ETV Bharat / state

বনস্পতির আরাধনায় নববর্ষের সূচনা, 'সারহুল' পুজোয় মাতলেন আদিবাসীরা - SARHUL PUJA

'সারহুল' পুজোয় বলি দেওয়া হয় তিনটি রঙের মুরগি ৷ সঙ্গে প্রকৃতিকে অর্পণ করা হয় হাঁড়িয়া ৷ মাদলের তালে নেচে ওঠেন আদিবাসীরা ৷

Sarhul puja in Howrah
হাওড়ায় 'সারহুল' পুজোয় মেতে ওঠেন আদিবাসীরা (নিজস্ব ছবি)
author img

By ETV Bharat Bangla Team

Published : April 7, 2025 at 7:03 PM IST

3 Min Read

হাওড়া, 7 এপ্রিল: নববর্ষ মানেই একের পর এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, হালখাতা বা নতুন জামাকাপড়ের রীতি ৷ সেই ছবির বাইরে হাওড়ার বাঁকড়া দক্ষিণপল্লি এলাকায় নতুন বছর শুরু হল একেবারে অন্যভাবে । বনস্পতির পুজো দিয়ে ও প্রকৃতিকে সম্মান জানিয়ে । আদিবাসী আখড়া সংঘের উদ্যোগে রবিবার পালিত হল 'সারহুল', যা আদিবাসী সম্প্রদায়ের কাছে নতুন বছরের সূচনার এক পবিত্র দিন ।

চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিতে 'সারহুল' পুজো হয় ৷ এই উৎসবে মূর্তি পুজো নয়, আরাধনা করা হয় প্রকৃতিকে । শাল, মহুয়া প্রভৃতি গাছ এই পুজোর মূল উপাদান হলেও এদিন পূজিত হয় নিম, আমের মতো বনস্পতি । প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের বার্তাই এই পুজোর মর্মবাণী । 'সারহুল' পুজোর অন্যতম রীতির মধ্যে রয়েছে হাড়িয়া অর্ঘ্য দেওয়া ৷ পাশাপাশি এই পুজোয় বলি দেওয়া হয় তিনটি রঙের মুরগি । আদিবাসী সংস্কৃতিতে এই আচারই প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাবার উপায় । পুজোর পর চলে আনন্দোৎসব । মাদলের তালে নেচে ওঠেন পল্লির পুরুষ-নারী ও সব বয়সের মানুষ ।

বনস্পতির আরাধনায় নববর্ষের সূচনা আদিবাসীদের (ইটিভি ভারত)

বছরভর অপেক্ষা করা হয় এই একটি দিনের জন্য । গ্রামের পরিবেশে এখনও কেউ কেউ পুজোর আগে শিকারে বের হন । যদিও শহরের বুকেও এই শিকার সম্ভব নয় ৷ তাই তার থেকে বিরত থেকে অনেকে উপাচারের জোগান করেন বাজার থেকেই । 'সারহুল' একদিনের পুজো হলেও এর আবেদন গভীর । প্রকৃতিকে পুজোর মাধ্যমে নতুন বছরের সূচনা করে এই আদিবাসী রীতি যেন মনে করিয়ে দেয়, উন্নয়নের দৌড়ে প্রকৃতি যেন পিছিয়ে না পড়ে ।

এই 'সারহুল' উৎসব ঘিরে নানা মহলে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে । একদিকে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে এই সংস্কৃতিকে ঘিরে উচ্ছ্বাস, অন্যদিকে রাজনীতি ও সমাজতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকেও এসেছে মন্তব্য । স্থানীয় বাসিন্দা রঞ্জিত সরেন বলেন, "এই দিনটা আমাদের জীবনের সবচেয়ে পবিত্র দিন । প্রকৃতি আমাদের মা । ওঁকে না পুজো করে কীভাবে নববর্ষ শুরু করব?"

