি ৷ কেমন ছিল জার্নি, শুরু কীভাবে হয়েছে, আগামীর পরিকল্পনা নানা বিষয় নিয়ে ইটিভি ভারতের সঙ্গে কথা বললেন মানসী ৷
ট্রফি জেতার অনুভূতি
চলতি বছর ইন্ডিয়ান আইডলের মঞ্চে ফাইনাল ছয়জন প্রতিযোগীর মধ্যে তিনজনই ছিলেন বাংলার ৷ খড়গপুরের শুভজিৎ চক্রবর্তী প্রথম রানার আপ হয়েছেন , চতুর্থ হয়েছেন প্রিয়াংশু দত্ত ৷ সেরার সেরা শিরোপা জিতেছেন বেলঘড়িয়া, নিমতার মেয়ে মানসী ৷ জেতা প্রসঙ্গে শিল্পী বলেন, "ভীষণ আনন্দ হচ্ছে ৷ আমি জিতেছি, এই ভাবনার থেকেও বেশি ভালো লাগছে, 20 বছর পর প্রথমবার ইন্ডিয়ান আইডল থেকে বাংলায় ট্রফি এসেছে ৷"
রিয়েলিটি মঞ্চে যখন বিজেতা হিসাবে মানসীর নাম ঘোষণা করা হয় তখন কিছুটা নাকি ঘোরের মধ্যেই ছিলেন ৷ মানসী বলেন, "প্রথমে ভাবতেই পারছিলাম না আমি জিতেছি ৷ সদ্য জেতার পরে বেশ কিছুদিন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না ৷ ইমোশন ছিল, জিতেছি, ঠিক আছে ৷ কিন্তু কলকাতায় ফেরার পর জেতার সেই আনন্দ অনুভব করতে পারছি ৷ মানুষের এত ভালোবাসা চোখের সামনে থেকে দেখতে পাচ্ছি, এবার আমার আনন্দ হচ্ছে ৷ আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ সকলের কাছে যাঁরা আমার পাশে ছিলেন ৷"
ছোট্ট বয়সেই শুরু সারেগামা সফর
মাত্র 4 বছর বয়স থেকে গান ভাঁজতে শুরু করেন মানসী ৷ বাঙালি পরিবারে যেমন হয় আর কি ৷ বাবা-মা পড়াশোনার পাশাপাশি গান শেখানোর স্কুলে ভর্তি করে দেন ৷ মানসী বলেন, "আমি যখন গান শুরু করি তখন বুঝতামই না কিছু ৷ হারমোনিয়ামের রিড বাজিয়ে সারেগামা করে গাইতাম ৷ কখনও কখনও বাবা-মা সাহায্য় করত ৷ প্রফেশনালি গাইব এমন ভেবে বাড়ির লোক গান শেখাননি ৷ তবে যাতে ভালোভাবে গান গাই সে কারণে বাবা-মা বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতেন ৷ টুকটাক ফাংশনও করতাম ৷ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গানটাকে সিরিয়াসভাবে নিতে শুরু করি ৷" শিল্পীর কথায়, "আমি যখন ক্লাস নাইন বা টেনে পড়ি তখন গান নিয়ে এগোব, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি ৷ বুঝতে পারি, গানটাই আমার প্যাশন ৷ ওটাই প্রফেশন করতে হবে ৷ আসলে মনে হয়, আমার জন্ম হয়েছে মিউজিকের জন্যই ৷"
গুরুদের তালিম
আমার গানের হাতেখড়ি সঙ্গীতশিল্পী পাপিয়া সমাদ্দারের কাছ থেকে ৷ শিবানী ম্যাম বলে একজন ছিলেন, ওনার কাছে আধুনিক গান শিখতাম ৷ সৌরভ ঘোষালের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিয়েছি ৷ তারপরেই আচার্য জয়ন্ত ঘোষের কাছে ইন্ডিয়ান ক্লাসিক্যাল শেখা শুরু করি ৷ এই মুহূর্তে জয়ন্ত সরকারের ছেলে সীমন্ত সরকার (জোজো দা) আমার গুরু ৷ আমি ললিত কলার ছাত্রী ৷
পড়াশোনা-গানের চ্যালেঞ্জ
আর্থিকভাবে চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে ৷ গানের সঙ্গে পড়াশোনা সমান তালে চালিয়ে যাওয়া,সেটা চ্যালেঞ্জ না হলেও যদি পরিবার ও শিক্ষকরা যদি পাশে না থাকতেন তাহলে সম্ভব হত না ৷ দমদমের খ্রিস্ট চার্চ গার্লস হাইস্কুলে পড়াশোনা ৷ সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে ইংরেজিতে স্নাতক করেছি ৷ স্কুল থেকে কলেজ, দু'জায়গাতেই বন্ধু মহলে গানের জন্য বেশ পপুলার ছিলাম ৷ ফলে রিয়েলিটি শোয়ে ভোটিংয়ের দিক থেকে বড় সাপোর্ট পেয়েছি সকলের ৷
