কলকাতা, 16 মার্চ: কলকাতা দক্ষিণ লোকসভা আসন আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কার্যত সমার্থক ৷ বামেদের রমরমা সময়ে 1991 সালে এই কেন্দ্রে প্রথম জেতেন তিনি ৷ হারিয়েছিলেন সিপিআই-এর বিপ্লব দাশগুপ্তকে ৷ তখন তিনি কংগ্রেসের নেত্রী ৷ তার পর এই কেন্দ্রে তাঁকে কেউ হারাতে পারেননি ৷
মমতা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর সাংসদ হিসেবে পদত্যাগ করেন ৷ তখন উপ-নির্বাচনে জিতে ওই কেন্দ্রে সাংসদ হন সুব্রত বক্সি ৷ 2019 সাল পর্যন্ত তিনিই ছিলেন কলকাতা দক্ষিণের সাংসদ ৷ পাঁচ বছর আগের লোকসভা নির্বাচনে এই আসন থেকে জিতে সাংসদ হন মালা রায় ৷ এবারও তিনি সেখানে প্রার্থী ৷
স্বাভাবিকভাবেই তাই তাঁর পাঁচ বছরের কাজের খতিয়ান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে ৷ সাংসদ অবশ্য জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর কোনও আক্ষেপ নেই ৷ তিনি বাংলার কথা, বাংলার বঞ্চনার কথা বারবার তুলে ধরেছেন ৷ লোকসভায় দু’শোরও বেশি প্রশ্ন করেছেন তিনি ৷ পাশাপাশি প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রয়োজনীয় উন্নয়নের জন্য এমপি ল্যাডের টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে ৷
একনজরে দেখে নেওয়া যাক যে কলকাতা দক্ষিণে কী কী কাজ করেছেন মালা রায়-
- 1 কোটি 10 লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে রাজ্য সরকারকে কোভিডের টিকা কেনার জন্য ।
- 50 লক্ষ টাকার বেশি দেওয়া হয়েছে এসএসকেএম হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে আধুনিক যন্ত্র কেনা ও পরিষেবার উন্নতির জন্য ৷
- আলিপুর চিড়িযাখানায় পরিবেশবান্ধব যান দেওয়া হয়েছে ।
- কলকাতা পৌরনিগম অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবার উন্নতি করতে একাধিক অ্যাম্বুলেন্স দেওয়া হয়েছে ৷ শববাহী গাড়িও দেওয়া হয়েছে ৷
- পথ কুকুরদের জন্য বিশেষ গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্স দেওয়া হয়েছে ৷
- একাধিক রাস্তা তৈরি ও মেরামতের কাজ হয়েছে ৷
- বিভিন্ন জায়গায় হাইমাস্ক আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে ৷
- একেসি বসু কলেজে স্মার্ট লাইব্রেরি তৈরিতে সাহায্য করা হয়েছে ৷
- একাধিক স্কুলের সংস্কার কাজে অর্থ সাহায্য করা হয়েছে ।
মালা রায় যেমন কলকাতা দক্ষিণের সাংসদ, তেমন তিনি কলকাতা পৌরনিগমের কাউন্সিলর । ফলে মানুষের কথা যেমন দিল্লির সংসদে তুলে ধরেছেন, তেমনই চেষ্টা করেছেন কাউন্সিলর হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করার । তিনি বলেন, ‘‘কাজ করাটাই শেষ কথা । জনপ্রতিনিধি যিনি তাঁর সব কাজ ছেড়ে মানুষের কাজ করা দরকার ।’’ মালা রায়ের দাবি, তাঁকে দিনে হোক বা রাতে সবসময় সকলে পান । গভীর রাতে ফোন করলেও ফোন তোলেন । কাউকেই তিনি ফেরান না বলেই দাবি তার । কারণ, ছোট ছোট সমস্যা নিয়ে তাঁর কাছে মানুষ আসেন । প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি সাধ্যমতো চেষ্টা করেন ৷