পল্লিরই আর এক বাসিন্দা ললিতা ওরাওঁ বলেন, "এটা আমাদের প্রকৃতির পুজো, সারহুল উৎসব ৷ এখানে আমরা প্রকৃতি বা সৃষ্টিকর্তাকে ধারমেশ বাবা ধারতি আয়ো রূপে পুজো করি ৷ ধারমেশ হল সূর্য, ধারতি আয়ো পৃথিবী বা মাতৃভূমিকে বলা হচ্ছে ৷ বছরের একবার চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিতে এই পুজো শুরু হয় ৷ ফল, ফুল অর্পণ করা হয় ৷ পাশাপাশি সাদা, লাল ও কালো তিন রঙের মুরগি বলি দেওয়া হয় ৷ সারাদিন উপোস করে এই পুজো হয় ৷ শহরের লোকেরা বুঝতে পারে না আমাদের সংস্কৃতির গভীরতা । কিন্তু আমরা যত দিন বেঁচে থাকব, তত দিন এই পুজো চলবে ।"

আদিবাসী আখড়া সংঘের সদস্য বৈদ্যনাথ সর্দার বলেন, "9 বছর ধরে আমরা এই পুজো করছি এখানে ৷ এই উৎসব কেবল একটা ধর্মীয় আচার নয়, এটা আদিবাসী অস্তিত্বের প্রতীক । শালগাছের নিচে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির কাছে মাথা নত করার মধ্যে দিয়েই আমরা জানিয়ে দিই এই মাটি আমাদের, এই জঙ্গল আমাদের । সরকার যদি আদিবাসী সংস্কৃতিকে স্বীকৃতি দিতে চায়, তবে সারহুলের মতো উৎসবগুলোতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি ।"

সমাজতত্ত্ববিদ ড. সুমনা পাল মন্তব্য করেন, "শহরের মধ্যে থেকেও যে আদিবাসী সম্প্রদায় নিজেদের সংস্কৃতি এত আন্তরিকতার সঙ্গে ধরে রেখেছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় । মূলধারার বাইরে থেকেও এঁদের উপস্থিতি আজ আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে ।" এইভাবেই একদিনের 'সারহুল' হয়ে উঠল আদিবাসী আত্মপরিচয়ের এক গর্বিত উৎসব ৷ যেখানে মাদল ও হাঁড়িয়া আর বনস্পতির পুজো মিলিয়ে রচিত হল প্রকৃতি আর সংস্কৃতির অপূর্ব সংলাপ ।

হাওড়া, 7 এপ্রিল: নববর্ষ মানেই একের পর এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, হালখাতা বা নতুন জামাকাপড়ের রীতি ৷ সেই ছবির বাইরে হাওড়ার বাঁকড়া দক্ষিণপল্লি এলাকায় নতুন বছর শুরু হল একেবারে অন্যভাবে । বনস্পতির পুজো দিয়ে ও প্রকৃতিকে সম্মান জানিয়ে । আদিবাসী আখড়া সংঘের উদ্যোগে রবিবার পালিত হল 'সারহুল', যা আদিবাসী সম্প্রদায়ের কাছে নতুন বছরের সূচনার এক পবিত্র দিন ।

চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিতে 'সারহুল' পুজো হয় ৷ এই উৎসবে মূর্তি পুজো নয়, আরাধনা করা হয় প্রকৃতিকে । শাল, মহুয়া প্রভৃতি গাছ এই পুজোর মূল উপাদান হলেও এদিন পূজিত হয় নিম, আমের মতো বনস্পতি । প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের বার্তাই এই পুজোর মর্মবাণী । 'সারহুল' পুজোর অন্যতম রীতির মধ্যে রয়েছে হাড়িয়া অর্ঘ্য দেওয়া ৷ পাশাপাশি এই পুজোয় বলি দেওয়া হয় তিনটি রঙের মুরগি । আদিবাসী সংস্কৃতিতে এই আচারই প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাবার উপায় । পুজোর পর চলে আনন্দোৎসব । মাদলের তালে নেচে ওঠেন পল্লির পুরুষ-নারী ও সব বয়সের মানুষ ।

