
গঙ্গা ভাঙনে মানচিত্র থেকে মুছে যেতে পারে মালদা, সংকটে পড়তে পারে কলকাতা বন্দরও
মালদা জেলা একটু একটু করে তলিয়ে যাচ্ছে নদীগর্ভে৷ বাকিটাও কী থাকবে? আশঙ্কায় জেলাবাসী৷ এই নিয়েই ইটিভি ভারত-এর প্রতিনিধি পার্থ দাসের প্রতিবেদন৷

Published : October 18, 2025 at 9:13 PM IST
মালদা, 18 অক্টোবর: পুণ্যতোয়া গঙ্গা৷ দেশের প্রধান নদীকে এই বিশেষণেই বিভিন্ন বই-পুঁথিতে উল্লেখ করা হয়েছে৷ হবে নাই বা কেন! গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপত্তির পর আড়াই হাজার কিলোমিটারেরও বেশি গতিপথে ভারতবর্ষকে সুজলা-সুফলা করে তুলেছে সে৷ কিন্তু প্রদীপের আলোর নীচে থাকে নিকষ অন্ধকার৷ পুণ্যতোয়ার সেই অন্ধকার ছায়া পড়েছে মালদা জেলায়৷
কয়েক দশক ধরে একটু একটু করে এই জেলাকে গিলে খাচ্ছে গঙ্গা৷ ইতিমধ্যে তার গর্ভে চলে গিয়েছে অন্তত এক হাজার বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি জমি৷ দেড় লাখের বেশি মানুষ হয়েছে নিঃস্ব৷ এতেই শেষ নয়, অপেক্ষা করে আছে আরও ভয়ঙ্কর বিষয়৷ গঙ্গা আর তার উপনদী ফুলহর পাড় কাটতে কাটতে এখন সঙ্গমের অপেক্ষায়৷
কোনও কারণে দুই নদী মিলে গেলে গঙ্গা তার গতিপথ পরিবর্তন করবে বলে আশঙ্কা করছেন নদী বিশেষজ্ঞরা৷ তাঁদের ভবিষ্যৎবাণী, সেক্ষেত্রে শুধু জেলা সদর ইংরেজবাজার শহর নয়, মালদার একটা বিস্তীর্ণ অংশের অস্তিত্বই থাকবে না৷ অস্তিত্বের সংকটে পড়বে কলকাতা বন্দরও৷
অনেক আগে গঙ্গা রাজমহল থেকে 40 কিলোমিটার লোয়ার ক্যাচমেন্টে গৌড়নগরী ঘেঁষে প্রবাহিত হতো৷ পরবর্তীতে নদী পশ্চিমদিকে সরে যেতে শুরু করে৷ তবু গত শতকের প্রথমদিকে ফরাক্কা ও রাজমহলের মধ্যবর্তী অংশের পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়েছিল গঙ্গা৷ 1975 সালে ফরাক্কা ব্যারেজ চালু হয়৷ স্বাভাবিক গতি বাধাপ্রাপ্ত হয় গঙ্গার৷ তার তলদেশে টন টন পলি জমা হতে শুরু করে৷ নদীর গভীরতা কমতে থাকে৷ তখন থেকেই গঙ্গা দ্রুতগতিতে তার গতিপথ বদল করতে শুরু করে৷ বিহার থেকে পশ্চিমবঙ্গে ঢোকার পর সে একটি বিরাট বাঁক তৈরি করে ফেলে৷ এসব কারণেই গঙ্গা বামদিকের পাড় কাটতে শুরু করে বলে অনুমান করেন নদী বিশেষজ্ঞদের অনেকে৷
