ETV Bharat / opinion

লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগের ফসল সংবিধান রক্ষাই আসল চ্যালেঞ্জ

author img

By ETV Bharat Bangla Team

Published : Jan 25, 2024, 7:24 PM IST

Updated : Jan 25, 2024, 8:23 PM IST

75 Years of the Republic of India: শুক্রবার 75তম সাধারণতন্ত্র দিবস ৷ ভারতের সাধারণতন্ত্রের 75 বছর পূর্ণ হচ্ছে এবার এই প্রেক্ষাপটে ফিরে দেখা ভারতের সংবিধান রচনা ৷ সংবিধানে দেশের মানুষের অধিকার রক্ষায় কী কী ব্যবস্থা রাখা হয় এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে সংবিধান মেনে কাজ কতটা হচ্ছে ৷ লিখেছেন ড. অনন্ত এস ৷

75 Years of the Republic of India
75 Years of the Republic of India

কলকাতা, 25 জানুয়ারি: ভারতের সংবিধানের এবার 75 বছর । আমাদের সংবিধান 1947 সালের আগে 100 বছরেরও বেশি সময় ধরে বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগের ফসল । ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিতকে নাড়িয়ে দেওয়ার মতো সংগঠিত প্রতিরোধ জাতীয় আন্দোলনের গান্ধিবাদী পর্ব দিয়ে যা শুরু হয়েছিল ।

এখন হয়তো গান্ধিজির সমালোচনা করা সহজ ৷ কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে সত্যিকারের একটি গণ-আন্দোলনে পরিণত করা ৷ 1885 থেকে 1919 সাল পর্যন্ত যেভাবে লড়াই হয়েছিল, এই গণ-আন্দোলন একেবারে তার বিপরীতধর্মী ছিল ৷ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যত মানুষ অংশ নিয়েছিলেন, আজ যেকোনও আন্দোলনে ভারতীয়দের যোগদানের হারের নিরিখে সেটাই সর্বোচ্চ ৷

সংবিধানের খসড়া তৈরির সময় দেশের নেতাদের বিভিন্ন বিষয়ে নজর দিতে হয়েছিল ৷ তার মধ্যে ছিল - ভারতীয়দের শোষণ ও আধিপত্য থেকে মুক্ত করার জন্য জাতীয় আন্দোলনের প্রতিশ্রুতি পূরণ করা, ভারতীয়দের আকাঙ্ক্ষার ভারসাম্য বজায় রাখা ৷ বিশেষ করে ভারতের যা আয়তন আর এই দেশের যা বৈচিত্র, তার প্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক রূপান্তরের আগে এমন কোনও চেষ্টা করা হয়নি ৷ তাছাড়া বিশাল অংশের মানুষ শিক্ষিত ছিল না ৷ অধিকাংশের তিনবেলা খাবারও জুটত না ৷ তাই খেয়াল রাখতে হয়েছে যে সংবিধান যেন সব শ্রেণির মানুষকে সমানাধিক দেয় ৷

সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্বে ছিল গণপরিষদের ৷ 1946 সালের ডিসেম্বর থেকে 1949 সালের ডিসেম্বর গণপরিষদে সংবিধান তৈরি করা হয় ৷ 1950 সালের 26 জানুয়ারি ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে একটি সাধারণতন্ত্রে পরিণত হয় । যদিও এটি সেভাবে প্রশংসিত হয় না, তবে সাধারণতন্ত্রের একক বৃহত্তম অবদান হল যে এটি দেশভাগ, হিংসা, অর্থনৈতিক দুরাবস্থা, শিক্ষার নিম্নস্তর, তিনটি যুদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও একটি জাতি হিসাবে দেশকে এক জায়গায় আনতে সফল হয়েছে । আরও গুরুত্বপূর্ণভাবে সামাজিক গোষ্ঠীর বৈচিত্র্যকেও এক করতে সমর্থ হয়েছে সাধারণতন্ত্র ৷ 1947 সালের আগে কখনও এই পরিস্থিতি ছিল না ।

উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে যে 565টি প্রিন্সলে স্টেট, যা ভারতের 40 শতাংশ জায়গা জুড়ে ছিল এবং দেশের 23 শতাংশ জনসংখ্যা সমৃদ্ধ ছিল ৷ তাছাড়া পর্তুগাল ও ফ্রান্সের অধীনে থাকা অঞ্চলগুলি স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে নতুন দেশে অন্তর্ভুক্ত হয় ৷

ইদানীং সংবিধানের সমালোচনা ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে ৷ কারও কারও মতে, সংবিধান অনেক পুরনো ও দেশের প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন্য যথেষ্ট নয় ৷ তাই এটা নতুন করে লেখার দাবিও উঠতে শুরু করেছে ৷ যাকে উদ্বেগজনক প্রবণতা বলাই যেতে পারে ৷ যদিও এই দাবি খুবই হাস্যকর ৷ কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধানের বয়স 200 বছর ৷ জাপান বা ইউরোপের দেশগুলিতে ভারতের চেয়ে পুরনো বা একই সময়ের সংবিধান রয়েছে ৷

অথচ যে দেশগুলি 1940 থেকে 1970 এর দশকে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীন হয়েছিল, তাদের ভারতই একমাত্র দেশ যেটি মূলত গণতান্ত্রিক থাকতে পেরেছে (অল্প সময়ের জরুরি অবস্থা ছাড়া) । অন্য সব দেশ দীর্ঘ সময় একনায়কতন্ত্রের মধ্যে পড়েছে । আমাদের প্রতিবেশীরা এমন সমাজের ভালো উদাহরণ, যা দীর্ঘ সময়ের স্বৈরাচারী শাসন প্রত্যক্ষ করেছে ৷ ভারতীয়দের এই সত্যের জন্য গর্বিত হওয়া দরকার ৷ আর বলা যেতে পারে যে এটি মূলত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আমাদের জাতীয় আন্দোলন এবং স্বাধীনতার পরে সংবিধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে হয়েছে ।

কঠিন কাজ এবং প্রধান বৈশিষ্ট্য: সংবিধানের খসড়া তৈরি করা কার্যত ‘হারকিউলান টাস্ক’ ছিল ৷ মূল গণপরিষদ মোট 389 জন সদস্য নিয়ে গঠিত ছিল ৷ এর মধ্যে 292 জন ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের, 93 জন রাজ্যের এবং চারজন দিল্লি, আজমির-মেরওয়ার, কুর্গ ও ব্রিটিশ বালুচিস্তান প্রদেশ থেকে । দেশভাগের পর সংখ্যাটি পরে 299-এ নেমে আসে । সংবিধান প্রণয়নের কাজ 165 দিনের মেয়াদে 11টি অধিবেশনে 2 বছর, 11 মাস ও 18 দিন সময় ধরে হয়েছিল ৷

এই অত্যন্ত কঠিন কাজটি ড. বিআর আম্বেদকরের নেতৃত্বে খসড়া কমিটি যে করেছিল, তাতে তাঁদের জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয় ৷ খসড়া তৈরির সময় 22টি উপ-কমিটিও তৈরি হয় ৷ এর মধ্যে 8টি ছিল মৌলিক অধিকার, প্রদেশ, অর্থ, নিয়ম ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের জন্য তৈরি হয়েছিল ৷ তাদের মতামত খসড়া কমিটি একসুতো গাঁথে ৷ তার পর তা গণপরিষদে পেশ করা হয় ৷ তা পেশ করার পর আলোচনা হয় এবং শেষে তা গৃহীত হয় ৷

গণপরিষদে এই নিয়ে যে বিতর্ক-আলোচনা হয়, তা খুঁটিয়ে দেখলেই বোঝা যায় যে সংবিধান রচনা কতটা কঠিন কাজ ছিল ৷ বিশেষ করে সংবিধানের বাক্য ও ব্যকরণ যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছেও বোধগম্য হয়, সেই বিষয়টিও বিতর্কে উঠে আসে ৷ তবে সংবিধানের আসল সাফল্য হল, এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্যরা জানতেন যে সংবিধানকে এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেখানে সর্বস্তরের লক্ষ্য, প্রতিশ্রুতি ও আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে৷ আবার পারস্পরিক বিরোধিতাও আটকানো যাবে ৷

