ETV Bharat / state

আবির বা রং নয়, বাহা পরবে ফুলের রেণু দিয়ে জল খেলায় মাতোয়ারা আদিবাসীরা - BAHA PARAB

প্রকৃতিকে ধারণ করেই চলে জীবনযাত্রা । তাই আবির বা রং নয়, আদিবাসীদের বাহা পরবে ফুলের রেণু দিয়ে হয় জল খেলা ৷ থাকে মাংসের পিঠে ৷

Baha parab
বসন্তকালে বাহা পরবে মেতে উঠেছে আদিবাসী সমাজ (নিজস্ব ছবি)
author img

By ETV Bharat Bangla Team

Published : March 15, 2025 at 12:28 PM IST

4 Min Read

আসানসোল, 15 মার্চ: প্রকৃতিই তাঁদের কাছে ঈশ্বর । প্রকৃতিকেই ধারণ করে থাকেন তাঁরা । আর তাই দোল পূর্ণিমায় আবির বা রং নয়, বিশেষ বাহা উৎসবে একে অন্যকে শাল ফুলের রেণু মিশ্রিত জল ঢেলেই রাঙিয়ে নেওয়া হয় ।

বিচিত্র এই রীতি দেখা যায় পশ্চিম বর্ধমান জেলার আসানসোলের আদিবাসী গ্রামগুলোতে । তিনদিনের এই বাহা পরবে পরিবার নিয়ে আনন্দ, নাচ, গানে মেতে ওঠেন আদিবাসীরা ।

বাহা উৎসবে ফুলের রেণু দিয়ে জল খেলা হয় (ইটিভি ভারত)

কী এই বাহা পরব

একদিকে যখন গোটা দেশ জুড়ে দোল ও হোলি খেলার আনন্দ, তখন আদিবাসী গ্রামে গ্রামে বাহা উৎসবে মেতে ওঠেন বাসিন্দারা । পূর্ণিমা ঘিরেই তিনদিনের এই বাহা পরব । বাড়ির পুরুষেরা প্রথম দিন যান শাল ফুলের রেণু সংগ্রহ করতে । পাশাপাশি শাল গাছের তলায় তাদের দেবতার স্থানটিকেও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয় ।

Baha parab
শাল ফুল বাহা পরবের মূল আকর্ষণ (নিজস্ব ছবি)

দ্বিতীয় দিনে শাল ফুল দিয়ে পুজো অর্চনা করা হয় । খিচুড়ি ভোগ হয় এদিন । সন্ধ্যায় প্রতি বাড়িতে জল ও পুজোর ফুল পৌঁছনো হয় । পরের দিন অর্থাৎ শেষদিন পালিত হয় বাস্কি মাহা । অফুরান আনন্দ ও নাচ গানের মধ্য দিয়ে সকাল থেকে শুরু হয় উৎসব । শেষে একে অন্যকে ফুলের রেণু মেশানো জল ঢালা হয় ।

Baha parab
ধামসা মাদল সহযোগে নাচ চলে বাহা উৎসবে (নিজস্ব ছবি)

তবে যে কেউ কাউকে জল দিতে পারেন না । সম্পর্ক যাঁদের আছে, তাঁরাই একে অন্যকে জল দিতে পারেন । ছোটরা বড়দের মাথায় জল ঢেলে প্রণাম করে । বড়রাও জল ঢেলে পালটা আশীর্বাদ দেয় । আসানসোলের হীরাপুরের হারামডি গ্রামে এই রঙিন বাহা উৎসব দেখতে মানুষের ঢল নামে ।

বাহা পরবের রীতিনীতি

গ্রামের প্রবীণ মানুষেরা জানাচ্ছেন, এই উৎসব আসলে সৃষ্টির উৎসব । এই বসন্তকালে পাতা, মুকুল প্রস্ফুটিত হয় । ফুল ফোটে । শাল, পলাশের ফুলে ভরে ওঠে জঙ্গল । যে ফুল ও পাতা গজায় এই ঋতুতে, তাকে ব্যবহারের আগে প্রকৃতির সেই নতুন সৃষ্টিকে সম্মান জানাতেই এই বাহা উৎসব পালিত হয় ।

Baha parab
আদিবাসী নৃত্যে মজে মহিলারা (নিজস্ব ছবি)

তিনদিন এই উৎসব পালিত হয় । প্রথম দিনে আচার আচরণকে বলা হয় জাহের দাব । শাল গাছের গুড়ির নীচে খড়ের একচালা ছোট আচ্ছাদন বা জাহের বানানো হয় । পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সেই জায়গাটিকে শুদ্ধ করে তোলা হয় ৷ সেখানেই দ্বিতীয় দিন পুজো-অর্চনা ও আরাধনা করা হয় । সেই রীতিকে বলা সারদি মাহা ।

Baha parab
তিনদিন পালন হয় এই বাহা পরব (নিজস্ব ছবি)