গত শতকের শেষে গঙ্গার দাপটে মালদা জেলার আয়তন অনেকটাই কমে যায়৷ নদীগর্ভে চলে যায় মানিকচক ব্লকের 22টি মৌজা, কালিয়াচক 2, রতুয়া 1 ও রতুয়া 2 নম্বর ব্লকের বেশ কিছু এলাকাও৷ এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় কালিয়াচক 2 নম্বর ব্লকের পঞ্চানন্দপুরে৷ গত শতকের ষাটের দশকেও পঞ্চানন্দপুর একটি বড় নদী বন্দর ও বাণিজ্য কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত ছিল৷ ছিল চিনিকল, একাধিক স্কুল, বড় সাপ্তাহিক বাজার-সহ আরও অনেক কিছু৷ কিন্তু গঙ্গার গ্রাসে সবই চলে যায় জলের অতলে৷ চলতি দশকের শুরুতে কালিয়াচক 2 নম্বর ব্লকের কাঁকরবন্ধা ঝাউবোনা গ্রাম পঞ্চায়েতের পুরো অংশ গঙ্গাগর্ভে আশ্রয় নেয়৷

গঙ্গা ভাঙন নাগরিক অ্যাকশন প্রতিরোধ কমিটির তরফে খিদির বক্স বলেন, “গঙ্গা ভাঙনের ক্ষতি নিয়ে আমাদের সংগঠনের তরফে ওই সময় একটি সার্ভে করা হয়েছিল৷ তাতে উঠে এসেছিল, 1999 সাল পর্যন্ত মানিকচক ও কালিয়াচক এলাকার 750 বর্গ কিলোমিটার এলাকা নদীতে তলিয়ে গিয়েছে৷ নদীগর্ভে চলে গিয়েছে 60টি প্রাইমারি, 14টি হাইস্কুল-সহ বিস্তীর্ণ আমবাগান ও চাষের জমি৷ সেই সময় প্রায় 40 হাজার পরিবার অন্যত্র চলে গিয়েছে৷ দেশের অনেক রাজ্যে এই ভাঙন উদ্বাস্তুরা রীতিমতো কলোনি স্থাপন করেছে৷ যেমন, মুম্বইয়ের বাইকুলায় এখানকার ভাঙন বিধ্বস্তদের একটি বড় কলোনি রয়েছে৷ চলতি দশকেও গঙ্গার ভাঙন অব্যাহত৷ কিন্তু দুঃখের কথা, এখনও পর্যন্ত ভাঙন রোধে কোনও স্থায়ী পদক্ষেপ করা হয়নি৷”
কাগজে কলমে মালদা জেলার আয়তন 3733 বর্গ কিলোমিটার৷ 15টি ব্লকে গ্রাম পঞ্চায়েতের সংখ্যা 146টি৷ মৌজা রয়েছে 1814টি৷ কিন্তু নথির সঙ্গে বাস্তব মেলে না৷ সত্তরের দশক থেকে গঙ্গার ভয়াল ভাঙন এই হিসাবের অনেকটাই ওলটপালট করে দিয়েছে৷ একাধিক মৌজার সঙ্গে পুরো একটি গ্রাম পঞ্চায়েত চলে গিয়েছে গঙ্গাগর্ভে৷ গঙ্গাপাড়ের মানুষজন জানাচ্ছেন, দীর্ঘ বছর ধরে গঙ্গা ধ্বংসলীলা চালালেও টনক নড়েনি কোনও সরকারের৷ দুর্যোগের সময় শুধু অবৈজ্ঞানিকভাবে পাথর ফেলা হয়েছে নদীতে৷ যেখানে জলের গভীরতা 200 ফুট, সেখানে এক মিটার বোল্ডার পিচিং-এর কাজ হয়েছে৷ এভাবে গঙ্গাকে রোখা যায় না৷
স্থানীয়দের বক্তব্য, নদীর জলের গভীরতা 200 ফুট হলে অন্তত 250 ফুট ধরে পিচিং-এর কাজ করতে হবে৷ তবেই গঙ্গার আগ্রাসন থামানো যাবে৷ জলের গভীরতা কমে গেলে গঙ্গা পাড় ভাঙবেই৷ কেবি ঝাউবোনা উড়ে গিয়েছে৷ মালদার অর্ধেক অংশ এখন বিহারে৷ সেদিকে চর জাগছে৷ অবৈজ্ঞানিকভাবে কাজ করার ফলে কোটি কোটি টাকা নদীতেই ভেসে গিয়েছে৷ মানুষের দুর্দশা কমেনি৷