এর জন্য যে বিষয়গুলিতে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছিল, তা হল - ফেডারিলজম, আইনের শাসন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ মৌলিক অধিকারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, প্রদেশগুলির সঙ্গে অর্থনৈতিক ফল ভাগ করে নেওয়া, ন্যায়সঙ্গত উন্নয়ন ও বহিষ্কৃত অংশের ক্ষমতায়ন । একই সময়ে প্রদেশগুলির (এখন রাজ্য হিসাবে বলা হয়) স্বার্থের কথা মাথায় রেখে বিভিন্ন বিধান সংশোধন করা তুলনামূলকভাবে সহজ করা । একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক যা মনে রাখা দরকার, তা হল খসড়া সংস্করণ চূড়ান্ত সংস্করণ থেকে পরিবর্তিত হয় এবং মূল খসড়াটিতে 2475টি সংশোধনী ছিল । দেশভাগের পর হিংসার কারণে হাজার হাজার মানুষ খুন হন এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহীন হন ৷ এর ফলে যে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তার প্রেক্ষিতে বিপুল সংখ্যক পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয় এবং তা গৃহীতও হয় ৷

তাছাড়া আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যাতে রাষ্ট্রব্যবস্থার তরফে জোরজবরদস্তিমূলক পদক্ষেপের প্রবণতা না তৈরি হয়, সেই দিকটিও সংবিধানে নিশ্চিত করা হয়েছে ৷ আরও গুরুত্বপূর্ণ হল গণপরিষদের সদস্যদের একাংশের বারাবর আপত্তি তোলা সত্ত্বেও আর্থিক ও অন্যান্য একাধিক বিষয়ে রাজ্যগুলির সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করে নেওয়ার বিষয়ে সংবিধানে জোর দেওয়া হয়েছে ৷ এছাড়া ফেডারেল কাঠামো এবং কেন্দ্র ও রাজ্য়ের মধ্যে ক্ষমতার সুস্পষ্ট বিভাজন রেখাও সংবিধানে টেনে দেওয়া আছে ৷ বিশেষ করে উল্লেখ করা হয়েছে যে কেন্দ্র থেকে রাজস্বের উৎস স্বাধীন হলে তবেই রাজ্যগুলির সামঞ্জস্যপূর্ণ আর্থিক বৃদ্ধি সম্ভব হবে এবং তাদের অধিকার সুরক্ষিত থাকবে ৷

হিন্দি যাতে জোর করে সকলের উপর চাপিয়ে না দেওয়া হয়, সেটা নিশ্চিত করা হয়েছে সংবিধানে ৷ 1948 সালে হিন্দিকে অন্য আঞ্চলিক ভাষার উপর চাপিয়ে দিতে 29টি সংশোধনী জমা পড়েছিল ৷ কিন্তু গণপরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মতের ভিত্তিতে তা খারিজ হয়ে যায় ৷ বরং ভাষাগত সংখ্যালঘুদের অধিকারের বিষয়টি সংবিধানে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয় ৷

গণতান্ত্রিক সমাজের উপর ছড়ি ঘোরানোর প্রবণতা তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কিত হয়েছিলেন ড. বিআর আম্বেদকর ৷ সেই কারণে সংবিধানে বিচারব্যবস্থাকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে ক্ষমতার ভারসাম্য সবসময় বজায় থাকে ৷ ড. আম্বেদকর সংবিধানের 32 অনুচ্ছেদকে ‘হৃদয় ও আত্মা’ বলে অভিহিত করেছেন ।

