হাবরা, 16 মার্চ: স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে একদিন মস্ত বড় ফুটবলার হবেন । হাল ধরবেন সংসার ও সমাজের । সেই ফুটবল খেলার মাঠেই তাঁর জীবন ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছে । কোমর থেকে দু'পায়ের শক্তি হারিয়েছেন । সেই যন্ত্রণা সহ্য করতে না-পেরে তিনবার চরম পদক্ষেপের চেষ্টা করেছেন । শেষে একদিন নিজেই ঘুরে দাঁড়ান । তিন চাকার সাইকেলে ভর দিয়েই ফের জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন উত্তর 24 পরগনার হাবরার কুশল মণ্ডল । শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, অনলাইন ডেলিভারি বয়ের কাজ করে সংসারের জোয়াল টেনে চলেছেন কুশল ।
কুশল হাবরার বেরগুম গ্রাম পঞ্চায়েতের পেয়ারাতলা গ্রামের বাসিন্দা । বছর দশেক আগে মাধ্যমিক পরীক্ষার পর বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে ফুটবল খেলতে গিয়েছিলেন । বল নিয়ে ছুটতে ছুটতে আচমকা পড়ে যান মাটিতে । তারপর কোমর থেকে দু'পায়ের শক্তি হারিয়ে ফেলেন । চিকিৎসা করাতে গিয়ে বারবার ভুলের শিকার । চোখের সামনে দিয়ে পেরিয়ে গিয়েছে মূল্যবান আটটি বছর । কিন্তু সুস্থতা ফেরেনি ।
জীবনের প্রতি চরম হতাশায় কুশল তিনবার চরম পদক্ষেপেরও চেষ্টা করেছিলেন । কিন্তু সফল হননি । শেষে একদিন নিজেই সমস্ত হতাশা ঝেড়ে ফেলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন জীবনযুদ্ধে । ট্রাই সাইকেলে ভর দিয়ে অনলাইন ডেলিভারি সংস্থার কাজ নিলেন । আর সেই থেকেই প্রতিদিন জীবনের সঙ্গে লড়াই করে চলেছেন কুশল । তাঁর লড়াইকে কুর্নিশ জানিয়েছেন পাড়া প্রতিবেশী থেকে বন্ধু-বান্ধব, সকলেই ।
কুশলের পরিবারে বাবা, মা ও ভাই রয়েছে । বাবা ওষুধের দোকানে কাজ করেন । মা গৃহবধূ । অভাবের সংসারে কুশল বড় ছেলে । তাঁর স্বপ্ন ছিল, খেলাধুলোর পাশাপাশি পড়াশোনা করে তিনি একদিন অনেক বড় হবেন । 2015 সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করেছেন । খেলার মাঠের দুর্ঘটনার পরে তাঁর কোমর থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত অসাড় হয়ে গিয়েছিল ।
চিকিৎসার জন্য দিনের পর দিন কুশলের পরিবারকে ছুটে বেড়াতে হয়েছে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে । দীর্ঘদিন দৌড়ঝাঁপ করার পর শেষে কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে অস্ত্রোপচার হয় তাঁর । কিন্তু, তার পরেও ঠিক হয়নি কুশলের পা । উলটে, যক্ষ্মা না হওয়া সত্ত্বেও ভুলবশত তাঁকে সেই রোগের ওষুধ খাইয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ । যার জেরে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি । এরপর, উত্তর 24 পরগনার ঠাকুরনগরের এক হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে চলে কুশলের চিকিৎসা । তাতে কিছুটা সুস্থতা ফিরেছিল তাঁর । কিন্তু সুস্থ হননি পুরোপুরি ।

এসবের মধ্যেই বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার পর জানা যায়, কুশল জটিল অ্যাঙ্কিলোসিং স্পন্ডিলাইটিসে (Ankylosing spondylitis) আক্রান্ত । তারপর কখনও আরজি কর, আবার কখনও এসএসকেএম । এভাবেই চলেছে ছোটাছুটি । আরজি করে পরপর দু'বার হাঁটু প্রতিস্থাপনের অস্ত্রোপচার ব্যর্থ হয় ।হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়েছিল প্রায় দেড় বছর । কিন্তু সুস্থ হয়ে ওঠা হয়নি কুশলের ।