নদী বিশেষজ্ঞদের কথায়, কোনও নদী ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো গতিপথে চলে৷ নদীর মূল প্রবাহ ডান ও বামদিকে আবর্তিত হয়৷ রাজমহল পর্যন্ত গঙ্গার মধ্যগতি৷ বাম পাড়ে মালদা৷ রাজমহল পাহাড় প্রাচীন গ্রানাইট শিলায় তৈরি৷ অত্যন্ত শক্ত৷ গঙ্গা সেই শিলা কাটতে পারে না৷ ফলে সেখানে ধাক্কা খেয়ে নদীর স্রোত বামদিকে এসে ধাক্কা মারে৷ এপাড়ে মালদা জেলা নরম পলিগঠিত শিলা দিয়ে তৈরি৷ ফলে নরম শিলা কাটতে গঙ্গার কোনও সমস্যা হয় না৷
নদী বিশেষজ্ঞদের আরও বক্তব্য, নদীর ভাঙন উপর থেকে বোঝা যায় না৷ পাড়ে দাঁড়িয়ে যতটা ভাঙন দেখা যায়, নদীর তলদেশ আরও বেশি কাটে৷ ভাঙন রোধে নদীতে বোল্ডার ফেলা হলেও তল পর্যন্ত সেই বোল্ডার ফেলা হয় না৷ ফলে বোল্ডার গঙ্গায় ভেসে যায়৷ এতে নদীর বোঝা আরও বাড়ে৷ তাছাড়া গঙ্গার বেঙ্গল গ্যাপে মালদা অবস্থিত৷ জেলার নাম আসলে মালদহ৷ দহ অর্থাৎ জলাভূমি৷ দেশের 70 শতাংশ স্থানের মতো মালদাতেও গঙ্গার ধারে জনবসতি গড়ে উঠেছে৷ এদিকে রাজমহল পাহাড় থেকে শিলং পাহাড়ের মধ্যবর্তী এলাকা নীচু৷ এই জায়গায় দীর্ঘ বছর ধরে পলি ও বালি সঞ্চয় হয়েছে৷ তাই স্বাভাবিক নিয়মেই গঙ্গা এই নরম মাটি কেটে ফেলে৷
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, গঙ্গা ও তার উপনদী ফুলহর ধীরে ধীরে সঙ্গমের দিকে এগোচ্ছে৷ একবার দুই নদী মিশে গেলে তার প্রভাব মালদা জেলার ক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর হবে৷ দুই নদীর মিলিত ধারা তখন এক নতুন গতিপথ বেছে নেবে৷ সেই প্রবাহ কালিন্দ্রী নদীর খাত ধরে ইংরেজবাজারের নিমাসরাই এলাকায় মহানন্দায় মিশবে৷ এরপর বিপুল জলরাশি মহানন্দার খাত ধরে বাংলাদেশের গোদাগারি ঘাটে পদ্মার সঙ্গে মিশবে৷

এত জল ধারণের ক্ষমতা মহানন্দা নদীর নেই৷ বিভিন্ন নদীর মিশ্রিত জলধারা ইংরেজবাজার ও পুরাতন মালদা ব্লক তো বটেই, ভাসিয়ে দেবে গোটা মালদা শহরকেই৷ তাই এখন সবার নজর রতুয়া 1 নম্বর ব্লকের বিলাইমারি গ্রাম পঞ্চায়েতের পশ্চিম রতনপুর গ্রামের দিকে৷ এই অখ্যাত গ্রামটিই গঙ্গা আর ফুলহর নদীকে আলাদা করে রেখেছে৷ দুই বড় নদীর সঙ্গে এখান দিয়ে বইছে কোশি নদীও৷
সেই আশঙ্কার কথাই শুনিয়েছেন ভাঙন প্রবণ বিলাইমারি গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান রামলাল চৌধুরী৷ তিনি বলেন, “আমরা প্রশাসনের কাছে শুনেছিলাম, এবার নদীকে শক্ত করে বাঁধা হবে৷ এবার প্রায় 30 বছর পর আগাম বন্যা হল৷ ভাঙনও শুরু হয়ে গেল৷ এটা আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি৷ এবার প্রথমে গঙ্গার জল ঢুকে পাড় কাটতে শুরু করে৷ আমরা প্রশাসনকে জানালাম৷ সবাই ছুটে এলেন৷ জরুরি ভিত্তিতে ভাঙন রোধের কাজ শুরুও করা হয়েছে৷’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘মহানন্দটোলা, খাকসাবোনাতেও ভাঙন চলছে৷ সেখানেও ভাঙন রোধের কাজ চলছে৷ কয়েক বছর আগে গঙ্গা পশ্চিম রতনপুর থেকে 7-8 কিলোমিটার দূরে ছিল৷ এখন 10 কিলোমিটার ভিতরে ঢুকে গঙ্গা সেই গ্রাম কাটছে৷ একের পর এক বাঁধ নদীতে কেটে গিয়েছে৷ শুনেছি, ভাঙন রোধের স্থায়ী কাজের জন্য কেন্দ্র প্রায় 650 কোটি টাকা অনুমোদন করেছে৷ বর্ষার পরেই নাকি কাজ শুরু হবে৷ কয়েকদিন আগে প্রশাসনিক কর্তারা এখানে এসেছিলেন৷ তাঁরা এনিয়ে আলোচনাও করেছেন৷ বিহার থেকে একটি ক্যানেল নাকি কাটা হবে৷ সেটা যদি করা যায়, তবে এখানে গঙ্গা আর কাটবে না৷ পশ্চিম রতনপুর বেঁচে যাবে৷ আর যদি এই ব্যবস্থা না করা হয়, তবে নদী কিন্তু ইংরেজবাজারের দিকে এগিয়ে যাবে৷”

গঙ্গা ভাঙন শুধু বর্তমানের ক্ষতি করছে না, অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও৷ পশ্চিম রতনপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বাপি সরকার বলছেন, “আমি 2010 সালে এই স্কুলে যোগ দিই৷ সেই সময় গঙ্গা নদী দেখতে স্কুল থেকে 10 কিলোমিটার উজিয়ে যেতে হতো৷ 15 বছর পর গঙ্গা এখন আমার স্কুলে দরজায় ধাক্কা মারছে৷ স্কুল থেকে এখন নদীর দূরত্ব মাত্র 50 মিটার৷ এর মধ্যে শেষ তিন বছরেই ভাঙন সবচেয়ে বেশি হয়েছে৷ এখন প্রতিদিন স্কুল বন্ধ করে বাড়ি গিয়ে রাতে ভাবি, পরদিন সকালে স্কুলটা পাব তো? আমার স্কুলে সাড়ে তিনশো পড়ুয়া৷ পাশের জঞ্জালিটোলা, কান্তটোলা গ্রামের স্কুল ইতিমধ্যেই নদীতে চলে গিয়েছে৷ তারপর স্থায়ীভাবে আর কিছু হয়নি৷ পড়ুয়ারা একেকদিকে ছড়িয়ে পড়েছে৷ এখানে 200 মিটারের মধ্যে তিনটি স্কুল৷ তিনটি স্কুলই নদীর মুখে৷ 1100 পড়ুয়ার ভবিষ্যৎ অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে৷”
পশ্চিম রতনপুরের বাসিন্দা মুক্তি চৌধুরীর মনে একটাই চিন্তা৷ নদী গ্রাম কেটে দিলে কোথায় যাবেন, কী করবেন, থাকবেনই বা কোথায়? বললেন, “বালি-মাটির বস্তা নদীতে ফেলে গ্রাম বাঁচানোর চেষ্টা চলছে৷ কিন্তু সেই কাজ করে নদীর তাণ্ডব আটকানো যাচ্ছে না৷ একমাত্র পাথরের কাজ বা আরসিসি (নদীর তলদেশ পর্যন্ত কংক্রিট ঢালাই) করে কাজ করা হলে কিছুটা কাজ হবে৷ পাঁচ বছর ধরে গঙ্গা আমাদের গ্রাম কাটছে আর আমরা পালিয়ে বেড়াচ্ছি৷ গত চার বছরে আমাদের যাবতীয় সম্পত্তি, ঘরবাড়ি সব নদী শেষ করে দিয়েছে৷ এখন আমরা কী করব?’’