প্রকৃতপক্ষে, অনুচ্ছেদ 226-সহ সংবিধানের তৃতীয় অংশ (অনুচ্ছেদ 12 থেকে 35, মৌলিক অধিকার) এখন পর্যন্তও গত কয়েক বছরে বেড়ে যাওয়া স্বৈরাচারী শাসন ও মৌলিক অধিকারের উপর আক্রমণের মাঝে দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে ৷ কারণ, এই ধরনের ক্ষেত্রে সরাসরি সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে ৷ সেখান থেকে প্রয়োজনীয় রক্ষাকবচ পেতে পারেন অনেকে ৷

অন্ধকার অংশ: সংবিধান যে অনেকাংশে আমাদের ভালো জায়গায় নিয়ে গিয়েছে, সেই বিষয়ে কোনও সংশয় নেই ৷ তবে আগামী কয়েক বছর হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । সংসদ যেভাবে কাজ করছে তাতে ভারতীয়দের হতবুদ্ধি হওয়া উচিত । গণপরিষদের একটি প্রবল আশা ছিল যে রাজ্যসভায় বরিষ্ঠরা দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করবেন ৷ তার বদলে সেখানে এখন বিরোধী দল ও অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলি এমন লোকদের দ্বারা আক্রান্ত হয়, যাদের অন্যান্য সাংবিধানিক সংস্থার সমালোচনা করার সময় আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত ।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক প্রবণতার মধ্যে রয়েছে মৌলিক অধিকারের জন্য জায়গা সীমিত করার বারবার প্রচেষ্টা, সাংবিধানিক আদালতের ক্ষমতা হ্রাস করে আইন পাশ করার প্রচেষ্টা, ট্রাইব্যুনালগুলি আজ অবসরপ্রাপ্ত ও রাজনৈতিক শ্রেণীর প্রিয় সদস্যদের জন্য স্থান হয়ে উঠেছে । আরও উদ্বেগজনক দিক হল, কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলির ক্ষমতাকে খর্ব করার চেষ্টা করছে ৷ অনেক ক্ষেত্রে এটা আটকাতে রাজ্যগুলি কোনও চেষ্টা করেনি বা কেন্দ্রের নির্দেশ নীরবে মেনে নিয়েছে ৷ আর তাদের দেওয়া সাংবিধানিক ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছে । জিএসটি এমন একটি উদাহরণ । অন্য উদ্বেগজনক দিকটি হল যে যখন রাজ্যগুলি প্রায়শই কেন্দ্রের বিরুদ্ধে ক্ষমতা খর্ব করার প্রচেষ্টার বিষয়ে অভিযোগ করে, তখন অন্যদিকে তারাই আবার স্থানীয় প্রশাসনের ক্ষমতা খর্ব করার চেষ্টা করছে ৷

সময়ের প্রয়োজন: অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিবর্তন যে সময়ের নিয়ম মেনে হচ্ছে, সেটা বুঝতে রাজনৈতিক দলগুলি-সহ আরও অনেককে বুঝতে হবে ৷ যেভাবে সরকারি সম্পত্তি গুটিকয়েক লোকের হাতে চলে যাচ্ছে, তা যথেষ্ট উদ্বেগজনক ৷ সংবিধানের 44তম সংশোধনের মাধ্যমে বাসস্থানের অধিকারকে সরিয়ে দেওয়া যে কতবড় ভুল ছিল, তা এর মাধ্যমে প্রমাণিত হচ্ছে ৷ চিন বা রাশিয়ায় যেমন সচ্ছ্বল অংশের সম্পত্তিকে টার্গেট করা হয় ৷ বদলে এখানে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের অংশকে এই ধরনের ক্ষেত্রে টার্গেট করা হয় ৷ তাছাড়া নয়া প্রযুক্তিকে হাতিয়ার করে জনস্বার্থের নামেও গুরুত্বপূর্ণ অধিকার খর্ব করার কাজ চলছে ৷ এটা উদ্বেগজনক, কারণ ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল ও নতুন প্রযুক্তিগুলি মানুষের জন্য নিজেকে প্রকাশ করার প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে ৷ তাই তাদের অধিকার খর্ব হলে, তা 19 ও 21 অনুচ্ছেদের অধীনে অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন স্বাধীনতার অধিকার হ্রাস করবে ৷

আরও পড়ুন:

2টি রাষ্ট্রপতি পুরস্কার-সহ সাধারণতন্ত্র দিবসে বীরত্ব ও পরিষেবা পদক পাচ্ছেন 1132 জন

কলকাতা, 25 জানুয়ারি: ভারতের সংবিধানের এবার 75 বছর । আমাদের সংবিধান 1947 সালের আগে 100 বছরেরও বেশি সময় ধরে বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগের ফসল । ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিতকে নাড়িয়ে দেওয়ার মতো সংগঠিত প্রতিরোধ জাতীয় আন্দোলনের গান্ধিবাদী পর্ব দিয়ে যা শুরু হয়েছিল ।

এখন হয়তো গান্ধিজির সমালোচনা করা সহজ ৷ কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে সত্যিকারের একটি গণ-আন্দোলনে পরিণত করা ৷ 1885 থেকে 1919 সাল পর্যন্ত যেভাবে লড়াই হয়েছিল, এই গণ-আন্দোলন একেবারে তার বিপরীতধর্মী ছিল ৷ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যত মানুষ অংশ নিয়েছিলেন, আজ যেকোনও আন্দোলনে ভারতীয়দের যোগদানের হারের নিরিখে সেটাই সর্বোচ্চ ৷

সংবিধানের খসড়া তৈরির সময় দেশের নেতাদের বিভিন্ন বিষয়ে নজর দিতে হয়েছিল ৷ তার মধ্যে ছিল - ভারতীয়দের শোষণ ও আধিপত্য থেকে মুক্ত করার জন্য জাতীয় আন্দোলনের প্রতিশ্রুতি পূরণ করা, ভারতীয়দের আকাঙ্ক্ষার ভারসাম্য বজায় রাখা ৷ বিশেষ করে ভারতের যা আয়তন আর এই দেশের যা বৈচিত্র, তার প্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক রূপান্তরের আগে এমন কোনও চেষ্টা করা হয়নি ৷ তাছাড়া বিশাল অংশের মানুষ শিক্ষিত ছিল না ৷ অধিকাংশের তিনবেলা খাবারও জুটত না ৷ তাই খেয়াল রাখতে হয়েছে যে সংবিধান যেন সব শ্রেণির মানুষকে সমানাধিক দেয় ৷

সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্বে ছিল গণপরিষদের ৷ 1946 সালের ডিসেম্বর থেকে 1949 সালের ডিসেম্বর গণপরিষদে সংবিধান তৈরি করা হয় ৷ 1950 সালের 26 জানুয়ারি ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে একটি সাধারণতন্ত্রে পরিণত হয় । যদিও এটি সেভাবে প্রশংসিত হয় না, তবে সাধারণতন্ত্রের একক বৃহত্তম অবদান হল যে এটি দেশভাগ, হিংসা, অর্থনৈতিক দুরাবস্থা, শিক্ষার নিম্নস্তর, তিনটি যুদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও একটি জাতি হিসাবে দেশকে এক জায়গায় আনতে সফল হয়েছে । আরও গুরুত্বপূর্ণভাবে সামাজিক গোষ্ঠীর বৈচিত্র্যকেও এক করতে সমর্থ হয়েছে সাধারণতন্ত্র ৷ 1947 সালের আগে কখনও এই পরিস্থিতি ছিল না ।

উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে যে 565টি প্রিন্সলে স্টেট, যা ভারতের 40 শতাংশ জায়গা জুড়ে ছিল এবং দেশের 23 শতাংশ জনসংখ্যা সমৃদ্ধ ছিল ৷ তাছাড়া পর্তুগাল ও ফ্রান্সের অধীনে থাকা অঞ্চলগুলি স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে নতুন দেশে অন্তর্ভুক্ত হয় ৷