কলকাতা দক্ষিণ বরাবরই হাইপ্রোফাইল কেন্দ্র ৷ এই কেন্দ্রে সাধারণ মানুষ যেমন ভোটার, তেমনই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অনেক হাইপ্রোফাইল ভোটার রয়েছেন ৷ ফলে সাংসদের কাজ নিয়ে এলাকার মানুষের বক্তব্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ ৷
এলাকার বাসিন্দা চঞ্চল চট্টোপাধ্যায় জানান, সাংসদ অনেক কাজ করেছেন ৷ জলের সমস্যা ছিল৷ সেই সময় অনেকটা মিটেছে ৷ সাংসদ আগামিদিনেও কাজ করবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন ৷ এলাকার আরেক বাসিন্দা রবি প্রামাণিক জানান, সাংসদ খুব ভালো কাজ করেছেন ৷ সমস্যার কথা জানালে তার সমাধান করে দেওয়া হয় ৷
বিরোধীদের অবশ্য দাবি, উন্নয়ন যা উনি বলছেন, বাস্তবে চোখে দেখা যায় না । উনি কোনও নির্দিষ্ট এলাকা ভিত্তিক বসেন না যে কোনও প্রয়োজনে মানুষ তাঁর সঙ্গে দ্রুত দেখা করতে পারবেন । বিশেষ করে কসবা, বালিগঞ্জ, বন্দর - এই সমস্ত বিধানসভায় সেই অর্থে তিনি কিছুই করেননি । তাঁর দেখাও তেমন মেলে না ।
তাহলে এবারও কি কলকাতা দক্ষিণ লোকসভা কেন্দ্র থেকে জিতবেন মালা রায় ? মানুষের হাতে রায় দেওয়ার ভার ছেড়েও আশাবাদী এই তৃণমূল সাংসদ ৷ তাঁর কথায়, ‘‘সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি মিলে জোট করছে তৃণমূলকে চাপে ফেলতে । অনেক রকম ভাবে দল, ব্যক্তি বিশেষে ছোট করবে । মানুষের এতে কিছু আসে যায় না । মানুষ ঠিক জানেন কী কাজ করেছি, কাকে ভোট দেবেন । আমরা আশাবাদী ।’’
তবে এই কেন্দ্রের অতীতের দিকে যদি একবার আলোকপাত করা যায়, তাহলে দেখা যাবে এই কেন্দ্রের নাম যেমন বারবার বদল হয়েছে ৷ তেমনই সাংসদও বদল হয়েছে বহুবার ৷ 1952 সালে এই কেন্দ্র থেকে জিতেছিলেন ভারতীয় জনসঙ্ঘের শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্য়ায় ৷ সেই সময় এই কেন্দ্রের নাম ছিল ক্যালকাটা সাউথ-ইস্ট ৷
এর পর কেন্দ্রের নাম বদলে ক্যালকাটা ইস্ট হয়েছে ৷ পরে তা হয়েছে ক্যালকাটা সাউথ ৷ নাম বদলের সঙ্গে সাজুয্য রেখে কখনও এখান থেকে জিতেছে সিপিআই ৷ কখনও কংগ্রেস জিতেছে৷ আবার জনতা পার্টির প্রার্থীকে এই কেন্দ্র থেকে জিতেয়েছেন এলাকার ভোটাররা ৷ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় ছাড়া প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, সত্যসাধন চক্রবর্তীর মতো হেভিওয়েটরা এখানে জিতেছেন ৷
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগে এই কেন্দ্র থেকে একই সাংসদের পর পর দু’বার জয়ের নজির ছিল না ৷ এখানে সবচেয়ে বেশি সময়ের সাংসদ ছিলেন রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী ৷ দু’বার তিনি জিতেছেন কংগ্রেসের টিকিটে ৷ তিনবার চারবার জিতেছেন তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে ৷ সেই সময় থেকেই এই এলাকা মমতার গড় নামেই পরিচিত হয়েছে ৷ এখনও সেই তকমায় ধুলো যে পড়েনি, তা বিভিন্ন সময় ভোটের ফল দেখলেই বোঝা যায় ৷
ফলে সেই ট্রেন্ড কি এবারও বজায় থাকবে ? নাকি বিরোধীরা যে কাজ না হওয়ার অভিযোগ তুলছেন, সেটার উপর ভর করে রাজনৈতিক পরিবর্তন হবে কলকাতা দক্ষিণ লোকসভা আসনে !
আরও পড়ুন: