36 ব্যঞ্জনে ভোগ নিবেদন শান্তিপুরের আগমেশ্বরী কালীকে, নিয়ম মেনে মধ্যরাতে শুরু পুজো
অসংখ্য ভক্তবৃন্দদের জন্য প্রায় 14 কুইন্টাল ভোগ রাঁধা হবে । নিয়ম নেমে পুজোর পরদিন শোভাযাত্রা করে হবে বিসর্জন ৷

Published : October 14, 2025 at 9:35 PM IST
শান্তিপুর, 14 অক্টোবর: প্রায় 400 বছর আগে তন্ত্রসাধনার মধ্যে স্বপ্নাদেশ পেয়ে নদিয়ার শান্তিপুরে শুরু আগমেশ্বরী মাতার কালীপুজো ৷ কথিত আছে, এই পুজোর মধ্য দিয়ে শাক্ত এবং বৈষ্ণবদের মিলন ঘটেছিল ৷ এখনও চক্ষুদানের মধ্যে দিয়েই শুরু হয় দেবীর আরাধনা ।
আর মাত্র সময়ের অপেক্ষা ৷ দেবীর রূপ ফুটে উঠছে ধীরে ধীরে ৷ এখন থেকেই জাগ্রত দেবী মা আগমেশ্বরীর দর্শনে আনাগোনা হচ্ছে ভক্তবৃন্দদের । স্বাভাবিকভাবেই কালীপুজোর দিন সকাল থেকেই শুরু হবে পুজোর দান নেওয়ার পর্ব ৷
আগমেশ্বরী কালীপুজোর ইতিহাস
আগমেশ্বরী কালীপুজো শুরু করেছিলেন সার্বভৌম আগমবাগীশ । এই সার্বভৌম আগমবাগীশ ছিলেন পণ্ডিত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের প্রপৌত্র । তিনি ছিলেন তন্ত্রসাধক । তাঁরা আগমশাস্ত্রজ্ঞ ছিলেন বা সেই শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য লাভ করেছিলেন বলে তাঁদের আগমবাগীশ উপাধি দান করা হয় । সেই সময় শাক্ত ও বৈষ্ণবদের মধ্যে বিরোধ চলছিল বলেই শোনা যায় ৷ তাই শান্তিপুরের অদ্বৈতাচার্য্যের পৌত্র মথুরেশ গোস্বামী তাঁর নিজ কন্যার সঙ্গে বিবাহ দিয়েছিলেন সার্বভৌম আগমবাগীশের । এর ফলে জটিলতা আরও বৃদ্ধি পায় ৷
এরপরেই মথুরেশ তাঁর কন্যা-সহ জামাতাকে নিয়ে চলে আসেন শান্তিপুরে । এখানে এসে মথুরেশ জামাতার সাধনের জন্য তাঁর বসতবাটী থেকে কিছুটা দূরে একটি পঞ্চমুণ্ডির আসন স্থাপন করে দেন ৷ কারণ যেহেতু শান্তিপুরের গোস্বামীরা প্রত্যক্ষভাবে শক্তির উপাসনা করেন না ৷ তাই সেখানেই সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেন সার্বভৌম আগমবাগীশ ।
সাধনা করতে করতেই তিনি মায়ের দর্শন পান ৷ মায়ের নির্দেশে তিনি গঙ্গা থেকে মাটি নিয়ে এসে মূর্তি নির্মাণ করে পুজো করেন ৷ তারপরই মূর্তি বিসর্জন দিয়ে দেন ৷ এই প্রাচীন প্রথা আজও হয়ে আসছে মা আগমেশ্বরীর পুজোয় । বর্তমানে এই পঞ্চমুণ্ডির আসন সংলগ্ন স্থানটি 'আগমেশ্বরীতলা' নামেই পরিচিত । এইভাবে ঐতিহ্যের সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার এক উজ্জ্বলতম প্রকাশ দেখা যায় শান্তিপুরের আগমেশ্বরীর পুজোয় ।
আগমেশ্বরী কালীপুজোর নিয়ম-রীতি
এখানে পুজোর সমস্ত রীতিনীতি ও দায়িত্ববহন করেন বড় গোস্বামী পরিবারের সদস্যরাই । পাশাপাশি তাদের সহায়তা করতে রয়েছে আগমেশ্বরী মাতা পুজো সমিতি । দুর্গাপুজোর বিজয়া দশমীর দিন মা আগমেশ্বরীর পাটে সিঁদুর দেওয়া হয় এবং পুজো করা হয় । কোজাগরী পূর্ণিমা অর্থাৎ লক্ষ্মীপুজোর দিন প্রাচীন রীতি মেনে পাটখিলান অনুষ্ঠান পালন করা হয় । পাটখিলান অনুষ্ঠানের পরই শুরু হয়ে যায় মায়ের মৃন্ময়ীরূপ নির্মাণ । ওইদিন থেকে এক পক্ষকাল বা 15 দিন ধরে প্রতিমা তৈরি হয় ৷ এই আগমেশ্বরী মায়ের উচ্চতা প্রায় 16-18 ফুট ৷ মায়ের নয়নভোলানো জ্যোতি গোটা বঙ্গের ভক্তবৃন্দদের মোহিত করে ।