ইদানীং সংবিধানের সমালোচনা ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে ৷ কারও কারও মতে, সংবিধান অনেক পুরনো ও দেশের প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন্য যথেষ্ট নয় ৷ তাই এটা নতুন করে লেখার দাবিও উঠতে শুরু করেছে ৷ যাকে উদ্বেগজনক প্রবণতা বলাই যেতে পারে ৷ যদিও এই দাবি খুবই হাস্যকর ৷ কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধানের বয়স 200 বছর ৷ জাপান বা ইউরোপের দেশগুলিতে ভারতের চেয়ে পুরনো বা একই সময়ের সংবিধান রয়েছে ৷

অথচ যে দেশগুলি 1940 থেকে 1970 এর দশকে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীন হয়েছিল, তাদের ভারতই একমাত্র দেশ যেটি মূলত গণতান্ত্রিক থাকতে পেরেছে (অল্প সময়ের জরুরি অবস্থা ছাড়া) । অন্য সব দেশ দীর্ঘ সময় একনায়কতন্ত্রের মধ্যে পড়েছে । আমাদের প্রতিবেশীরা এমন সমাজের ভালো উদাহরণ, যা দীর্ঘ সময়ের স্বৈরাচারী শাসন প্রত্যক্ষ করেছে ৷ ভারতীয়দের এই সত্যের জন্য গর্বিত হওয়া দরকার ৷ আর বলা যেতে পারে যে এটি মূলত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আমাদের জাতীয় আন্দোলন এবং স্বাধীনতার পরে সংবিধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে হয়েছে ।

কঠিন কাজ এবং প্রধান বৈশিষ্ট্য: সংবিধানের খসড়া তৈরি করা কার্যত ‘হারকিউলান টাস্ক’ ছিল ৷ মূল গণপরিষদ মোট 389 জন সদস্য নিয়ে গঠিত ছিল ৷ এর মধ্যে 292 জন ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের, 93 জন রাজ্যের এবং চারজন দিল্লি, আজমির-মেরওয়ার, কুর্গ ও ব্রিটিশ বালুচিস্তান প্রদেশ থেকে । দেশভাগের পর সংখ্যাটি পরে 299-এ নেমে আসে । সংবিধান প্রণয়নের কাজ 165 দিনের মেয়াদে 11টি অধিবেশনে 2 বছর, 11 মাস ও 18 দিন সময় ধরে হয়েছিল ৷

এই অত্যন্ত কঠিন কাজটি ড. বিআর আম্বেদকরের নেতৃত্বে খসড়া কমিটি যে করেছিল, তাতে তাঁদের জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয় ৷ খসড়া তৈরির সময় 22টি উপ-কমিটিও তৈরি হয় ৷ এর মধ্যে 8টি ছিল মৌলিক অধিকার, প্রদেশ, অর্থ, নিয়ম ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের জন্য তৈরি হয়েছিল ৷ তাদের মতামত খসড়া কমিটি একসুতো গাঁথে ৷ তার পর তা গণপরিষদে পেশ করা হয় ৷ তা পেশ করার পর আলোচনা হয় এবং শেষে তা গৃহীত হয় ৷

গণপরিষদে এই নিয়ে যে বিতর্ক-আলোচনা হয়, তা খুঁটিয়ে দেখলেই বোঝা যায় যে সংবিধান রচনা কতটা কঠিন কাজ ছিল ৷ বিশেষ করে সংবিধানের বাক্য ও ব্যকরণ যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছেও বোধগম্য হয়, সেই বিষয়টিও বিতর্কে উঠে আসে ৷ তবে সংবিধানের আসল সাফল্য হল, এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্যরা জানতেন যে সংবিধানকে এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেখানে সর্বস্তরের লক্ষ্য, প্রতিশ্রুতি ও আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে৷ আবার পারস্পরিক বিরোধিতাও আটকানো যাবে ৷

