কলকাতা, 12 এপ্রিল: ছয়টি নতুন পোকা বা বিটলের আবিষ্কার করল জুওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া এবং জার্মানির মিউজিয়াম এ. কোয়েং-এর গবেষক দল । এ বিষয়ে জুওটাক্সা জার্নালে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ পেয়েছে । উত্তর-পূর্ব ভারত ও পশ্চিমঘাট পর্বতমালা থেকে এই ছয়টি প্রজাতির পোকার খোঁজ মিলেছে ৷
ভারতে সেরিসিনি গোত্রের ছয়টি নতুন প্রজাতির এই বিটল উত্তর-পূর্ব ভারতের পশ্চিমঘাট পর্বতমালার ব্যতিক্রমী জীববৈচিত্র্যকে তুলে ধরে । এ কারণেই ওই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে আরও জানতে ধারাবাহিকভাবে গবেষণা ও সংরক্ষণ জরুরি বলেই মনে করছেন তাঁরা । গবেষকরা আরও মনে করছেন, এই আবিষ্কার ভারতের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য বোঝার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ । পরিবেশগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে চলমান গবেষণা ও সংরক্ষণ প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তাকে আরও বাড়িয়ে তোলে ।
নতুন শনাক্ত করা বিটল/পোকা প্রজাতিগুলো হল:
- মালাডেরা চাম্ফাইয়েনসিস (Maladera champhaiensis)
- নিওসেরিকা চুড়াচান্দপুরেনসিস (Neoserica churachandpurensis)
- মালাডেরা বারাসিংহা (Maladera barasingha)
- মালাডেরা লামলায়েনসিস (Maladera lumlaensis)
- সেরিকা সুবানসিরিয়েনসিস (Serica subansiriensis)
- মালাডেরা ওনাম (Maladera onam)
গবেষণা দলটিতে ছিলেন জুওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ড. দেবাংশু গুপ্ত, ড. দেবিকা ভুনিয়া এবং ড. কৈলাশ চন্দ্র এবং মিউজিয়াম এ. কোয়েং-এর ড. ডার্ক আহরেন্স । তারা কলকাতার জুওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া এবং মিউজিয়াম এ. কোয়েং, জার্মানির Coleoptera সেকশনে রক্ষিত বিটলের নমুনাগুলি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করেছেন ।

