কলকাতা, 15 মে: বাজার হোক বা মিষ্টির দোকান, কিংবা অটো হোক বা টোটো, সর্বত্রই এখন কিউ আর কোডের মাধ্যমে দাম বা ভাড়া মেটানো হয়ে থাকে । সঙ্গে একটা মুঠোফোন থাকলেই হল । টাকার ব্যাগ আর সঙ্গে নেওয়ার প্রয়োজনই নেই । এখন কেনাকাটাও একেবারে 'ক্যাসলেশ' ।
তবে অন্যান্য জায়গায় অনলাইন পেমেন্টের সুবিধা পাওয়া গেলেও বেসরকারি বাসে এই পরিষেবা এখনও প্রায় অমিল ৷ হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি বেসরকারি বাসে কিউআর কোডে ভাড়া মেটানোর সুযোগ রয়েছে । সব বেসরকারি বাসেই কি এই পরিষেবা থাকা উচিত ? এই নিয়ে এখনও পর্যন্ত দ্বিধাবিভক্ত বাস মালিকরা ৷

সরকারি ও বেসরকারি বাসে স্মার্ট টিকিটিং ব্যবস্থা চালু করার ক্ষেত্রে 2023 সালে দু-একটি সংস্থার পক্ষ থেকে পরিবহণ দফতরে প্রস্তাব জমা দেওয়া হয়েছিল । তাছাড়া ‘চলো’ নামক একটি অ্যাপ কয়েকটি বেসরকারি বাসে এই ব্যবস্থা চালুও হয়েছিল । কিন্তু সেই সুবিধা হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি বাসে চালু হয়েছিল । আর তারপর 'চলো' অ্যাপটি এই রাজ্যে বন্ধ হয়ে যায় । এরপর বাকি বাসে এই ব্যবস্থা বিস্তার করার বিষয়টিও মাঝপথেই থমকে যায় ।
একইভাবে ইউপিআই-এর মাধ্যমে ভাড়া মেটানোর বিষয়টিও আটকে রয়েছে ৷ অথচ বাসকর্মীদের একাংশের অভিযোগ, খুচরো নিয়ে ঝামেলা প্রায় রোজই লেগে থাকে ৷ অনেক সময় যাত্রীরা 10 টাকার টিকিটের জন্য 100 বা 500 টাকার নোট দেন ৷ আর বলেন, ‘খুচরো নেই’ ৷ তাছাড়া 10 বা 20 টাকার নোটের জরাজীর্ণ অবস্থা নিয়েও মাঝেমধ্যে যাত্রীদের সঙ্গে বাসকর্মীদের তুমুল ঝামেলা বেঁধে যায় ৷ এই সুযোগে অনেক যাত্রী টাকা না মিটিয়েই নেমে যান । কন্ডাক্টরেরও কিছু করার থাকে না ।

তাই এইসব ঝামেলা থেকে নিজেরা রেহাই পেতে এবং যাত্রীদের মুক্তি দিতে বেশ কিছু বেসরকারি বাস মালিক আবারও কিউআর কোডে ভাড়া নেওয়ার পরিষেবা চালু করেছেন । বাসের একেবারে সামনে বা যাত্রীদের সিটের উপরে লাগিয়ে রাখছেন কিউআর কোড । যাত্রীরা খুব সহজেই সেটিকে স্ক্যান করে এক নিমেষে মিটিয়ে দিতে পারছেন ভাড়া ।
সম্প্রতি বি গার্ডেন থেকে বারাসত রুটের 8টি বাসে এই পরিষেবা চালু হয়েছে । এছাড়াও বাঙ্গুর অ্য়াভিনিউ থেকে সাপুরজি রুটের KB16 বাসেও এই ডিজিটাল মাধ্যমে টিকিট কাটতে পারছেন যাত্রীরা । আবার ধামাখালি থেকে বারাসাত রুটের বাস DN16/1, মৌরিগ্রাম থেকে সল্টলেক রুটের মিনিবাস নম্বর 20A, রুইয়া পূর্বপাড়া থেকে হাওড়া রুটের 56 নম্বর বাস, বারাসত থেকে সাঁতরাগাছি রুটের বেশ কিছু বাসে এই পরিষেবা চালু করা হয়েছে ৷ একই পরিষেবা মিলছে বেলেঘাটা ইএম বাইপাস থেকে কলেজ মোড়ের বেশ কিছু বাসে । যদিও দূরপাল্লার একাধিক বাসে এই ব্যবস্থা রয়েছে ।