এর জন্য যে বিষয়গুলিতে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছিল, তা হল - ফেডারিলজম, আইনের শাসন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ মৌলিক অধিকারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, প্রদেশগুলির সঙ্গে অর্থনৈতিক ফল ভাগ করে নেওয়া, ন্যায়সঙ্গত উন্নয়ন ও বহিষ্কৃত অংশের ক্ষমতায়ন । একই সময়ে প্রদেশগুলির (এখন রাজ্য হিসাবে বলা হয়) স্বার্থের কথা মাথায় রেখে বিভিন্ন বিধান সংশোধন করা তুলনামূলকভাবে সহজ করা । একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক যা মনে রাখা দরকার, তা হল খসড়া সংস্করণ চূড়ান্ত সংস্করণ থেকে পরিবর্তিত হয় এবং মূল খসড়াটিতে 2475টি সংশোধনী ছিল । দেশভাগের পর হিংসার কারণে হাজার হাজার মানুষ খুন হন এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহীন হন ৷ এর ফলে যে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তার প্রেক্ষিতে বিপুল সংখ্যক পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয় এবং তা গৃহীতও হয় ৷

তাছাড়া আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যাতে রাষ্ট্রব্যবস্থার তরফে জোরজবরদস্তিমূলক পদক্ষেপের প্রবণতা না তৈরি হয়, সেই দিকটিও সংবিধানে নিশ্চিত করা হয়েছে ৷ আরও গুরুত্বপূর্ণ হল গণপরিষদের সদস্যদের একাংশের বারাবর আপত্তি তোলা সত্ত্বেও আর্থিক ও অন্যান্য একাধিক বিষয়ে রাজ্যগুলির সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করে নেওয়ার বিষয়ে সংবিধানে জোর দেওয়া হয়েছে ৷ এছাড়া ফেডারেল কাঠামো এবং কেন্দ্র ও রাজ্য়ের মধ্যে ক্ষমতার সুস্পষ্ট বিভাজন রেখাও সংবিধানে টেনে দেওয়া আছে ৷ বিশেষ করে উল্লেখ করা হয়েছে যে কেন্দ্র থেকে রাজস্বের উৎস স্বাধীন হলে তবেই রাজ্যগুলির সামঞ্জস্যপূর্ণ আর্থিক বৃদ্ধি সম্ভব হবে এবং তাদের অধিকার সুরক্ষিত থাকবে ৷

হিন্দি যাতে জোর করে সকলের উপর চাপিয়ে না দেওয়া হয়, সেটা নিশ্চিত করা হয়েছে সংবিধানে ৷ 1948 সালে হিন্দিকে অন্য আঞ্চলিক ভাষার উপর চাপিয়ে দিতে 29টি সংশোধনী জমা পড়েছিল ৷ কিন্তু গণপরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মতের ভিত্তিতে তা খারিজ হয়ে যায় ৷ বরং ভাষাগত সংখ্যালঘুদের অধিকারের বিষয়টি সংবিধানে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয় ৷

গণতান্ত্রিক সমাজের উপর ছড়ি ঘোরানোর প্রবণতা তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কিত হয়েছিলেন ড. বিআর আম্বেদকর ৷ সেই কারণে সংবিধানে বিচারব্যবস্থাকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে ক্ষমতার ভারসাম্য সবসময় বজায় থাকে ৷ ড. আম্বেদকর সংবিধানের 32 অনুচ্ছেদকে ‘হৃদয় ও আত্মা’ বলে অভিহিত করেছেন ।

প্রকৃতপক্ষে, অনুচ্ছেদ 226-সহ সংবিধানের তৃতীয় অংশ (অনুচ্ছেদ 12 থেকে 35, মৌলিক অধিকার) এখন পর্যন্তও গত কয়েক বছরে বেড়ে যাওয়া স্বৈরাচারী শাসন ও মৌলিক অধিকারের উপর আক্রমণের মাঝে দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে ৷ কারণ, এই ধরনের ক্ষেত্রে সরাসরি সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে ৷ সেখান থেকে প্রয়োজনীয় রক্ষাকবচ পেতে পারেন অনেকে ৷