মুক্তি চৌধুরী আরও বলেন, ‘‘আমরা বলছি, আমাদের পাঁচ কাঠা করে জায়গা দেওয়া হোক৷ সরকারি ঘর দেওয়া হোক৷ তবেই আমরা বাঁচব৷ এবছর বড় নদীতে গ্রামের দেড়শো বাড়ি চলে গেল৷ এত মানুষের কী হবে? আমরা বারবার মিডিয়ার মাধ্যমে নিজেদের দাবি জানাচ্ছি৷ কিন্তু কাজ হচ্ছে না৷ শুধুমাত্র বর্ষার সময় নদীতে বস্তা ফেলা হচ্ছে অথচ শুখা সময় ফেলা হচ্ছে না৷ শুখা মরশুমে এই কাজ করা হলে আমাদের দেড়শোটা বাড়ি এবারও অক্ষত থাকত৷ গঙ্গাও এভাবে পাড় কাটত না৷ কিন্তু শুখা সময় কাজ না করে বর্ষার সময় সরকারের টাকা জলেই ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷”

গৌড়বঙ্গের বিশিষ্ট নদী বিশেষজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক নদী বন্ধুতা সমন্বয়ের সহযোগী তুহিনশুভ্র মণ্ডল ইটিভি ভারতকে বলেন, “গঙ্গা বর্তমানে মারাত্মক অবস্থায় রয়েছে৷ গঙ্গা দেশের প্রধান নদী৷ তার জলপ্রবাহও বৃহৎ৷ প্রতি সেকেন্ডে ৭০ হাজার কিউবিক মিটার জল বহন করে৷ মুর্শিদাবাদ এবং মালদা জেলায় এই নদীর ভাঙন প্রবল৷ অনেক সময় নদীতে অতিরিক্ত জলপ্রবাহের কারণে ভাঙন হয়৷ বন্যা, নদীর জলে রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি, শিলার কাঠিন্য, বৃক্ষহীনতা-সহ বিভিন্ন কারণেও নদী ভাঙন হয়ে থাকে৷ এসব কারণে গঙ্গারও ভাঙন হয়৷ গঙ্গার ভয়াল ভাঙনে এই মুহূর্তে পশ্চিম রতনপুর গ্রাম প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে৷ যদি এই গ্রাম পুরোপুরি মুছে যায়, তবে গঙ্গা আর ফুলহর নদী একসঙ্গে মিলে যাবে৷’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘এই মিলিত প্রবাহ প্রথমে কালিন্দ্রী, তারপর মহানন্দা দিয়ে প্রবাহিত হবে৷ সেটা হলে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি হবে৷ এই বিপুল জলরাশি বহন করার ক্ষমতা মহানন্দার নেই৷ সেক্ষেত্রে মালদা শহরের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে৷ শুধু মালদা শহর নয়, পুরো মালদা জেলাই সংকটের মুখে পড়ে যাবে৷ শুধু মানুষ নয়, সঙ্গে প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র-সহ নানাবিধ সম্পত্তি প্রচুর পরিমাণে নষ্ট হবে৷ গঙ্গা-ফুলহর মিশে গেলে আমরা একটা ধ্বংসের আশঙ্কা করছি৷ ভাঙন রোধে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থার প্রয়োজন৷ তার জন্য রাজ্য ও কেন্দ্র, দুই সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে৷ আমি একাধিকবার গঙ্গার ভাঙন প্রবণ এলাকা দেখে এসেছি৷ দুই সরকারের কাছে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন করেছি৷ গঙ্গা ভাঙনকে জাতীয় বিপর্যয় ঘোষণা করে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হোক৷”
