সিঙ্গুর/ হরিপাল (হুগলি), 17 মে: আলু উৎপাদনে তালিকার শীর্ষের দিকে থাকে হুগলি ৷ এবার সেই হুগলিতে রমরমিয়ে চাষ হচ্ছে লঙ্কা ৷ আর সেই কাঁচা লঙ্কা রফতানি হচ্ছে জাপানে ৷ এখানেই শেষ নয়, জাপানে লঙ্কা রফতানিতে ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডকে টেক্কা দিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ ৷ তাও আবার হুগলির সিঙ্গুর, যেখানকার জমি আন্দোলন বিশ্বখ্যাত ৷ টাটারা শিল্প করতে পারেনি বলে একদিন মুখ ফিরিয়েছিল এই সিঙ্গুর থেকেই ৷ সেই সিঙ্গুরই এখন লঙ্কা উৎপাদনের হাব হয়ে উঠছে ৷ একদিকে এই লঙ্কা চাষ করে অনেক বেশি লাভের মুখ দেখছেন চাষিরা ৷ অন্যদিকে অন্যান্য দেশের বাজার দর বেশি হওয়ায় লঙ্কার জন্য ভারতমুখী হচ্ছে জাপানিরা ।
মূলত 2019 সালে টাটারা সিঙ্গুর ছেড়ে চলে যাওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র জাপানি এক সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন । তারা রাজ্যের সবজি ও ফল প্রসেসিং ইউনিট তৈরির পরিকল্পনা নেয় । সিঙ্গুরে তাপসী মালিক কৃষক বাজারে একটি ছোট ইউনিট তৈরি করা হয় । সেই অনুযায়ী ওই জাপানি সংস্থা রাসায়নিক ও কীটনাশকবিহীন কৃষকদের দিয়ে চুক্তিভিত্তিতে চাষ করায় ।
বর্তমানে কলকাতা-সহ বেশ কিছু শপিং মলে জাপানি সংস্থার প্রসেসিং সবজি ও ফল বাজারজাত করা হয় । এবার ওই সংস্থা জাপানের মার্কেট অনুযায়ী কাঁচা লাল লঙ্কা (কাঁচা অথচ লাল রঙের)সাপ্লাইয়ের পরিকল্পনা নিয়েছে । পাইলট প্রজেক্ট হিসাবে হুগলির হরিপালে আট ধরনের প্রজাতির লঙ্কা চাষ করা হচ্ছে, যা প্রসেসিং করা হবে সিঙ্গুর থেকেই । ইতিমধ্যেই চার ধরনের 160 কিলো লাল লঙ্কা জাপানে পাঠানো হয়েছিল । তার মধ্যে থেকে আপাতত দুই প্রজাতির লঙ্কা সিলেক্ট হয়েছে । আগামিদিনে আরও চার প্রজাতির লঙ্কা পাঠানো হবে ।

ওই সংস্থার তরফে জানা গিয়েছে, জাপানি রেস্তরাঁগুলিতে স্যুপ ও বিভিন্ন খাবারে লাল রঙের কাঁচা লঙ্কার চাহিদা রয়েছে । সেই অনুযায়ী সিঙ্গুর ও হরিপাল-সহ বিভিন্ন জায়গায় যদি লঙ্কার উৎপাদন বাড়ানো যায়, তাহলে ওই চাহিদা মেটানো সম্ভব । এই লঙ্কা চাষে রাজ্যের কৃষকরা এগিয়ে এলে তাঁরা লাভবান হবেন বলে মনে করা হচ্ছে । এছাড়াও শিলিগুড়িতে সুইট পটেটো (রাঙা আলু) ইউনিট করার পরিকল্পনা করছে ওই জাপানি সংস্থা । রাঙা আলু দেশে রফতানি করা এবং তার থেকে ক্যান্ডি করবে জাপান । এছাড়াও নদিয়াতে একটি সবজির প্রসেসিং ইউনিটও করা হয়েছে ।

জাপানিরা খাওয়ার ব্যাপারে যথেষ্টই স্বাস্থ্য সচেতন । সেই অনুযায়ী এই চাষ করতে নিদির্ষ্ট কতগুলি নিয়ম মানতে হবে । সেগুলি হল:
- পলি হাউসের মধ্যে এই চাষ করতে হবে ।
- চাষে কোনও রাসায়নিক বা কীটনাশক ব্যবহার করা চলবে না ।
- সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে চাষ করতে হবে ।
- সারিবদ্ধভাবে পলিথিনের উপর লঙ্কা গাছ লাগিয়ে, নির্দিষ্ট জল ব্যবহার করতে হবে ।
- সম্পূর্ণ জাপানি প্রযুক্তিতে এই চাষ করতে হবে ।
- সোলার শক্তির মাধ্যমে পলি হাউজে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো থাকে ।
- সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে চাষের জায়গায় নজরদারি চালানো হয় ।
বর্তমানে এই লঙ্কার পাইলট প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত হরিপালের দু'জন চাষি । একজন শুভেন্দু সিংহ রায় ও গৌতম দাস ৷ হরিপালের কৃষক শুভেন্দু সিংহ রায় বলেন, "আমরা যে লঙ্কা চাষ করছি, সেটা সম্পূর্ণ পলি হাউসের মধ্যে । সেখানে নির্দিষ্ট পরিমাণে জল, নির্দিষ্ট পরিমাণের জৈব সার ও তাপমাত্রায় চাষ করা হচ্ছে । কোনও রাসায়নিক সার এখানে ব্যবহার করা হচ্ছে না । মাটিতে যাতে আগাছা না বেরোয়, তার জন্য পলিথিন পেতে নির্দিষ্ট জায়গায় সারিবদ্ধভাবে লঙ্কা গাছ তৈরি করা হয় । লঙ্কা গাছগুলিকে বেঁধে নির্দিষ্ট উচ্চতায়ও রাখা হয়, যাতে ফলন বৃদ্ধি পায় । চাষির পরিশ্রমের চেয়ে দেখাশোনা করাটাই বেশি জরুরি । এছাড়াও রোগ পোকার দেখার জন্য সিসিটিভি ক্যামেরাও রয়েছে পলি হাউজের মধ্যে ।"


তিনি আরও বলেন, "জাপানি সংস্থা সরাসরি সিসিটিভির মাধ্যমে লঙ্কার রোগ ও পোকার উপর নজর রাখতে পারবে । জাপানি প্রযুক্তি এবং বিশেষজ্ঞরা এসে সরাসরি যোগাযোগ রাখেন চাষিদের সঙ্গে । এমনকি চাষের সমস্ত খরচ সংস্থা দেন । এই চাষ করলে ওই সংস্থা ও চাষি উভয়ই উপকৃত হবে । বর্তমান রাজ্যের বাজারের চেয়েও লঙ্কা এক্সপোর্ট হলে চারগুণ দাম পাওয়ার আশা করছি আমরা । এটা আপাতত পাইলট প্রজেক্টে কাজ চলছে । ভবিষ্যতে 50 থেকে 60 জন কৃষক এই লঙ্কা চাষের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে । হুগলির মাটি যথেষ্টই উর্বর ৷ যেকোনও চাষ এখানে ভালো হবে ৷ সেটা গোটা বিশ্ব জানে । সেই কারণেই এই জায়গাটাকে বেছে নিয়েছে জাপানিরা ।"

হরিপালের পানিশ্যাওলার বাসিন্দা চাষি গৌতম দাস বলেন, "আমাদের ধারণা ছিল খাদ্যশস্য উৎপাদন করব, সেই খেয়েই জীবন ধারণ করব । বর্তমানে জাপানিরা আমাদের শেখাচ্ছে কৃষি একটা ব্যবসা । নির্দিষ্ট ফসল তৈরি করে মার্কেটিং করে বিক্রি করতে হবে । এতদিন গতানুগতিক ধান, আলু ও পাট এই ধরনের চাষ করতাম । বর্তমানে বিদেশে রফতানি করার মতো ফসল তৈরি করছি । জাপানিরা আসছেন এখানে ৷ তাদের টেকনোলজিতে আমরা চাষবাস শিখতে পারছি ।"

তাঁর কথায়, "বাজারে জৈবর নামে মিথ্যা প্রচার করে শাক সবজি বিক্রি করা হয় । কিন্তু আমরা পুরোপুরি রাসায়নিকবিহীনভাবে জৈব চাষ করছি । সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারপরে এক্সপোর্ট হচ্ছে । এখনও পর্যন্ত টেস্টের জন্য 160 কিলো লঙ্কা পাঠিয়েছি জাপানে । দু’টো প্রজাতি সিলেট করেছে জাপানিরা । আর এই চাষ করলে আর্থিক দিক থেকেও এগিয়ে যাব আমরা । তারা দাবি করেছেন, সারা বছরে শুধু আমার কাছ থেকেই 3 টন লঙ্কা নিতে পারবেন । আমি ছাড়াও এই সবজি চাষের যুক্ত 70 জন কৃষক রয়েছে । উৎপাদন করলে রাজ্যের বাজারে চেয়েও কুড়ি শতাংশ বেশি দাম পাওয়া যাবে । আমার কাছে এমনটাই তো দাবি করেছেন জাপানি সংস্থা ।"
জাপানি সংস্থার সঙ্গে কিছু চুক্তিবদ্ধ ও চুক্তিবদ্ধ নয় এমন চাষিরা এই প্রকল্পের অংশ রয়েছেন । যাদের মাধ্যমে সবজি ও ফল কেনা হয় । যাদের মাধ্যমে এক নম্বর কোয়ালিটির ফসল কেনা হয় । সিঙ্গুরের কৃষাণ বাজারে একটি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ওয়ার হাউস আছে । ভালো সবজি বাছাই করে এখানকার কর্মীরা সবজি প্রসেসিং করেন । ওই সংস্থার সঙ্গে 10 জন চুক্তিভিত্তিক কৃষক যুক্ত । এছাড়াও অস্থায়ীভাবে 200 জন কৃষক যুক্ত । এখানে রেফ্রিজেটারের মাধ্যমে 7 থেকে 10 দিন মজুত রাখা যায় সবজি ।

জাপানি সংস্থার এগ্রিকালচার অফিসার অর্পণ গুহ বলেন, "লঙ্কার প্রজেক্টে আমাদের সঙ্গে অনেক কৃষক যোগাযোগ করছেন ৷ তারা আগ্রহী এই লঙ্কা চাষে । আমাদের রাজ্যের তুলনায় জাপানে লঙ্কার দাম পাঁচ থেকে দশ গুণ । আমাদের সংস্থার কর্ণধার বলেছেন, রাজ্যের লঙ্কার দামের তুলনায় আমরা দ্বিগুণ দামে লঙ্কা কিনব কৃষকদের কাছ থেকে । আমরা লঙ্কা চাষের জন্য পলি হাউস, সার থেকে বীজ সবকিছুই দেব ৷ চাষিরা সততার ও পরিশ্রম মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভবান হবেন । সিঙ্গুর চাষের ক্ষেত্রে হটস্পট জোন ৷ গোটা বিশ্বের নজর রয়েছে সিঙ্গুরের উপর । সিঙ্গুর ছাড়াও ডাব গ্রামে আরেকটি ওয়ার হাউস তৈরি হয়েছে ৷ এখানে সুইট পটেটো প্রসেসিং হবে । জাপানে সুইট ক্যান্ডি তৈরি হবে । এছাড়াও কৃষ্ণনগরেও আমাদের আরেকটি প্রজেক্ট তৈরি হবে ।"

জাপানি কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার পরিচিতা চক্রবর্তী বলেন, "সিঙ্গুরে 3 হাজার স্কোয়ার ফিটের ওয়ার হাউস রয়েছে । সিঙ্গুরে ও শিলিগুড়ির ডাবগ্রামে ওয়ার হাউস হচ্ছে । বাংলায় ফসল নষ্টের পরিমাণ অনেক বেশি । সেই কারণে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ওয়ার হাউস তৈরি করার জন্য প্রস্তাব দেয় রাজ্য সরকারকে । 2 হাজার কৃষক আমাদের সঙ্গে যুক্ত । প্রতিমাসে 4 লক্ষ টাকা কৃষকদের দেওয়া হয় । বছরে সরাসরি 48 লক্ষ টাকা কৃষকদের অ্যাকাউন্টে যায় । জাপানিরা স্বাস্থ্য সচেতন হয় । তারা জানে পটেটোর (আলু) চেয়েও সুইট পটেটোর খাদ্য গুণাগুণ অনেক বেশি । শিলিগুড়িতে সুইট পটেটোর উপর খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট তৈরির পরিকল্পনা আছে । সুইট পটেটো ক্যান্ডি ও স্ন্যাকস করা হবে । বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের তত্ত্ববধানে জাপানি টেকনোলজিতে উচ্চ ফলনশীল বীজ ও জৈব চাষ হচ্ছে সিঙ্গুর ও শিলিগুড়িতে ।"

সিঙ্গুর লঙ্কা চাষের হাব তৈরি হওয়ায় মুখ্যমন্ত্রীর সাফল্য দেখছেন কৃষি বিপণন মন্ত্রী বেচারাম মান্না ৷ তিনি বলেন, "মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সব সময় চেয়ে এসেছেন কৃষকরা ফসলের ন্যায্য দাম পাক । সিঙ্গুরে কৃষাণ বাজারে রাজ্য ও জাপানি সংস্থার উদ্যোগে ইতিমধ্যেই জৈব পদ্ধতিতে কৃষকদের চাষ করানো হচ্ছে । আগামিদিনে রাজ্যে চাষ হওয়া লঙ্কা বিদেশে রাজ করবে । এছাড়াও মিশন নির্মল বাংলার মাধ্যমে কৃষকদের হাতে জৈব সার তুলে দিচ্ছি আমরা । যাতে কৃষকরা আরও লাভবান হয় ।"