কালীপুজোর দিন মায়ের রঙ হয় এবং রাত্রে হয় চক্ষুদানপর্ব । দীপান্বিতা কালীপুজোর সমস্ত নিময় মেনেই নিষ্ঠার সঙ্গে পুজো হয় মায়ের । তন্ত্র মতে পুজো হয় মা আগমেশ্বরীর । রাত 9টার সময় বাড়ির সদস্যরা বড় গোস্বামী পরিবারের মাকে গহনা পরান ৷ নবসাজে সজ্জিত করেন দেবীকে । ভক্তদের দেওয়া দানে মাতা আগমেশ্বরীর মাতৃ মূর্তি সোনা এবং রুপোর অলংকারে মুড়ে ফেলা হয় । তারপর মৃৎশিল্পী সারাদিন উপবাস থেকে শুদ্ধবস্ত্র পরে মায়ের চক্ষুদান করেন । এরপর বড় গোস্বামী পরিবারের সদস্য মাকে সিঁদুর দান, গন্ধদান, আতরদান করেন ৷ তারপর মধ্যরাতে মায়ের পুজো শুরু হয় ৷ চলে ভোর পর্যন্ত ৷
আগমেশ্বরী কালীমাতার ভোগের বিশেষত্ব
মা আগমেশ্বরীর জন্য সম্পূর্ণ নিরামিষ ভোগ প্রদান করা হয় । দেবীকে 36 ব্যঞ্জনের ভোগ নিবেদন করা হয় ৷ অর্থাৎ যতরকমের শাকসবজি আছে সমস্ত রকমই ভোগ হয় ৷ রান্না করেন গোস্বামী বাড়ির দীক্ষিত গৃহবধূরাই । ভোগে থাকে তিন রকমের শাক (লালশাক, কচুরশাক, পালংশাক), শুক্তনি, বিভিন্ন রকমের ডাল (বিউলি, মুগ প্রভৃতি), চালকুমড়োর তরকারি, মিষ্টিকুমড়োর তরকারি, কচুরদম, বাঁধাকপির তরকারি, ছানার ডালনা, এঁচড়ের তরকারি, পোলাও, চালতার চাটনি, টম্যাটোর চাটনি, নানারকমের মিষ্টান্ন । এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ফল নিবেদন করা হয় মা আগমেশ্বরীকে ।

বলিপ্রথা ও ভোগ বিতরণ
মায়ের কাছে কোনোরকমের পশু বলি প্রথা নেই ৷ শুধুমাত্র দুটি আঁখ ও একটি চালকুমড়ো বলিদান হয় । প্রত্যেক বছরের মতো এ বছরও অসংখ্য ভক্ত বৃন্দদের জন্য প্রায় 14 কুইন্টাল ভোগ রন্ধন হবে । তার মধ্যে থাকবে এক কুইন্টাল কাজু ও দেড় কুইন্টাল ঘি ৷ এছাড়া দুই কুইন্টাল ময়দার লুচি ও প্রায় এক কুইন্টাল দুধের পায়েস হয় ভক্তদের মধ্যে বিতরণের জন্য ৷
বিসর্জন
মায়ের পুজোর পরের দিন বিসর্জনের শোভাযাত্রা পর্ব শুরু হয় । আগে মা আগমেশ্বরী কাঁধে করে বিসর্জনের পথে যেতেন ৷ এখন সেই প্রথা সময়ের পরিবর্তনে বন্ধ । এখন যানবাহনে করে বিসর্জনের পথে রওনা দেন মা । মাতৃ মূর্তির উচ্চতা বেশি হওয়ায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় বিসর্জনের পথে যাওয়া প্রত্যেকটি রাস্তার আলোর ।
পুজো কমিটির সদস্য রানাপ্রসাদ ভট্টাচার্য বলেন, "ভারতবর্ষের প্রথম আদি দক্ষিণাকালী হচ্ছে শ্রী শ্রী আগমেশ্বরী মাতা ৷ বৈষ্ণবমতে পূজিতা হন তিনি ৷" পুজো কমিটির সহ-সম্পাদক রমাপ্রসাদ ভট্টাচার্য ও সম্পাদক কাশীনাথ গোস্বামীর কথায়, "আমরা বড় গোস্বামী পরিবারের পরবর্তী প্রজন্ম ৷ আমরা এখন এই পুজো চালিয়ে যাচ্ছি ৷ এছাড়া শান্তিপুরের মানুষ মিলে উপদেষ্টামণ্ডলী গঠন করে এই পুজোর দায়িত্বভার সামলায় ৷ সকলে মিলে সুষ্ঠভাবে পুজো সম্পন্ন হয় ৷"