বাসমালিক সুমনকান্তি বসু জানিয়েছেন, প্রতিদিন একটি বাসে মোটামুটি হাজার টাকার মতো খুচরোর প্রয়োজন পড়ে । তাতেও খুচরো দিয়ে কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না । কারণ, 10 টাকা বা 12 টাকার টিকিটের জন্য যাত্রীরা 100 টাকা কিংবা 200 টাকা আবার কেউ কেউ 500 টাকার নোটও দিচ্ছেন । কন্ডাকটরদের কাছে কত খুচরো টাকা থাকতে পারে ? তাই তাঁরাও কিছু করতে পারেন না । আর এই সুযোগে অনেকেই ভাড়া না দিয়েই সফর করেন । অগত্যা এই সমস্যা এড়াতেই অ্যাপ নির্ভর হচ্ছেন মালিকরা ।
তিনি বলেন, ‘‘যেহেতু বাসের ব্যবসা মূলত কর্মী নির্ভর ৷ তাই অনেক ক্ষেত্রেই কর্মীরা দিনের শেষে যে ভাড়া হয় এবং টিকিট বেরোচ্ছে তাতে কারচুপি হয় । তাই সোজাসুজি মালিকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে যদি ভাড়া পড়ে, সেই ক্ষেত্রে কতগুলি টিকিট গেল এবং অ্যাকাউন্টে কত টাকা পড়ল, সেটা খুব সহজেই মিলিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় ।’’
মালিকপক্ষ আরও জানিয়েছে যে বহু বেসরকারি মালিক যেরকম এখনও তাঁদের বাসে পরিষেবা শুরু করেননি, তেমনি সারাদিনে এমন বহু যাত্রী ওঠেন যাঁদের কাছে স্মার্টফোন থাকে না । আবার অনেকের কাছে স্মার্টফোন থাকলেও ইউপিআই ব্যবহার করেন না ৷ বরং নগদ টাকা দিয়েই ভাড়া মেটান । দিনের শেষে যখন হিসাব মেলানো হয়, তখন ইউপিআই ট্রানজাকশনের এসএমএসের সঙ্গে ক’টা টিকিট বিক্রি হল, সেটা মিলিয়ে নেওয়াটা খুব একটা অসম্ভব কাজ হয় না । কারণ, এখনও পর্যন্ত তিন থেকে চার শতাংশ যাত্রীই বাসে উঠে অনলাইন পদ্ধতি ব্যবহার করে ভাড়া মেটান ।

তবে এতে সমস্যাও রয়েছে । যেমন অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে কিছু যাত্রী ইউপিআই-এর মাধ্যমে টিকিট ভাড়া হয়তো দিচ্ছেন ৷ কিন্তু সেই লেনদেন সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই তিনি বাস থেকে নেমে যাচ্ছেন এবং দিনের শেষে হিসাব মেলানোর সময় দেখা যায় যে টিকিট বিক্রি হলেও সেই ভাড়া টাকাটা অ্যাকাউন্টে আসেনি । সেই ক্ষেত্রে ক্ষতি হচ্ছে মালিকের ৷
অল বেঙ্গল বাস মিনিবাস সমন্বয় সমিতির সম্পাদক রাহুল চট্টোপাধ্যায় বলেন, "2023 সালে বেশ কিছু রুটে এই পরিষেবা চালু হয়েছিল ৷ তবে তারপর বন্ধ হয়ে যায় । খুচরো টাকার সমস্যা থেকে শুরু করে ছেঁড়াফাটা নোটের সমস্যা লেগেই থাকে বাসভাড়া মেটানোর ক্ষেত্রে । তাই এই সমস্যাগুলির থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য এবার কয়েকটি বেসরকারি বাস রুট পরীক্ষামূলকভাবে এই ব্যবস্থা চালু করেছে ।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত তেমন কোনও সমস্যা হয়নি ৷ তাই অন্যান্য বেসরকারি বাস মালিকরাও এই বিষয়টি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছেন । যদি এটা যাত্রীদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা পায় এবং কর্মচারীরা এই ব্যবস্থাকে রপ্ত করতে পারেন, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে অন্যান্য বেসরকারি বাস রুটেও এই পরিষেবা চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ।"
বাসমালিক নিখিলেশ মুখোপাধ্যায় নিজের বাসে এখনও এই পরিষেবা চালু করেননি ৷ তবে তিনি বলেন, "হাওড়া রুটেই একটি বাসে সম্প্রতি এই পরিষেবা চালু করা হয়েছে । বেশ ভালোই সাড়া মিলছে । তাই এবার আমার মতে অন্যান্য বেসরকারি বাস মালিকরাও এই ইউপিআই পরিষেবা চালু করার দিকে ভাবনাচিন্তা করছেন ।"