বিদ্বেষ নয়, ইহুদি-মুসলমান সম্প্রীতির পীঠস্থান কলকাতার 3 সিনাগগ
কলকাতার তিন সিনাগগের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছেন মুসলমান সম্প্রদায়ের তিনজন ৷ কিন্তু, কলকাতার সিনাগগগুলির সেই ঐতিহ্য তুলে ধরলেন মনোজিৎ দাস ৷

Published : October 15, 2025 at 7:16 PM IST
কলকাতা, 15 অক্টোবর: গাজায় জঙ্গি সংগঠন হামাসের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চালাচ্ছে ইজরায়েল ৷ বিগত 2 বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে বহু প্রাণহানি ঘটেছে ৷ বিশেষত, প্যালেস্তাইনের সাধারণ মানুষের প্রাণহানি ঘটনার নিন্দা করেছে বিশ্বের বহু দেশ ৷ বিশেষত, মুসলিম প্রধান দেশগুলি ইজরায়েলের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে ৷ ইজরায়েলি অর্থাৎ ইহুদিদের প্রতি একপ্রকার ক্ষোভ তৈরি হয়েছে তাদের মধ্যে ৷
এটা যেমন একটা ছবি ৷ আরেকটি সমান্তরাল চিত্র ফুটে উঠছে ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইন থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার কিলোমিটার দূরে কলকাতায় ৷ শহরের ব্রেবোর্ন রোড ও পোলক স্ট্রিটে অবস্থিত ইহুদিদের তিনটি উপাসনাস্থল অর্থাৎ, সিনাগগে ৷ এই তিনটি সিনাগগের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা বংশপরম্পরায় এই কাজ করে আসছেন ৷ তাঁরা হলেন, আনোয়ার খান, মহম্মদ মাকসুদ এবং মহম্মদ সিরাজ ৷ কলকাতা এমনকি ভারতের অধিকাংশ মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষজন ইজরায়েলি হামলার বিরুদ্ধে সরব হয়েছে ৷

সেখানে দাঁড়িয়ে ইহুদিদের উপাসনাস্থলের পরিচর্যা করে চলেছেন আনোয়ার খানরা ৷ তাঁদের কাছে কর্মই হল সবচেয়ে বড় ধর্ম ৷ তাই একদিকে যখন হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধকে কেন্দ্র করে দু’ভাগে বিভক্ত গোটা বিশ্ব ৷ সেখানেই সম্প্রীতির এক অনন্য নজির গড়ে তুলেছে কলকাতা শহরের ইহুদি উপাসনালয় বা সিনাগগগুলি ৷

ব্রেবোর্ন রোডের উপর পাশাপাশি অবস্থিত ইহুদিদের দু’টি সিনাগগ ৷ একটি মাগেন ডেভিড সিনাগগ ৷ দ্বিতীয়টি নেভে শালোম সিনাগগ ৷ আর তৃতীয় বেথ এল সিনাগগ সামান্য দূরে পোলক স্ট্রিটে অবস্থিত ৷ এই তিন সিনাগগের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছেন মুসলমান সম্প্রদায়ের তিনজন ব্যক্তি ৷ মাগেন ডেভিডের রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার দায়িত্বে রয়েছেন আনোয়ার খান ৷ নেভে শালোম সিনাগগের দেখাশোনা করেন মহম্মদ মাকসুদ ৷ আর বেথ এল সিনাগগের দেখাশোনা করেন মহম্মদ সিরাজ ৷

কলকাতার ইহুদিদের সঙ্গে তাঁদের কোনও বিভেদ নেই ৷ এখানে তাঁরা এক বৃহত্তর পরিবার ৷ একে অপরের প্রতি কোনও ক্ষোভ নেই তাঁদের ৷ হাসি, আনন্দ ও সুখ-দুঃখে একে-অপরের সঙ্গে সর্বদা রয়েছেন তাঁরা ৷ বর্তমানে ভারতে ইহুদিদের সংখ্যা খুবই সীমিত ৷ দিল্লি ও মুম্বইয়ে মেরে কেটে 3500 থেকে 4000 ইহুদি থাকেন ৷ আর কলকাতায় সেই সংখ্যাটা মাত্র 16-17 জন ৷ কলকাতায় ইহুদিদের তিনটি সিনাগগের পাশাপাশি, রাজাবাজার নারকেল ডাঙায় তাদের কবরখানা ও পার্ক স্ট্রিট এলাকায় একটি জিউস স্কুল রয়েছে ৷