অন্ধকার অংশ: সংবিধান যে অনেকাংশে আমাদের ভালো জায়গায় নিয়ে গিয়েছে, সেই বিষয়ে কোনও সংশয় নেই ৷ তবে আগামী কয়েক বছর হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । সংসদ যেভাবে কাজ করছে তাতে ভারতীয়দের হতবুদ্ধি হওয়া উচিত । গণপরিষদের একটি প্রবল আশা ছিল যে রাজ্যসভায় বরিষ্ঠরা দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করবেন ৷ তার বদলে সেখানে এখন বিরোধী দল ও অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলি এমন লোকদের দ্বারা আক্রান্ত হয়, যাদের অন্যান্য সাংবিধানিক সংস্থার সমালোচনা করার সময় আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত ।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক প্রবণতার মধ্যে রয়েছে মৌলিক অধিকারের জন্য জায়গা সীমিত করার বারবার প্রচেষ্টা, সাংবিধানিক আদালতের ক্ষমতা হ্রাস করে আইন পাশ করার প্রচেষ্টা, ট্রাইব্যুনালগুলি আজ অবসরপ্রাপ্ত ও রাজনৈতিক শ্রেণীর প্রিয় সদস্যদের জন্য স্থান হয়ে উঠেছে । আরও উদ্বেগজনক দিক হল, কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলির ক্ষমতাকে খর্ব করার চেষ্টা করছে ৷ অনেক ক্ষেত্রে এটা আটকাতে রাজ্যগুলি কোনও চেষ্টা করেনি বা কেন্দ্রের নির্দেশ নীরবে মেনে নিয়েছে ৷ আর তাদের দেওয়া সাংবিধানিক ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছে । জিএসটি এমন একটি উদাহরণ । অন্য উদ্বেগজনক দিকটি হল যে যখন রাজ্যগুলি প্রায়শই কেন্দ্রের বিরুদ্ধে ক্ষমতা খর্ব করার প্রচেষ্টার বিষয়ে অভিযোগ করে, তখন অন্যদিকে তারাই আবার স্থানীয় প্রশাসনের ক্ষমতা খর্ব করার চেষ্টা করছে ৷

সময়ের প্রয়োজন: অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিবর্তন যে সময়ের নিয়ম মেনে হচ্ছে, সেটা বুঝতে রাজনৈতিক দলগুলি-সহ আরও অনেককে বুঝতে হবে ৷ যেভাবে সরকারি সম্পত্তি গুটিকয়েক লোকের হাতে চলে যাচ্ছে, তা যথেষ্ট উদ্বেগজনক ৷ সংবিধানের 44তম সংশোধনের মাধ্যমে বাসস্থানের অধিকারকে সরিয়ে দেওয়া যে কতবড় ভুল ছিল, তা এর মাধ্যমে প্রমাণিত হচ্ছে ৷ চিন বা রাশিয়ায় যেমন সচ্ছ্বল অংশের সম্পত্তিকে টার্গেট করা হয় ৷ বদলে এখানে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের অংশকে এই ধরনের ক্ষেত্রে টার্গেট করা হয় ৷ তাছাড়া নয়া প্রযুক্তিকে হাতিয়ার করে জনস্বার্থের নামেও গুরুত্বপূর্ণ অধিকার খর্ব করার কাজ চলছে ৷ এটা উদ্বেগজনক, কারণ ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল ও নতুন প্রযুক্তিগুলি মানুষের জন্য নিজেকে প্রকাশ করার প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে ৷ তাই তাদের অধিকার খর্ব হলে, তা 19 ও 21 অনুচ্ছেদের অধীনে অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন স্বাধীনতার অধিকার হ্রাস করবে ৷

আরও পড়ুন:

2টি রাষ্ট্রপতি পুরস্কার-সহ সাধারণতন্ত্র দিবসে বীরত্ব ও পরিষেবা পদক পাচ্ছেন 1132 জন

Last Updated : Jan 25, 2024, 8:23 PM IST
ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.