বারবার চিকিৎসা করার পরেও সুস্থ হয়ে না ওঠায় হতাশ হয়ে পড়েন তিনি । পরপর তিনবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন । কিন্তু সফল হয়নি । অবশেষে সমস্ত হতাশা ঝেড়ে ফেলে কুশল ঝাঁপিয়ে পড়েছেন জীবনযুদ্ধে । উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম বিভাগে সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছেন । শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে নিজেকে বন্দি রাখেননি । আর পাঁচজনের মতো স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে তিন চাকার সাইকেলকে সঙ্গী করে বেছে নিয়েছেন অনলাইন ডেলিভারি বয়ের কাজ । তিনি সবসময় চেয়েছেন লড়াই করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে ।
কুশল বলেন, "ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছা ছিল বড় হয়ে দেশের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করব । সেই কারণে সেনাবাহিনী অথবা প্রতিরক্ষা দফতরে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন ছিল আমার । কিন্তু, খেলতে গিয়ে পায়ে চোট পাওয়ায় জীবনে ছন্দপতন ঘটে যায় । টানা কয়েক বছরের চিকিৎসাতেও যখন আমি সুস্থ হলাম না, তখন বেঁচে থাকার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম । প্রতিনিয়ত মানসিক যন্ত্রণা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল । আট বছর ঘরের চার দেওয়ালে কাটানোর পর বুঝতে পারি, এভাবে বেঁচে থাকা যাবে না । নিজেকে কিছু করে দেখাতে হবে । এরপরই শুরু হয় অনলাইন ডেলিভারির কাজের মাধ্যমে আমার জীবন সংগ্রাম । অনেকেই মনে করেছিল আমি শারীরিক প্রতিবন্ধী । তাই কিছু করতে পারব না । কিন্তু সেটা যে অসত্য,তা প্রমাণ করে দেখিয়েছি ।"
তিনি আরও বলেন,"আমাকে কখনও বাড়ির থেকে চাপ দেওয়া হয়নি । বরং পরিবারের সদস্যরা সবসময় উৎসাহিত করেছেন । অনলাইন ডেলিভারির কাজ করতে গিয়ে সকলের সহযোগিতা পেয়েছি । কেউ কখনও খারাপ আচরণ করেননি । তরুণ প্রজন্মকে একটাই কথা বলব, হতাশ হবেন না । মনের জোর এবং ইচ্ছে থাকলে সবকিছু করা যায় । মোবাইল গেমে আসক্ত না হয়ে পরিবারের পাশে দাঁড়ানো উচিত তোমাদেরও । সবশেষে বলব, আজ বরং আসি ! নিজেকে তোমার যোগ্য প্রমাণ করেই ফিরব ।"
এদিকে, কুশলের এই জীবন সংগ্রামকে 'বাহবা' দিচ্ছেন এলাকার বাসিন্দারাও । এই বিষয়ে অরণ্য দত্ত নামে এক বাসিন্দা বলেন, "এ রাজ্যে কর্মসংস্থানের বড্ড অভাব । সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়েও কুশল যেভাবে নিজেকে তুলে ধরেছেন তা এক কথায় অনবদ্য । সকলের কাছে অনুপ্রেরণা । ওকে দেখে সকলের শেখা উচিত কীভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হয় । ও-র ব্যবহার অমায়িক । আর কাজ নিয়ে তো কোনও কথাই হবে না । সঠিক সময়ে নির্দিষ্ট জায়গায় যে কোনও পার্সেল ও (কুশল)পৌঁছে দেয় ক্রেতাদের কাছে ।"
আর কুশলের এই সংগ্রাম নিয়ে পরিবার কী বলছে ? কুশলের ছোট ভাই কর্ণধর মণ্ডল বলেন, "ও'র কাজে আমরা সবসময় উৎসাহ জোগাই । কোনও দিন আমরা চাপ দিইনি । ও নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতেই এই কাজ বেছে নিয়েছে । এখান থেকে দাদা যা আয় করে তার সিংহভাগই সে খরচ করে দেয় অন্যান্য শারীরিক প্রতিবন্ধীদের পিছনে ।"