এই তিনটি সিনাগগ, কবরস্থান ও স্কুলের মাথায় রয়েছেন মিসেস কোহিন ৷ আশি বছরের মিসেস কোহিন পার্ক স্ট্রিটের বাসিন্দা ৷ 1962 সালে কলকাতায় এসেছিলেন তিনি ৷ তখন কোহিন কলেজ পড়ুয়া ৷ তিনি এবং হাতেগোনা যে কয়েকজন ইহুদি রয়েছেন, তাঁরা সপ্তাহের একটি বিশেষদিনে সিনাগগগুলিতে যান প্রার্থনার জন্য ৷ সম্প্রতি তাঁদের নতুন বছরের অনুষ্ঠান হয়েছে ৷ সেখানেও অংশ নিয়েছেন আনোয়ার, মাকসুদ এবং সিরাজরা ৷

মিসেস কোহিনকে ইজরায়েল ও গাজার যুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন করা হয় ৷ যার জবাবে তিনি বলেন, "আমরা নিজেদের ধর্মাচার পালন করার জন্য এখানে আসি ৷ ওসবের কোনও প্রভাব হিন্দুস্তানে নেই ৷ আমাদের মধ্যেও পড়ে না ৷ আমাদের তিনটি উপাসনালয় সবটাই তো আনোয়াররা রক্ষণাবেক্ষণ করেন ৷ আজ থেকে নয়, এক্কেবারে প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ৷ আনোয়ারের বাবা-ঠাকুর’দা সেই দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন ৷ আমি কলকাতায় পা-রেখে তাঁদের দেখেছি ৷ আমাদের মধ্যে খুবই ভালো সম্পর্ক ছিল, আছে এবং থাকবে ৷ আমাদের সঙ্গে সবার পরিবারের মতোই সম্পর্ক ৷"
জানা যায়, সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে যখন কলকাতায় ইহুদিরা আসে, তখন কলকাতার ব্রেবোর্ন রোড, পোলক স্ট্রিট ও পার্ক স্ট্রিট এলাকায় বসবাস শুরু করে ৷ তখন থেকেই তাঁদের বাড়ির বিভিন্ন কাজের দায়িত্বে থাকেন মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষজন ৷ শুধু তাই নয়, শতবর্ষ প্রাচীন নিউ মার্কেটে ইহুদিদের নাহুমস বেকারির কেক-পেস্ট্রি কিংবা প্যাটিস তৈরির কারিগরদের অধিকাংশই মুসলমান ৷ আজও তাঁরা সেই কাজটাই করে চলেছেন ৷ ফলে কয়েক দশক ধরে ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইনের অস্থির পরিস্থিতি, তা কোনোভাবেই এ দেশের মাটিতে তথা বাংলার মাটিতে কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি ৷ বরং বিবাদ নয়, এখানে সম্প্রীতির ছবি প্রতি মুহূর্তে ফুটে ওঠে ৷
আর সেটাই দেখা গেল ব্রেবোর্ন রোডের ডেভিড সিনাগগে ৷ মিসেস কোহিন সেখানে আসার পর, তাঁর বসার জন্য চেয়ার পেতে দেওয়া, তাঁর জন্য চা করে নিয়ে আসা, শরীর-স্বাস্থ্যের খোঁজ নেওয়া, সবই করলেন আনোয়ার ৷ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা অন্যান্য কর্মীদের সঙ্গে হাসতে-হাসতে গল্পও করতে দেখা গেল কোহিনকে ৷
এই প্রসঙ্গে আনোয়ার খান বলেন, "জাত, ধর্ম, সম্প্রদায় নিয়ে আমাদের এখানে কোনোদিন সমস্যা হয়নি ৷ আমার তিন প্রজন্ম এখানে কাজ করেছে সম্মানের সঙ্গে ৷ আমিও কাজ করছি ৷ ম্যাডামের থেকে সবসময় স্নেহ ভালোবাসা পেয়ে এসেছি ৷ যেখানে যা হচ্ছে হোক ৷ আমাদের এখানে তার কোনও ছিটেফোঁটা প্রভাব নেই ৷ যে এই বিষয় নিয়ে আমাদের সম্পর্কে ফাটল ধরানোর কথা ভাববে, তাঁকে আমরা ক্ষমা করব-না ৷ আমরা মিলেমিশে থাকি ৷ এটা আমাদের দেশ ও বাংলার সংস্কৃতি ৷"
আর মিসেস কোহিন আরও জানান, পার্ক স্ট্রিটের যে স্কুলটি চলে সেখানেও কোনও বাধ্যবাধকতা নেই ৷ তাই এখন প্রায় দেড় হাজারের বেশি পড়ুয়া রয়েছে জিউস স্কুলে ৷ সেখানে নানা সম্প্রদায়ের বাচ্চারা পড়াশোনা করেন ৷ সেখানে পঠনপাঠন, নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা, অনুশাসন, খেলাধুলোর মাধ্যমে প্রকৃত মানুষ গড়ার দিকে জোর দেওয়া হয় ৷

