আসানসোল, 15 মার্চ: প্রকৃতিই তাঁদের কাছে ঈশ্বর । প্রকৃতিকেই ধারণ করে থাকেন তাঁরা । আর তাই দোল পূর্ণিমায় আবির বা রং নয়, বিশেষ বাহা উৎসবে একে অন্যকে শাল ফুলের রেণু মিশ্রিত জল ঢেলেই রাঙিয়ে নেওয়া হয় ।
বিচিত্র এই রীতি দেখা যায় পশ্চিম বর্ধমান জেলার আসানসোলের আদিবাসী গ্রামগুলোতে । তিনদিনের এই বাহা পরবে পরিবার নিয়ে আনন্দ, নাচ, গানে মেতে ওঠেন আদিবাসীরা ।
কী এই বাহা পরব
একদিকে যখন গোটা দেশ জুড়ে দোল ও হোলি খেলার আনন্দ, তখন আদিবাসী গ্রামে গ্রামে বাহা উৎসবে মেতে ওঠেন বাসিন্দারা । পূর্ণিমা ঘিরেই তিনদিনের এই বাহা পরব । বাড়ির পুরুষেরা প্রথম দিন যান শাল ফুলের রেণু সংগ্রহ করতে । পাশাপাশি শাল গাছের তলায় তাদের দেবতার স্থানটিকেও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয় ।

দ্বিতীয় দিনে শাল ফুল দিয়ে পুজো অর্চনা করা হয় । খিচুড়ি ভোগ হয় এদিন । সন্ধ্যায় প্রতি বাড়িতে জল ও পুজোর ফুল পৌঁছনো হয় । পরের দিন অর্থাৎ শেষদিন পালিত হয় বাস্কি মাহা । অফুরান আনন্দ ও নাচ গানের মধ্য দিয়ে সকাল থেকে শুরু হয় উৎসব । শেষে একে অন্যকে ফুলের রেণু মেশানো জল ঢালা হয় ।

তবে যে কেউ কাউকে জল দিতে পারেন না । সম্পর্ক যাঁদের আছে, তাঁরাই একে অন্যকে জল দিতে পারেন । ছোটরা বড়দের মাথায় জল ঢেলে প্রণাম করে । বড়রাও জল ঢেলে পালটা আশীর্বাদ দেয় । আসানসোলের হীরাপুরের হারামডি গ্রামে এই রঙিন বাহা উৎসব দেখতে মানুষের ঢল নামে ।
বাহা পরবের রীতিনীতি
গ্রামের প্রবীণ মানুষেরা জানাচ্ছেন, এই উৎসব আসলে সৃষ্টির উৎসব । এই বসন্তকালে পাতা, মুকুল প্রস্ফুটিত হয় । ফুল ফোটে । শাল, পলাশের ফুলে ভরে ওঠে জঙ্গল । যে ফুল ও পাতা গজায় এই ঋতুতে, তাকে ব্যবহারের আগে প্রকৃতির সেই নতুন সৃষ্টিকে সম্মান জানাতেই এই বাহা উৎসব পালিত হয় ।

তিনদিন এই উৎসব পালিত হয় । প্রথম দিনে আচার আচরণকে বলা হয় জাহের দাব । শাল গাছের গুড়ির নীচে খড়ের একচালা ছোট আচ্ছাদন বা জাহের বানানো হয় । পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সেই জায়গাটিকে শুদ্ধ করে তোলা হয় ৷ সেখানেই দ্বিতীয় দিন পুজো-অর্চনা ও আরাধনা করা হয় । সেই রীতিকে বলা সারদি মাহা ।

তৃতীয় দিনের রীতিকে বলা হয় বাহা বাস্কি মাহা বা বাহা সেঁদড়া মাহা । বাংলায় পূর্নিমা তিথিকে সাঁওতালি ভাষায় অতকুনামি বলা হয় । এই অতকুনামির দিন শিকার বা সেঁদড়া প্রথার চল আছে । যদিও কালের নিয়মে সেই সেঁদড়া বা শিকার এখন অবলুপ্ত প্রায় । কিন্তু সেঁদড়া মানে অন্বেষণও । গাছ, গাছালি, ছাল, বাকল, ফল যা বিভিন্ন ওষুধের কাজে লাগে, সেই অন্বেষণ যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে । সেটাই সেঁদড়া মাহা । আগের রাতে 'নাইকে বাবা' বা ভক্তরা বাড়িতে বাড়িতে ফুল দিয়ে যায় ৷ সেই বাসি ফুল দিয়ে পরের দিন জলে মিশিয়ে ফুলের রেণু জল খেলা হয় । সঙ্গে চলে অফুরান আনন্দের নাচ, গান । ধামসা মাদলের তালে মত্ত হয়ে ওঠে পুরুষ নারী সবাই ।
কী বলছেন উৎসবে অংশগ্রহণকারীরা
গ্রামের বাসিন্দা মতিলাল সোরেন বলেন, "বিচিত্র এই উৎসব । প্রকৃতিকে অন্বেষণ করেই এই উৎসব পালিত হয় । তিনদিনের এই উৎসবে একদিকে যেমন ধর্মীয় আচার ও পুজো অর্চনা হয়, তেমনই তার পাশাপাশি আনন্দ, নাচে, গানে মেতে ওঠেন সবাই । তবে আমাদের এই উৎসবে কোনও রং বা আবির ব্যবহার হয় না । কারণ, ওগুলি প্রাকৃতিক নয় । আমরা জল ও শাল ফুলের রেণু দিয়েই বাহা উৎসব পালিত করি ।"

গ্রামের যুবতী পূর্ণিমা সোরেনের কথায়, "খুব আনন্দ হয় এই তিনদিন ধরে । আমরা শেষদিনে ফুলের রেণু মেশানো জল খেলি । পাশাপাশি নাচ করি, গান গাই । আমরা আবির বা রং খেলি না ।"
আরেক যুবতী আরশি হাঁসদা বলেন, "এই বাহা উৎসবে খিচুড়ি ভোগ তো হয়ই, তার পাশাপাশি আমরা এই উৎসবে পাতড়া পিঠে খাই । মাংস দিয়ে এই বিশেষ পিঠে তৈরি হয় । সাড়ে তিনশো গ্রামে একসঙ্গে এই বাহা উৎসব পালিত হয় ।"