তৃতীয় দিনের রীতিকে বলা হয় বাহা বাস্কি মাহা বা বাহা সেঁদড়া মাহা । বাংলায় পূর্নিমা তিথিকে সাঁওতালি ভাষায় অতকুনামি বলা হয় । এই অতকুনামির দিন শিকার বা সেঁদড়া প্রথার চল আছে । যদিও কালের নিয়মে সেই সেঁদড়া বা শিকার এখন অবলুপ্ত প্রায় । কিন্তু সেঁদড়া মানে অন্বেষণও । গাছ, গাছালি, ছাল, বাকল, ফল যা বিভিন্ন ওষুধের কাজে লাগে, সেই অন্বেষণ যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে । সেটাই সেঁদড়া মাহা । আগের রাতে 'নাইকে বাবা' বা ভক্তরা বাড়িতে বাড়িতে ফুল দিয়ে যায় ৷ সেই বাসি ফুল দিয়ে পরের দিন জলে মিশিয়ে ফুলের রেণু জল খেলা হয় । সঙ্গে চলে অফুরান আনন্দের নাচ, গান । ধামসা মাদলের তালে মত্ত হয়ে ওঠে পুরুষ নারী সবাই ।

কী বলছেন উৎসবে অংশগ্রহণকারীরা

গ্রামের বাসিন্দা মতিলাল সোরেন বলেন, "বিচিত্র এই উৎসব । প্রকৃতিকে অন্বেষণ করেই এই উৎসব পালিত হয় । তিনদিনের এই উৎসবে একদিকে যেমন ধর্মীয় আচার ও পুজো অর্চনা হয়, তেমনই তার পাশাপাশি আনন্দ, নাচে, গানে মেতে ওঠেন সবাই । তবে আমাদের এই উৎসবে কোনও রং বা আবির ব্যবহার হয় না । কারণ, ওগুলি প্রাকৃতিক নয় । আমরা জল ও শাল ফুলের রেণু দিয়েই বাহা উৎসব পালিত করি ।"

Baha parab
ফুলের রেণু দিয়ে জল ঢেলে পালিত হয় বাহা উৎসব (নিজস্ব ছবি)

গ্রামের যুবতী পূর্ণিমা সোরেনের কথায়, "খুব আনন্দ হয় এই তিনদিন ধরে । আমরা শেষদিনে ফুলের রেণু মেশানো জল খেলি । পাশাপাশি নাচ করি, গান গাই । আমরা আবির বা রং খেলি না ।"

আরেক যুবতী আরশি হাঁসদা বলেন, "এই বাহা উৎসবে খিচুড়ি ভোগ তো হয়ই, তার পাশাপাশি আমরা এই উৎসবে পাতড়া পিঠে খাই । মাংস দিয়ে এই বিশেষ পিঠে তৈরি হয় । সাড়ে তিনশো গ্রামে একসঙ্গে এই বাহা উৎসব পালিত হয় ।"

আসানসোল, 15 মার্চ: প্রকৃতিই তাঁদের কাছে ঈশ্বর । প্রকৃতিকেই ধারণ করে থাকেন তাঁরা । আর তাই দোল পূর্ণিমায় আবির বা রং নয়, বিশেষ বাহা উৎসবে একে অন্যকে শাল ফুলের রেণু মিশ্রিত জল ঢেলেই রাঙিয়ে নেওয়া হয় ।

বিচিত্র এই রীতি দেখা যায় পশ্চিম বর্ধমান জেলার আসানসোলের আদিবাসী গ্রামগুলোতে । তিনদিনের এই বাহা পরবে পরিবার নিয়ে আনন্দ, নাচ, গানে মেতে ওঠেন আদিবাসীরা ।

বাহা উৎসবে ফুলের রেণু দিয়ে জল খেলা হয় (ইটিভি ভারত)

কী এই বাহা পরব

একদিকে যখন গোটা দেশ জুড়ে দোল ও হোলি খেলার আনন্দ, তখন আদিবাসী গ্রামে গ্রামে বাহা উৎসবে মেতে ওঠেন বাসিন্দারা । পূর্ণিমা ঘিরেই তিনদিনের এই বাহা পরব । বাড়ির পুরুষেরা প্রথম দিন যান শাল ফুলের রেণু সংগ্রহ করতে । পাশাপাশি শাল গাছের তলায় তাদের দেবতার স্থানটিকেও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয় ।

Baha parab
শাল ফুল বাহা পরবের মূল আকর্ষণ (নিজস্ব ছবি)

দ্বিতীয় দিনে শাল ফুল দিয়ে পুজো অর্চনা করা হয় । খিচুড়ি ভোগ হয় এদিন । সন্ধ্যায় প্রতি বাড়িতে জল ও পুজোর ফুল পৌঁছনো হয় । পরের দিন অর্থাৎ শেষদিন পালিত হয় বাস্কি মাহা । অফুরান আনন্দ ও নাচ গানের মধ্য দিয়ে সকাল থেকে শুরু হয় উৎসব । শেষে একে অন্যকে ফুলের রেণু মেশানো জল ঢালা হয় ।