শানের সঙ্গে গান রেকর্ডিং
ইন্ডিয়ান আইডল খেতার জেতার আগেই বলিউডে পা রেখে ফেলেছেন মানসী ৷ ইতিমধ্যেই গায়ক শানের সঙ্গে রেকর্ড করে ফেলেছেন আপকামিং সিনেমার গান ৷ মানসী জানান, "স্যারের সঙ্গে গান গাওয়ার সুযোগ পাই রিয়েলিটি শোয়ের মঞ্চ থেকেই ৷ স্বনামধন্য যতীন-ললিত ডুয়োর কথা সকলেই জানেন ৷ রিয়েলিটি শোয়ে একদিন ললিত পণ্ডিত এসেছিলেন অতিথি বিচারক হিসাবে ৷ শো শুরু হওয়ার আগেই উনি বলেছিলেন, তাঁর কাছে একটা গান আছে ৷ তিনি নিউ ভয়েস চাইছেন ৷ সেদিন সকল প্রতিযোগীদের মধ্যে যাঁর গান ভালোলাগবে তাঁকে গানের সুযোগ দেবেন ৷ আমি ভাবিইনি ৷ আমি আমার মতো পারফর্ম্যান্স করে বসে আছি ৷ এপিসোড শেষে যখন নাম ঘোষণা করল আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম ৷"
শিল্পীর কথায়, "তারপরের দিনই আমি গান রেকর্ড করতে যাই ৷ গানটা খুবই ভালো লাগে ৷ ললিত স্যার নিজে বসে থেকে গান রেকর্ড করিয়েছেন ৷ শুনছিলেন ৷ উনিও খুব উপভোগ করছিলেন ৷ পাশাপাশি কিছু কিছু জিনিস দেখালেন-বোঝালেন ৷ আমি এই গান রেকর্ড করে সত্যিই খুব আনন্দ পেয়েছি ৷ মন্নু ক্যায়া করেগা সিনেমার টাইটেল ট্র্যাক ছিল এটা ৷ সঞ্জয় ত্রিপাঠী ছবির পরিচালক ৷"
স্ক্রিপ্টেড হয় কি রিয়েলিটি শো ?
অনেক সময় রিয়েলিটি শো নিয়ে নানা বিতর্ক হয় ৷ অভিযোগ ওঠে বিজেতা কে হবে, শোয়ে কে কীভাবে বলবে তা সবকিছু আগে থেকেই লেখা থাকে ৷ ইন্ডিয়ান আইডলের মঞ্চে তেমন কিছু ছিল না বলে জানান মানসী ৷ তিনি বলেন, "কোনও কিছুই স্ক্রিপ্টেড হয় না ৷ হেমা মালিনী একটা ছবি দেখে অনেকেই বলতে শুরু করেন শোয়ের সবকিছু আগে থেকে লেখা ৷ তবে সেই ছবি যদি জুম করে কেউ দেখতেন তাহলে বুঝতেন, সেখানে লেখা ছিল মথুরা নিয়ে কিছু বলার কথা ৷ আসলে তিনি হোলি স্পেশাল এপিসোডে এসেছিলেন এবং কৃষ্ণ ঠাকুর নিয়ে কিছু কথা বলেছিলেন ৷ এক্ষেত্রে ওনাকে কি কি বিষয় নিয়ে কথা বলতে হবে সেটা লেখা ছিল ৷ এমনকী, তিনি শোয়ে প্রথমবার এসেছেন , যদি কোনও প্রতিযোগীর নাম ভুলে যান, সেটা লিখে দেওয়া হত ৷ এটাকে কী করে স্ক্রিপ্টেড বলা যায় ?"
মানসীর কথায়, "যদি কেউ বলেন, ইন্ডিয়ান আইডলের মতো গোটা শো কেউ কোনও চিত্রনাট্য বা স্ক্রিপ্ট না ভেবে করবে, শো প্ল্যান না করে একটা এপিসোড করতে বসে গেল তাহলে দুদিনেও শোয়ের শুট শেষ হবে না ৷ কোনটার পর কোনটা কী হবে সেটা প্ল্যান করতেই হয় ৷ কিন্তু বিচারকের মন্তব্য, গানের ধরন, ভোটিং এইসব কোনটাই স্ক্রিপ্টেড নয় ৷ ওখানে বলাই ছিল, প্রতিযোগীর গান করবেন তারপর যে সব থেকে কম ভোট পাবেন সে বাদ যাবেন ৷ সেক্ষেত্রে এটা ভেরি ক্লিয়ার স্ক্রিপ্ট, মানে স্বচ্ছ প্রসেস ৷ আমাদের ওয়ান টেকে গাইতে হত ৷ অনেকবার এমন হয়েছে, কেউ গান ভুলে গেছেন, গান গাইতে গিয়ে কেশে ফেলেছে ৷ সেখানে কিনন্তু কোনও কাট হয়নি ৷ ওই ভাবেই গান গেয়ে যেতে হয়েছে ৷ তাতে মার্কসও কমেছে ৷ বিষয়গুলো টেলিকাস্টও ওইভাবেই হয়েছে ৷ পোস্ট রেকর্ড বা সেকেন্ড টেক নেওয়া তেমন কিছু করার সুযোগ ছিল না ৷ গানেরও কোনও স্ক্রিপ্ট নেই, বিচারকদের মন্তব্যেরও কোনও স্ক্রিপ্ট থাকত না ৷"
বিচারক হিসাবে কেমন শ্রেয়া ঘোষাল, বাদশা, বিশাল দদলানি ...