ঠিক একই আশঙ্কা করেছেন সদ্য জেলা থেকে বদলি হয়ে যাওয়া সেচ দফতরের এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার শিবনাথ গঙ্গোপাধ্যায়৷ তিনি বলেন, “এই মুহূর্তে গঙ্গা ও ফুলহরের ব্যবধান মাত্র 750 মিটারের৷ 2022 সালেই সেচ দফতর আশঙ্কা করেছিল, গঙ্গা-ফুলহর মিশে গেলে দুই নদীর জলধারা নতুন এক পথে প্রবাহিত হবে৷ সেই সময় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রের একটি কলসালটেন্ট এজেন্সিকে সমীক্ষার কাজে নিযুক্ত করেন৷ 2022 থেকে 2024 সাল পর্যন্ত সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশনের নেতৃত্বে একটি বোর্ড তৈরি হয়৷ সেই বোর্ড কলসালটেন্টের কাজের উপর যথেষ্ট গবেষণা করে৷ 2024 সালে কনসালটেন্ট এজেন্সি তাদের প্রাথমিক রিপোর্ট জমা দেয়৷ সেই রিপোর্টেও ভয়াবহতার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে৷’’

শিবনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘এর উপর ভিত্তি করে সেই এজেন্সি কিছু পরামর্শও দেয়৷ সেই পরামর্শ অনুযায়ী সেচ দফতর 2025 সালের জানুয়ারি মাস থেকেই কাজ শুরু করে৷ 610 কোটি টাকার একটি প্রকল্প তৈরি হয়েছে৷ সেই প্রকল্পে গঙ্গাকে তার পুরোনো খাতে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে৷ অর্থাৎ 1950 সাল পর্যন্ত যেভাবে নদী বইত, সেই খাতেই নদীর ধারা নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হবে৷ সেই খাত ধরে গঙ্গা বিহারের সকরিগলি হয়ে ঝাড়খণ্ডের মধ্যে দিয়ে ভূতনিতে এসে পড়বে৷’’

তিনি আরও বলেন, ‘‘পুরনো সেই খাত এখনও রয়েছে৷ কিন্তু ঝাড়খণ্ডে সেই খাত বন্ধ করে রাখা হয়েছে৷ এই মুহূর্তে মূল কাজ, ডিসেম্বর মাসে ওই পুরনো খাত খুলে দেওয়া৷ ঝাড়খণ্ড সরকারের নো অবজেকশন সার্টিফিকেট মিললেই সেই কাজ শুরু হয়ে যাবে৷ এখন গঙ্গা রতুয়ার মহানন্দটোলা এলাকায় বিশাল বাঁক নিয়ে ভূতনিতে আঘাত করছে৷ কোনও নদী অশ্বক্ষুরাকৃতি বাঁক নিলে তার বেঁচে থাকা সম্ভব নয়৷’’
এর পর তাঁর সংযোজন, ‘‘গঙ্গাকে বাঁচাতে সেখানে স্পার এবং নদীর পাড় বাঁধিয়ে ফেলার পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছিল৷ সবচেয়ে সমস্যার বিষয়, এই মুহূর্তে গঙ্গা ও ফুলহরের মধ্যে দু’একটি চ্যানেল সক্রিয় হয়ে গিয়েছে৷ ফলে গঙ্গা পশ্চিম রতনপুরে ধাক্কা খাওয়ার পর 50 শতাংশ জল যাচ্ছে ফরাক্কার দিকে, বাকি জল চলে যাচ্ছে ফুলহরের দিকে৷ তাই পশ্চিম রতনপুর বাঁচাতে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে৷ কোনও কারণে দুই নদী মিলে গেলে নতুন জলপ্রবাহ কালিন্দ্রী নদী হয়ে মহানন্দায় মিশবে৷ এরপর গঙ্গা গৌড়ের পাশ দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়বে৷ এতে ফরাক্কা ব্যারেজের ভবিষ্যতও সংকটে পড়বে৷”

