কলকাতা, 26 জুন : সহজে মানুষের সঙ্গে কথা বলে তাঁর মন জয় করার দক্ষতা ছিল কসবা ও আমহার্স্ট স্ট্রিটের ভুয়ো ভ্যাকসিন কাণ্ডে ধৃত দেবাঞ্জন দেবের । অচেনা মানুষকে নিমেষেই আপন করে নিতে পারত সে । তার ব্যবহারও ছিল নম্র-ভদ্র । আর নিজের এই প্রতিভাকেই কাজে লাগিয়ে পর পর মানুষ ঠকাতে শুরু করে দেয় দেবাঞ্জন । ঘটনার তদন্ত যত এগোচ্ছে, ততই এই ধরনের তথ্য উঠে আসছে তদন্তকারীদের হাতে ৷ তাই তাঁরা বলছেন, এই কীর্তিমান দেবাঞ্জনের চরিত্রের সঙ্গে হুবহু মিল পাওয়া যাচ্ছে সারদা চিটফান্ড এবং আর্থিক দুর্নীতিতে অভিযুক্ত সুদীপ্ত সেনের ।
পুলিশের একটি সূত্র থেকে জানা গিয়েছে, স্বভাবে সারদাকর্তা সুদীপ্ত সেনও দেবাঞ্জনের মতো একটি আত্মভোলা ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছিলেন । কিন্তু এই আত্মভোলা চেহারার নেপথ্যে ছিল কোটি কোটি টাকার জালিয়াতির ব্যবসা বা বলা চলে প্রতরণা চক্র । সারদাকর্তা সুদীপ্ত সেনের সঙ্গেও দেখা গিয়েছিল একাধিক নেতানেত্রীর ছবি । পাশাপাশি সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে একসময় একই মঞ্চে দেখা গিয়েছিল সেই সময় কলকাতা পুলিশের নগরপাল এবং অধুনা রাজ্যের মুখ্য নিরপত্তা উপদেষ্টা সুরজিৎ করপুরকায়স্থকেও । ঠিক যেমনটা দেবাঞ্জনের সঙ্গেও দেখা যাচ্ছে একাধিক পুলিশ আধিকারিকের ছবি ৷
আরও পড়ুন : Kasba Vaccine Controversy : দেবাঞ্জনের সঙ্গে শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনারের পুরোন ছবি ভাইরাল
তাছাড়া ফিরহাদ হাকিম, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, নয়না বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দেবাশিস কুমার-সহ শাসকদলের একাধিক বড় মাপের নেতার ছবিও দেখা গিয়েছে কসবা কাণ্ডের মাথা দেবাঞ্জনের সঙ্গে । শুধু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নয়। সুদীপ্ত সেনের মতো দেবাঞ্জনকেও দেখা গিয়েছে একাধিক আইপিএস অফিসারের সঙ্গে । যেমন বর্তমানে চন্দননগরের পুলিশ কমিশনার গৌরব শর্মাকেও দেবাঞ্জনের সঙ্গে একটি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে একসঙ্গে ফিতে কাটতে দেখা যায় । ফলে দেবাঞ্জন ও সুদীপ্ত, দু‘জনের চরিত্রেই রয়েছে এক অদ্ভুত মিল ।
তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, সুদীপ্ত সেনের মতোই কয়েক মিনিটেই মানুষের মন জয় করে ফেলার দক্ষতা দেবাঞ্জনের রয়েছে । সারদা কাণ্ডের পর্দা ফাঁস হওয়ার আগে মঞ্চে উঠে এমনভাবে নিজের বক্তব্য রাখতেন সুদীপ্ত সেন, যা শুনে অনেকেই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেতেন ৷
দেবাঞ্জনের হাতে প্রতারিতদের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ জানতে পেরেছে, কখনওই দেবাঞ্জন তাঁদের বুঝতে দেয়নি যে গোটা ঘটনাটি ভুয়ো । তাছাড়া লকডাউন চলাকালীন দেবাঞ্জনের অফিসের যখনই কেউ ভ্যাকসিন চেয়েছিল, নিমেষেই সে ভ্যাকসিন জোগাড় করে ফেলেছিল, তা সে হোক না নকল । এমন তার জীবনশৈলী ছিল যে কারও কোনও সন্দেহই হতে পারে না ।
আরও পড়ুন : Fake vaccine kolkata : ভুয়ো ভ্যাকসিন কাণ্ডে কেন্দ্রীয় তদন্ত চেয়ে হর্ষ বর্ধনকে চিঠি শুভেন্দুর
পাশাপাশি দেবাঞ্জনের থেকে প্রতারিত হওয়া কর্মীরা পুলিশকে জানান যে, তাঁরা যে এতদিন ভুয়ো সংস্থার হয়ে কাজ করতেন, তা তাঁরা বিশ্বাসই করতে পারছেন না । তদন্তকারীরা জানাতে পেরেছেন, দেবাঞ্জন কখনও তার কর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেনি । ঠিক যেমনটা করত সারদাকর্তা সুদীপ্ত সেন । সারদার প্রতারিতরাও অভিযোগ করেছিল, শুধুমাত্র সুদীপ্ত সেনের মঞ্চের বক্তৃতা শুনেই অনেকে সেখানে টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন ।
কিন্তু এই দুই চরিত্রে মধ্যে স্বভাবের মিল থাকলেও, কিছু জায়গায় অমিল খুঁজে পাচ্ছেন তদন্তকারীরা । কসবা কাণ্ডের তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পেরেছে শুধু প্রতরণা নয় । বেশ কিছু ভালো কাজও করেছে এই দেবাঞ্জন । যেমন গঙ্গাসাগর মেলায় গিয়ে গরিব, অনাথদের খাবার খাইয়েছিল সে । পাশাপাশি লকডাউন চলাকালীন এলাকায় ঘুরে ঘুরে রাস্তার কুকুরদের দু’বেলা খাবার খাওয়াত এই ভুয়ো আমলা ।
আরও পড়ুন : Fake Covid Vaccination : অসুস্থ মিমি, মামলা করলেন লাভলি
তবে সুদীপ্ত সেনও বহু সেবামূলক কাজে হাজির থেকে এবং কখনও কখনও সেই সব কাজে টাকা জুগিয়ে সমাজের প্রভাবশালী মহলে প্রভাব বিস্তার করেছিল ৷ আর দেবাঞ্জনও সেভাবে ভ্যাকসিনেশন ক্যাম্পের আয়োজন এবং মাস্ক-স্যানিটাইজার বিতরণ করে প্রভাবশালীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে চেয়েছিল ৷
আর প্রতারণায় অভিযুক্ত এই দু’জনের মধ্যে সবচেয়ে বড় মিল রয়েছে তাদের স্বপ্নে ৷ সুদীপ্ত সেনের নিজের কথাতেই, তার লক্ষ্য ছিল বাংলার সমস্ত বড় মিডিয়া হাউজকে কিনে নেওয়া । তেমনই জেরার মুখে দেবাঞ্জন গোয়েন্দাদের জানিয়েছে যে, তার লক্ষ্য ছিল একাধিক কোম্পানি গঠন করা এবং কলকাতা লিগে সেকেন্ড ডিভিশনে খেলে এমন কোনও ফুটবল ক্লাবকে কিনে নেওয়ার ।