সিউড়ি, 26 মার্চ: খনি এলাকায় পাথর কাটতে গিয়ে বিপুল পরিমাণ ধুলো উৎপন্ন হয় ৷ তাই খনির কাজে যুক্ত শ্রমিকরা অধিকাংশ সময় সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত হন ৷ খনি অঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যেও এই রোগ দেখা যায় ৷ প্রতি বছর সিলিকোসিসের কোপে মৃত্যু হয় বহু মানুষের ৷ বিশেষজ্ঞদের মতে, ঠিক এই রকম পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বীরভূমে এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লাখনি দেউচা পাচামিতে ৷
এমতাবস্থায় প্রস্তাবিত কোল ব্লক এলাকার বাসিন্দাদের এই রোগ সম্পর্কে সতর্ক করতে গিয়েছিল এগারোটি বাম শ্রমিক সংগঠনের একটি কো-অর্ডিনেশন কমিটি ৷ এই মর্মে বীরভূম জেলাশাসক বিধান রায়কে আগাম জানিয়েছিলেন কমিটির সদস্যরা ৷ বুধবার দুপুরে কমিটির 50 জন সদস্য দেউচা পাচামি যাওয়ার উদ্দেশে বীরভূমের সিউড়ি স্টেশনে নামেন ৷
এদিকে তাঁদের আটকাতে স্টেশনে হাজির ছিলেন তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরা ৷ সদস্যরা স্টেশনে নামতেই তাঁদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখায় তৃণমূল ৷ কোর্ডিনেশন কমিটি দেউচা-পাচামি যেতে চাইলে তাদের পথ রুখে দাঁড়ান শাসকদলের কর্মী-সমর্থকরা ৷ পরিস্থিতি এমনই হয় যে 50 জন প্রতিনিধি ফিরতি ট্রেনে উঠতে বাধ্য হন ৷ এমনকী পুলিশ এই ঘটনায় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বাম সংগঠনের সদস্যরা ৷
বিক্ষোভকারী শিবরাম হেমব্রম বলেন, "আমরা দেউচা-পাচামি প্রস্তাবিত কোল ব্লক এলাকার বাসিন্দা ৷ আমরা চাই শিল্প হোক ৷ আমাদের কাছে খবর ছিল, কয়েকজন বহিরাগত প্রস্তাবিত কোল ব্লক এলাকায় গিয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি করবেন ৷ সেই খবর পেয়ে আমরা তড়িঘড়ি রেল স্টেশনে আসি ৷ তাঁরা কলকাতা থেকে এসেছেন ৷ আমরা তাঁদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই ৷ তাঁদের আমরা প্রস্তাবিত কোল ব্লক এলাকায় যেতে দেব না ৷ তাঁরা সিপিএমের লোকজন ৷ তাঁরা শিল্প চান না ৷"
কো-অর্ডিনেশন কমিটির অভিযোগ, স্টেশনে ট্রেন থেকে তারা নামতেই তৃণমূলের লোকজন বিক্ষোভ দেখানো শুরু করে ৷ পরে ঘটনাস্থলে পুলিশ এসে পৌঁছয় কিন্তু তাতে কোনও সুরাহা হয়নি ৷ কমিটির তরফে সৌরভ চক্রবর্তী বলেন, "আমাদের কমিটিতে শ্রমিক সংগঠন থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ, নদী বাঁচাও এবং জীবন বাঁচাও কমিটির মতো আরও অনেক সংগঠন রয়েছে ৷ স্বাস্থ্য-বিজ্ঞানের প্রচার থেকে শুরু করে শ্রমিকের অধিকার রক্ষা নিয়ে আমরা কাজ কররি ৷ দীর্ঘদিন ধরে আমরা সিলিকোসিস নিয়ে কাজ করছি ৷ এখানে প্রায় 40-42 লক্ষ টন পাথর কাটা হবে ৷ এই ধুলো উড়ে মানুষের ফুসফুসের ক্ষতি হবে ৷ এটা সিলিকোসিসের কারণ ৷"
তিনি আরও বলেন, "আমরা আন্দোলন করার পর দেখতে পাচ্ছি, এখানে সরকারিভাবে কয়েকজন সিলিকোসিস রোগীকে চিহ্নিত করা হয়েছে ৷ এই রোগীর সংখ্যাটা আরও অনেক বাড়বে ৷ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দেউচা-পাচামিতে নাকি দারুণ কাজ হচ্ছে ৷ সবাই খুশি ৷ চাকরি হবে ৷ সবাই শিল্প চায় ৷ যদি তাই হয় তাহলে কোন ভয়ে আমাদের এলাকায় যেতে দেওয়া হল না ? আমরা এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলতে যেতে পারব না ? সরকারের হয়েও সিলিকোসিস নিয়ে কাজ আমরা করেছি ৷ সরকার এটা জানে ৷
শাসকদলের কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়ে সৌরভ চক্রবর্তী বলেন, "কয়েকশো মানুষের সিলিকোসিস হয়েছে ৷ 50 জনের মৃত্যু হয়েছে ৷ তাঁদের পরিবারকে রেশন দেওয়া, ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কাজ বছরের পর বছর ধরে করে যাচ্ছি ৷ আমাদের আটকে দিল ৷ প্রশাসন কোথায় ছিল ? পুলিশ কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রইল ৷ কার্যত ওদের (বিক্ষোভকারীদের) হাতে আমাদের তুলে দিল ৷ ওরাও বলছে ট্রেনে উঠুন, পুলিশও বলছে ট্রেনে উঠুন ৷ আমরা ফিরে যাচ্ছি ৷ কলকাতায় গিয়ে প্রশাসনের শীর্ষস্তরে জানাব ৷"
সরকারকে আক্রমণ করে কো-অর্ডিনেশন কমিটির সদস্য আরও বলেন, "এটা কার ব্যর্থতা ? এই ব্যর্থতার দায় বীরভূম জেলা প্রশাসনের ৷ স্থানীয় থানার ওসিকে খুঁজে পাওয়া গেল না ৷ আমরা কোনও গাড়ি নিতে পারলাম না ৷ বাইরে থেকে এসে দেউচা-পাচামিতে যাব ভেবেছিলাম ৷ আমরা বললাম, আমাদের ডিএম অফিসে যেতে দেওয়া হোক ৷ সেটাও করতে দেওয়া হল না ৷ প্রশাসন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে করল এটা ৷ এর দায় তাদের ৷"
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম খোলা মুখ কয়লা খনি হতে চলেছে বীরভূমের দেউচা-পাচামি ৷ কিন্তু, খনির প্রস্তাবের প্রথম দিন থেকেই এলাকার বাসিন্দাদের একটি বড় অংশ এর বিরোধিতা করছেন ৷ বাসিন্দাদের বক্তব্য স্পষ্ট, এখানে খোলামুখ কয়লা খনি হলে প্রায় কুড়িটি গ্রামকে অন্যত্র সরাতে হবে ৷ গ্রামগুলিতে কমপক্ষে 21 হাজার মানুষের বাস ৷ যাঁদের মধ্যে অধিকাংশ আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রাম ৷ এছাড়া, ধ্বংস হবে প্রাকৃতিক পরিবেশ, বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল, জলাভূমি, চারণভূমি ৷ জলস্তর নীচে নেমে যাবে প্রভৃতি ৷ তাই প্রথম থেকেই জমি দিতে নারাজ আদিবাসীদের একটা বড় অংশ ৷