Baha parab
ধামসা মাদল সহযোগে নাচ চলে বাহা উৎসবে (নিজস্ব ছবি)

তবে যে কেউ কাউকে জল দিতে পারেন না । সম্পর্ক যাঁদের আছে, তাঁরাই একে অন্যকে জল দিতে পারেন । ছোটরা বড়দের মাথায় জল ঢেলে প্রণাম করে । বড়রাও জল ঢেলে পালটা আশীর্বাদ দেয় । আসানসোলের হীরাপুরের হারামডি গ্রামে এই রঙিন বাহা উৎসব দেখতে মানুষের ঢল নামে ।

বাহা পরবের রীতিনীতি

গ্রামের প্রবীণ মানুষেরা জানাচ্ছেন, এই উৎসব আসলে সৃষ্টির উৎসব । এই বসন্তকালে পাতা, মুকুল প্রস্ফুটিত হয় । ফুল ফোটে । শাল, পলাশের ফুলে ভরে ওঠে জঙ্গল । যে ফুল ও পাতা গজায় এই ঋতুতে, তাকে ব্যবহারের আগে প্রকৃতির সেই নতুন সৃষ্টিকে সম্মান জানাতেই এই বাহা উৎসব পালিত হয় ।

Baha parab
আদিবাসী নৃত্যে মজে মহিলারা (নিজস্ব ছবি)

তিনদিন এই উৎসব পালিত হয় । প্রথম দিনে আচার আচরণকে বলা হয় জাহের দাব । শাল গাছের গুড়ির নীচে খড়ের একচালা ছোট আচ্ছাদন বা জাহের বানানো হয় । পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সেই জায়গাটিকে শুদ্ধ করে তোলা হয় ৷ সেখানেই দ্বিতীয় দিন পুজো-অর্চনা ও আরাধনা করা হয় । সেই রীতিকে বলা সারদি মাহা ।

Baha parab
তিনদিন পালন হয় এই বাহা পরব (নিজস্ব ছবি)

তৃতীয় দিনের রীতিকে বলা হয় বাহা বাস্কি মাহা বা বাহা সেঁদড়া মাহা । বাংলায় পূর্নিমা তিথিকে সাঁওতালি ভাষায় অতকুনামি বলা হয় । এই অতকুনামির দিন শিকার বা সেঁদড়া প্রথার চল আছে । যদিও কালের নিয়মে সেই সেঁদড়া বা শিকার এখন অবলুপ্ত প্রায় । কিন্তু সেঁদড়া মানে অন্বেষণও । গাছ, গাছালি, ছাল, বাকল, ফল যা বিভিন্ন ওষুধের কাজে লাগে, সেই অন্বেষণ যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে । সেটাই সেঁদড়া মাহা । আগের রাতে 'নাইকে বাবা' বা ভক্তরা বাড়িতে বাড়িতে ফুল দিয়ে যায় ৷ সেই বাসি ফুল দিয়ে পরের দিন জলে মিশিয়ে ফুলের রেণু জল খেলা হয় । সঙ্গে চলে অফুরান আনন্দের নাচ, গান । ধামসা মাদলের তালে মত্ত হয়ে ওঠে পুরুষ নারী সবাই ।

কী বলছেন উৎসবে অংশগ্রহণকারীরা

গ্রামের বাসিন্দা মতিলাল সোরেন বলেন, "বিচিত্র এই উৎসব । প্রকৃতিকে অন্বেষণ করেই এই উৎসব পালিত হয় । তিনদিনের এই উৎসবে একদিকে যেমন ধর্মীয় আচার ও পুজো অর্চনা হয়, তেমনই তার পাশাপাশি আনন্দ, নাচে, গানে মেতে ওঠেন সবাই । তবে আমাদের এই উৎসবে কোনও রং বা আবির ব্যবহার হয় না । কারণ, ওগুলি প্রাকৃতিক নয় । আমরা জল ও শাল ফুলের রেণু দিয়েই বাহা উৎসব পালিত করি ।"

Baha parab
ফুলের রেণু দিয়ে জল ঢেলে পালিত হয় বাহা উৎসব (নিজস্ব ছবি)

গ্রামের যুবতী পূর্ণিমা সোরেনের কথায়, "খুব আনন্দ হয় এই তিনদিন ধরে । আমরা শেষদিনে ফুলের রেণু মেশানো জল খেলি । পাশাপাশি নাচ করি, গান গাই । আমরা আবির বা রং খেলি না ।"

আরেক যুবতী আরশি হাঁসদা বলেন, "এই বাহা উৎসবে খিচুড়ি ভোগ তো হয়ই, তার পাশাপাশি আমরা এই উৎসবে পাতড়া পিঠে খাই । মাংস দিয়ে এই বিশেষ পিঠে তৈরি হয় । সাড়ে তিনশো গ্রামে একসঙ্গে এই বাহা উৎসব পালিত হয় ।"

ETV Bharat Logo

Copyright © 2025 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.