বনস্পতির আরাধনায় নববর্ষের সূচনা আদিবাসীদের (ইটিভি ভারত)

বছরভর অপেক্ষা করা হয় এই একটি দিনের জন্য । গ্রামের পরিবেশে এখনও কেউ কেউ পুজোর আগে শিকারে বের হন । যদিও শহরের বুকেও এই শিকার সম্ভব নয় ৷ তাই তার থেকে বিরত থেকে অনেকে উপাচারের জোগান করেন বাজার থেকেই । 'সারহুল' একদিনের পুজো হলেও এর আবেদন গভীর । প্রকৃতিকে পুজোর মাধ্যমে নতুন বছরের সূচনা করে এই আদিবাসী রীতি যেন মনে করিয়ে দেয়, উন্নয়নের দৌড়ে প্রকৃতি যেন পিছিয়ে না পড়ে ।

এই 'সারহুল' উৎসব ঘিরে নানা মহলে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে । একদিকে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে এই সংস্কৃতিকে ঘিরে উচ্ছ্বাস, অন্যদিকে রাজনীতি ও সমাজতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকেও এসেছে মন্তব্য । স্থানীয় বাসিন্দা রঞ্জিত সরেন বলেন, "এই দিনটা আমাদের জীবনের সবচেয়ে পবিত্র দিন । প্রকৃতি আমাদের মা । ওঁকে না পুজো করে কীভাবে নববর্ষ শুরু করব?"

পল্লিরই আর এক বাসিন্দা ললিতা ওরাওঁ বলেন, "এটা আমাদের প্রকৃতির পুজো, সারহুল উৎসব ৷ এখানে আমরা প্রকৃতি বা সৃষ্টিকর্তাকে ধারমেশ বাবা ধারতি আয়ো রূপে পুজো করি ৷ ধারমেশ হল সূর্য, ধারতি আয়ো পৃথিবী বা মাতৃভূমিকে বলা হচ্ছে ৷ বছরের একবার চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিতে এই পুজো শুরু হয় ৷ ফল, ফুল অর্পণ করা হয় ৷ পাশাপাশি সাদা, লাল ও কালো তিন রঙের মুরগি বলি দেওয়া হয় ৷ সারাদিন উপোস করে এই পুজো হয় ৷ শহরের লোকেরা বুঝতে পারে না আমাদের সংস্কৃতির গভীরতা । কিন্তু আমরা যত দিন বেঁচে থাকব, তত দিন এই পুজো চলবে ।"

আদিবাসী আখড়া সংঘের সদস্য বৈদ্যনাথ সর্দার বলেন, "9 বছর ধরে আমরা এই পুজো করছি এখানে ৷ এই উৎসব কেবল একটা ধর্মীয় আচার নয়, এটা আদিবাসী অস্তিত্বের প্রতীক । শালগাছের নিচে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির কাছে মাথা নত করার মধ্যে দিয়েই আমরা জানিয়ে দিই এই মাটি আমাদের, এই জঙ্গল আমাদের । সরকার যদি আদিবাসী সংস্কৃতিকে স্বীকৃতি দিতে চায়, তবে সারহুলের মতো উৎসবগুলোতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি ।"

সমাজতত্ত্ববিদ ড. সুমনা পাল মন্তব্য করেন, "শহরের মধ্যে থেকেও যে আদিবাসী সম্প্রদায় নিজেদের সংস্কৃতি এত আন্তরিকতার সঙ্গে ধরে রেখেছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় । মূলধারার বাইরে থেকেও এঁদের উপস্থিতি আজ আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে ।" এইভাবেই একদিনের 'সারহুল' হয়ে উঠল আদিবাসী আত্মপরিচয়ের এক গর্বিত উৎসব ৷ যেখানে মাদল ও হাঁড়িয়া আর বনস্পতির পুজো মিলিয়ে রচিত হল প্রকৃতি আর সংস্কৃতির অপূর্ব সংলাপ ।

ETV Bharat Logo

Copyright © 2025 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.