বিশাল স্যার ভীষণ স্ট্রেট ফরোয়ার্ড ৷ ওনার যেটা ভালো লাগে মুখের ওপর বলে দেয় ৷ খারাপটাও একই ভাবে বলেন ৷ ভীষণ টেকনিক্যাল তিনি ৷ শ্রেয়া ম্যাম গানের সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম জিনিস খেয়াল করতেন ৷ বাহবা যেমন দিতেন তেমনই কোথাও ভুল হলে সেটাও বলতেন ৷ বাদশা স্যার ছিলেন হার্ট অফ দ্য শো ৷ যে কোনও টেকনিক্যাল বিষয়ের বাইরে গিয়ে সব গানের একটা হার্ট হয়, সেটা স্যার খুব ভালো নোটিস করতেন ৷ গায়কিভাব কী, কেমন বাদশা স্যার খুব ভালো বোঝাতেন ৷ তিনজন তিন রকমের ছিলেন ৷ অনেক কিছু শিখতে পেরেছি তাঁদের কাছ থেকে ৷ দারুণ অভিজ্ঞতা ৷
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
হিন্দি গান আগেই গেয়েছেন ৷ বাংলাতেও গান আনার পরিকল্পনা করে ফেলেছেন মানসী ৷ তিনি জানান, "নিজের একটা সিঙ্গল বের করব ৷ কাজ চলছে ৷ খুব শীঘ্রই মুক্তি পাবে ৷ বাংলা গানটা আমি কম্পোজ করেছি ৷ বাদশা স্যার ফাইনালের দিন আমাকে বলেছিলেন, আমার সঙ্গে একটা গান রেকর্ড করার ইচ্ছা রয়েছে ৷ ফিঙ্গার ক্রস, দেখা যাক, কবে হয়.. ৷ লাইভ শো করব ৷ পাশাপাশি আরও গান শেখারও ইচ্ছা রয়েছে ৷ অবশ্যই সিনেমায় প্লে-ব্যাক করতে চাই ৷" পাশাপাশি মানসী জানিয়েছেন, এ আর রহমান, বিশাল দদলানি, প্রীতম, অমিত ত্রিবেদী এনাদের সঙ্গে কাজ করার জন্য মুখিয়ে রয়েছেন ৷ পাশাপাশি বাংলায় অনুপম রায়ের সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছা আছে বলেন জানান মানসী ৷
মানসী একান্ত সাক্ষাৎকারে জানান, তিনি নতুন-পুরনো সব রকমের গান পছন্দ করেন ৷ যে গান মন ভালো করে দেয়, উপভোগ করা যায় সেই সব গান তাঁর পছন্দের ৷ লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে থেকে শ্রেয়া ঘোষাল, সুনীধি চৌহান, মহম্মদ রফি, সনু নিগম, অরিজিৎ সিংয়ের গান যেমন ভালোবাসেন তেমনি পাশ্চাত্য মিউজিকে শাকিরা থেকে ডোজা ক্যাটের গান শুনতে পছন্দ করেন ৷
আনন্দ উদযাপন- প্রিয় খাবার
জেতার পর বাড়িতে আত্মীয়, পাড়া-প্রতিবেশীর আনাগোনা লেগেই আছে ৷ চলছে গেট টুগেদার ৷ বাবা-মা আলাদাভাবে স্পেশাল অ্যারেঞ্জমেন্ট করে চমকে দেন মানসীকে ৷ তিনি বলেন, "জিতে ফেরার পর আমাকে চমকে দিয়ে বাবা-মা জিপে তুলে গান-বাজনা বাজিয়ে নিমতা থেকে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন ৷ চাইনিজ থেকে কন্টিনেন্টাল সব রকমের খাবার পছন্দ ৷ তবে মায়ের হাতের যে কোনও রান্না ভীষণ প্রিয়, বিশেষ করে মাটন কষা ৷" গান গাওয়ার পাশাপাশি মানসীর অবসর কাটে রান্না করে, গার্ডেনিং করে ও আঁকাআকি করে ৷