তাঁদের বিশ্লেষণ কেবল মালাডেরা, নিওসেরিকা এবং সেরিকা গোত্রের এই নতুন ছয়টি প্রজাতিকেই প্রকাশ করেনি, বরং 28টি অন্যান্য প্রজাতির নতুন আঞ্চলিক রেকর্ড নথিভুক্ত করেছে । যা এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ কীটকুল বা পোকা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে । দুই দেশের গবেষকদের এই পারস্পরিক আন্তর্জাতিক সহযোগিতা পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের অনুসন্ধান ও সংরক্ষণে বিশ্বব্যাপী অংশীদারিত্বের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তুলে ধরে ।
জুওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া কলকাতার অধিকর্তা ড. ধৃতি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "এই গবেষণা বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা উল্লেখ করে । বিশেষ করে কীটপতঙ্গের জীববৈচিত্র্যের চলমান অনুসন্ধান ও নথিবদ্ধকরণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে । এটি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ট্যাক্সোনমিক গবেষণা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার গুরুত্বের উপর আলোকপাত করে । প্রজাতিগুলিকে সঠিকভাবে সনাক্তকরণ ও নথিভুক্তকরণের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা সংরক্ষণ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করেন । আঞ্চলিক জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান আরও বৃদ্ধি করতে ও এর সুরক্ষার জন্য কৌশল প্রণয়ন করতে আমরা উত্তর-পূর্ব ভারতে নমুনা সংগ্রহের প্রচেষ্টা বৃদ্ধির আহ্বান জানাই ।"
নতুন প্রজাতির নামকরণ:
নতুন প্রজাতির নামকরণ প্রায়শই তাদের উৎস বা আঞ্চলিক তাৎপর্যকে প্রতিফলিত করে ৷
- মালাডেরা চাম্ফাইয়েনসিস: মিজোরামের চাম্ফাইয়ের নামে নামকরণ করা হয়েছে ।
- নিওসেরিকা চুড়াচান্দপুরেনসিস: মণিপুরের চুড়াচান্দপুরের নামে নামকরণ করা হয়েছে ।
- মালাডেরা বারাসিংহা: ভারতীয় জলাভূমির হরিণ (বারাসিংহা)-এর নামে নামকরণ করা হয়েছে ৷ কারণ বিটলটির এডিগাসের আকৃতি হরিণের শিং-এর মতো ।
- মালাডেরা লামলায়েনসিস: অরুণাচল প্রদেশের লামলার নামে নামকরণ করা হয়েছে ।
- সেরিকা সুবানসিরিয়েনসিস: অরুণাচল প্রদেশের সুবানসিরির নামে নামকরণ করা হয়েছে ।
- মালাডেরা ওনাম: কেরালার ওনাম উৎসবের নামে নামকরণ করা হয়েছে । যেখানে প্রজাতিটি পাওয়া গিয়েছে ।
গবেষকরা জীববৈচিত্র্য হটস্পট, সেরিসিনি বিটলের পরিবেশগত ভূমিকা (যার মধ্যে কিছু শস্যের ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ) এবং গুরুত্বপূর্ণ সংরক্ষণ কৌশল নির্ধারণের জন্য এই আবিষ্কারগুলির তাৎপর্যের উপর জোর দিয়েছেন । প্রজাতির সঠিক শনাক্তকরণ এবং বিস্তারের তথ্য প্রজাতির সংরক্ষণ স্থিতিশীলতা মূল্যায়ন এবং কার্যকর সুরক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য অত্যাবশ্যক ।
জুওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া কলকাতার Coleoptera সেকশনের বিজ্ঞানী এবং অফিসার-ইন-চার্জ ড. দেবাংশু গুপ্ত বলেন, "এই বিটল প্রজাতির বিস্তার সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনে অনেক সুবিধা আছে । সম্ভাব্য ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ প্রজাতিগুলিকে দ্রুত সনাক্তকরণ সম্ভব হয় । পরিবেশ-বান্ধব কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা কৌশল বিকাশের সুযোগ করে দেয়, যা মানব স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের উপর ক্ষতিকর রাসায়নিকের নির্ভরতা হ্রাস করে । এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ইকোটুরিজম উদ্যোগকে সমর্থন করে । স্থানীয় মানুষের জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করে এবং পরিবেশগত দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি করে ।"

তিনি আরও বলেন, "সেরিসিনির কিছু প্রজাতি শস্যের ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ । অন্যরা মাটির স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী । এ বিষয়ে জ্ঞান না থাকলে কৃষি পদ্ধতি বিকাশের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় । কারণ, এগুলির অনেক প্রজাতি কৃষকদের জীবিকার জন্য হুমকিস্বরূপ, সম্ভাব্য ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গের প্রাদুর্ভাব হ্রাস করার জন্য এবং বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।"

গবেষণায় গোয়ায় মালাডেরা বেঙ্গলেনসিস এবং মহারাষ্ট্রে এম. সিরিয়াটোগুটাটার নতুন রাজ্য রেকর্ডের কথাও জানানো হয়েছে, যা প্রজাতির বিস্তার সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানকে আরও সমৃদ্ধ করেছে ।
জীববৈচিত্র্যের তাৎপর্য এবং আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য:
এই আবিষ্কারগুলি ভারতের বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলের পরিবেশগত গুরুত্বের উপর জোর দেয় ৷

উত্তর-পূর্ব ভারত: হিমালয় জীববৈচিত্র্য হটস্পটের উল্লেখযোগ্য অংশ । এই অঞ্চলে মালাডেরা চাম্ফাইয়েনসিস, নিওসেরিকা চুড়াচান্দপুরেনসিস, মালাডেরা বারাসিংহা, মালাডেরা লামলায়েনসিস এবং সেরিকা সুবানসিরিয়েনসিসের আবিষ্কার এই ভঙ্গুর বাস্তুসংস্থানের অব্যাহত গবেষণা ও সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরে ।

কেরল এবং পশ্চিমঘাট পর্বতমালা: আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্য হটস্পট পশ্চিমঘাট । এই এলাকা অনন্য উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের জন্য বিখ্যাত । কেরল থেকে মালাডেরা ওনামের শনাক্তকরণ এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ কীট বৈচিত্র্য সম্পর্কে জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করে । ক্রমবর্ধমান পরিবেশগত চাপের মুখে সংরক্ষণ প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তার উপর আলোকপাত করে ।