যদিও এক্ষেত্রে খানিকটা অন্য ধারণা পোষণ করেন গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের প্রধান, অধ্যাপক অরিজিৎ দাস৷ তিনি বলছেন, “মালদার গঙ্গা ভাঙন একটি দীর্ঘকালীন সমস্যা৷ রতুয়ার পশ্চিম রতনপুর গ্রামে ফুলহর আর গঙ্গার পারস্পরিক দূরত্ব কমতে কমতে এখন 1.1 কিলোমিটারে (গত বছরের সমীক্ষা অনুযায়ী) ঠেকেছে৷ এই এলাকায় প্রতি বছর গঙ্গার ভাঙন হচ্ছে৷ মানুষের চাষের জমি, বাসস্থান নষ্ট হচ্ছে৷ মানুষ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত৷ আসলে গঙ্গা যখন ঝাড়খণ্ডের রাজমহল দিয়ে মালদায় প্রবেশ করে সেই জায়গাটি ভূতাত্বিকভাবে অত্যন্ত জটিল এবং খুব ভঙ্গুর৷ এর জন্যই ভাঙনের ঘটনা ঘটছে৷’’

অধ্যাপক দাসের বক্তব্য, ‘‘এর সঙ্গে রয়েছে ফরাক্কা ব্যারেজের প্রভাব৷ নদীর গতিপথ বদল স্বাভাবিক ঘটনা৷ গঙ্গার ইতিহাস দেখলেও এই বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়৷ কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, বর্ষা শুরু আর শেষের সময় মারাত্মক ভাঙনের ঘটনা ঘটছে৷ খুব দ্রুত কোনও পদক্ষেপ না-করা হলে অনেক জনপদ বিলীন হয়ে যাবে৷ যেমন মালদার পঞ্চানন্দপুর গ্রামের আর কোনও অস্তিত্ব নেই৷ মুর্শিদাবাদেও এমন অনেক জনপদ রয়েছে৷ ফলে রতুয়ার এই জায়গায় যে সেই সম্ভাবনা প্রবল তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই৷’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘গঙ্গা আর ফুলহর এক হয়ে গেলে কিংবা নতুন কোনও খাতে বইলে যে সমস্যা দেখা দেবে তার সঙ্গে ফিডার ক্যানালের কোনও সম্পর্ক নেই৷ একাধিক জনপদ ধ্বংস হয়ে যাওয়াই তখন প্রধান সমস্যা হয়ে দেখা দেবে৷ ফরাক্কা ব্যারেজের অস্তিত্বও বিপন্ন হবে বলে মনে হয় না৷ ওই ব্যারেজের জন্যই এই ঘটনা ঘটছে বলে মনে করা হচ্ছে৷ ফলে নতুন গতিপথ ধরে দুই নদীর ধারা বইতে শুরু করলে এই ব্যারেজের কতটা ক্ষতি হবে, তার জন্য বৈজ্ঞানিক রিসার্চ প্রয়োজন৷’’

অধ্যাপক অরিজিৎ দাসের আরও বক্তব্য, ‘‘শুধুমাত্র ইঞ্জিনিয়ারিং দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করলে সমস্যার সমাধান হবে না৷ এর জন্য প্রয়োজন কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের পারস্পরিক সহযোগিতায় একটি বিশেষজ্ঞ দল তৈরি করে ভাঙন প্রবণ এলাকা নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ রিসার্চ করা৷ তাহলেই এই সমস্যার সমাধানের পথ বেরিয়ে আসতে পারে৷ আর ড্রেজিং অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ বিষয়৷ তবে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে এই ব্যবস্থা নেওয়া ভীষণই কঠিন৷ তাই আমাদের বিপল্প পথের কথা ভাবতে হবে৷”

