ETV Bharat / state

কাঁচা লঙ্কা উৎপাদনের হাব হয়ে উঠছে সিঙ্গুর, জাপানে রফতানিতে ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডকে টেক্কা - GREEN CHILLIES HUB

পলি হাউসের মধ্যে কাঁচা লঙ্কা চাষ করতে হয় ৷ কোনও রাসায়নিক বা কীটনাশক ব্যবহার করা চলে না ৷ সম্পূর্ণ জৈবভাবে চাষ করতে হয় ৷

green chillies production
কাঁচা লঙ্কা উৎপাদনের হাব হয়ে উঠছে সিঙ্গুর (নিজস্ব ছবি)
author img

By ETV Bharat Bangla Team

Published : May 17, 2025 at 8:34 PM IST

8 Min Read

সিঙ্গুর/ হরিপাল (হুগলি), 17 মে: আলু উৎপাদনে তালিকার শীর্ষের দিকে থাকে হুগলি ৷ এবার সেই হুগলিতে রমরমিয়ে চাষ হচ্ছে লঙ্কা ৷ আর সেই কাঁচা লঙ্কা রফতানি হচ্ছে জাপানে ৷ এখানেই শেষ নয়, জাপানে লঙ্কা রফতানিতে ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডকে টেক্কা দিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ ৷ তাও আবার হুগলির সিঙ্গুর, যেখানকার জমি আন্দোলন বিশ্বখ্যাত ৷ টাটারা শিল্প করতে পারেনি বলে একদিন মুখ ফিরিয়েছিল এই সিঙ্গুর থেকেই ৷ সেই সিঙ্গুরই এখন লঙ্কা উৎপাদনের হাব হয়ে উঠছে ৷ একদিকে এই লঙ্কা চাষ করে অনেক বেশি লাভের মুখ দেখছেন চাষিরা ৷ অন্যদিকে অন্যান্য দেশের বাজার দর বেশি হওয়ায় লঙ্কার জন্য ভারতমুখী হচ্ছে জাপানিরা ।

মূলত 2019 সালে টাটারা সিঙ্গুর ছেড়ে চলে যাওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র জাপানি এক সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন । তারা রাজ্যের সবজি ও ফল প্রসেসিং ইউনিট তৈরির পরিকল্পনা নেয় । সিঙ্গুরে তাপসী মালিক কৃষক বাজারে একটি ছোট ইউনিট তৈরি করা হয় । সেই অনুযায়ী ওই জাপানি সংস্থা রাসায়নিক ও কীটনাশকবিহীন কৃষকদের দিয়ে চুক্তিভিত্তিতে চাষ করায় ।

কাঁচা লঙ্কা উৎপাদনের হাব হয়ে উঠছে সিঙ্গুর, জাপানে রফতানিতে ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডকে টেক্কা (ইটিভি ভারত)

বর্তমানে কলকাতা-সহ বেশ কিছু শপিং মলে জাপানি সংস্থার প্রসেসিং সবজি ও ফল বাজারজাত করা হয় । এবার ওই সংস্থা জাপানের মার্কেট অনুযায়ী কাঁচা লাল লঙ্কা (কাঁচা অথচ লাল রঙের)সাপ্লাইয়ের পরিকল্পনা নিয়েছে । পাইলট প্রজেক্ট হিসাবে হুগলির হরিপালে আট ধরনের প্রজাতির লঙ্কা চাষ করা হচ্ছে, যা প্রসেসিং করা হবে সিঙ্গুর থেকেই । ইতিমধ্যেই চার ধরনের 160 কিলো লাল লঙ্কা জাপানে পাঠানো হয়েছিল । তার মধ্যে থেকে আপাতত দুই প্রজাতির লঙ্কা সিলেক্ট হয়েছে । আগামিদিনে আরও চার প্রজাতির লঙ্কা পাঠানো হবে ।

green chillies production
চাষি শুভেন্দু সিংহ রায়ের সঙ্গে জাপানি সংস্থার কর্মীরা (ছবি সূত্র - জাপানি সংস্থা)

ওই সংস্থার তরফে জানা গিয়েছে, জাপানি রেস্তরাঁগুলিতে স্যুপ ও বিভিন্ন খাবারে লাল রঙের কাঁচা লঙ্কার চাহিদা রয়েছে । সেই অনুযায়ী সিঙ্গুর ও হরিপাল-সহ বিভিন্ন জায়গায় যদি লঙ্কার উৎপাদন বাড়ানো যায়, তাহলে ওই চাহিদা মেটানো সম্ভব । এই লঙ্কা চাষে রাজ্যের কৃষকরা এগিয়ে এলে তাঁরা লাভবান হবেন বলে মনে করা হচ্ছে । এছাড়াও শিলিগুড়িতে সুইট পটেটো (রাঙা আলু) ইউনিট করার পরিকল্পনা করছে ওই জাপানি সংস্থা । রাঙা আলু দেশে রফতানি করা এবং তার থেকে ক্যান্ডি করবে জাপান । এছাড়াও নদিয়াতে একটি সবজির প্রসেসিং ইউনিটও করা হয়েছে ।

green chillies production
চাষিদের সঙ্গে জাপানি সংস্থার কর্মীরা (ছবি সূত্র - জাপানি সংস্থা)

জাপানিরা খাওয়ার ব্যাপারে যথেষ্টই স্বাস্থ্য সচেতন । সেই অনুযায়ী এই চাষ করতে নিদির্ষ্ট কতগুলি নিয়ম মানতে হবে । সেগুলি হল:

  • পলি হাউসের মধ্যে এই চাষ করতে হবে ।
  • চাষে কোনও রাসায়নিক বা কীটনাশক ব্যবহার করা চলবে না ।
  • সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে চাষ করতে হবে ।
  • সারিবদ্ধভাবে পলিথিনের উপর লঙ্কা গাছ লাগিয়ে, নির্দিষ্ট জল ব্যবহার করতে হবে ।
  • সম্পূর্ণ জাপানি প্রযুক্তিতে এই চাষ করতে হবে ।
  • সোলার শক্তির মাধ্যমে পলি হাউজে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো থাকে ।
  • সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে চাষের জায়গায় নজরদারি চালানো হয় ।

বর্তমানে এই লঙ্কার পাইলট প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত হরিপালের দু'জন চাষি । একজন শুভেন্দু সিংহ রায় ও গৌতম দাস ৷ হরিপালের কৃষক শুভেন্দু সিংহ রায় বলেন, "আমরা যে লঙ্কা চাষ করছি, সেটা সম্পূর্ণ পলি হাউসের মধ্যে । সেখানে নির্দিষ্ট পরিমাণে জল, নির্দিষ্ট পরিমাণের জৈব সার ও তাপমাত্রায় চাষ করা হচ্ছে । কোনও রাসায়নিক সার এখানে ব্যবহার করা হচ্ছে না । মাটিতে যাতে আগাছা না বেরোয়, তার জন্য পলিথিন পেতে নির্দিষ্ট জায়গায় সারিবদ্ধভাবে লঙ্কা গাছ তৈরি করা হয় । লঙ্কা গাছগুলিকে বেঁধে নির্দিষ্ট উচ্চতায়ও রাখা হয়, যাতে ফলন বৃদ্ধি পায় । চাষির পরিশ্রমের চেয়ে দেখাশোনা করাটাই বেশি জরুরি । এছাড়াও রোগ পোকার দেখার জন্য সিসিটিভি ক্যামেরাও রয়েছে পলি হাউজের মধ্যে ।"

GREEN CHILLIES HUB
কাঁচা লঙ্কা উৎপাদনের হাব হয়ে উঠছে সিঙ্গুর (ইটিভি ভারত)
GREEN CHILLIES HUB
কাঁচা লঙ্কা উৎপাদনের হাব হয়ে উঠছে সিঙ্গুর (ইটিভি ভারত)

তিনি আরও বলেন, "জাপানি সংস্থা সরাসরি সিসিটিভির মাধ্যমে লঙ্কার রোগ ও পোকার উপর নজর রাখতে পারবে । জাপানি প্রযুক্তি এবং বিশেষজ্ঞরা এসে সরাসরি যোগাযোগ রাখেন চাষিদের সঙ্গে । এমনকি চাষের সমস্ত খরচ সংস্থা দেন । এই চাষ করলে ওই সংস্থা ও চাষি উভয়ই উপকৃত হবে । বর্তমান রাজ্যের বাজারের চেয়েও লঙ্কা এক্সপোর্ট হলে চারগুণ দাম পাওয়ার আশা করছি আমরা । এটা আপাতত পাইলট প্রজেক্টে কাজ চলছে । ভবিষ্যতে 50 থেকে 60 জন কৃষক এই লঙ্কা চাষের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে । হুগলির মাটি যথেষ্টই উর্বর ৷ যেকোনও চাষ এখানে ভালো হবে ৷ সেটা গোটা বিশ্ব জানে । সেই কারণেই এই জায়গাটাকে বেছে নিয়েছে জাপানিরা ।"

green chillies production
পলি হাউসের মধ্যে হচ্ছে কাঁচা লঙ্কা চাষ (নিজস্ব ছবি)

হরিপালের পানিশ্যাওলার বাসিন্দা চাষি গৌতম দাস বলেন, "আমাদের ধারণা ছিল খাদ্যশস্য উৎপাদন করব, সেই খেয়েই জীবন ধারণ করব । বর্তমানে জাপানিরা আমাদের শেখাচ্ছে কৃষি একটা ব্যবসা । নির্দিষ্ট ফসল তৈরি করে মার্কেটিং করে বিক্রি করতে হবে । এতদিন গতানুগতিক ধান, আলু ও পাট এই ধরনের চাষ করতাম । বর্তমানে বিদেশে রফতানি করার মতো ফসল তৈরি করছি । জাপানিরা আসছেন এখানে ৷ তাদের টেকনোলজিতে আমরা চাষবাস শিখতে পারছি ।"

green chillies production
কোনও রাসায়নিক বা কীটনাশক ব্যবহার হয় না চাষে (নিজস্ব ছবি)

তাঁর কথায়, "বাজারে জৈবর নামে মিথ্যা প্রচার করে শাক সবজি বিক্রি করা হয় । কিন্তু আমরা পুরোপুরি রাসায়নিকবিহীনভাবে জৈব চাষ করছি । সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারপরে এক্সপোর্ট হচ্ছে । এখনও পর্যন্ত টেস্টের জন্য 160 কিলো লঙ্কা পাঠিয়েছি জাপানে । দু’টো প্রজাতি সিলেট করেছে জাপানিরা । আর এই চাষ করলে আর্থিক দিক থেকেও এগিয়ে যাব আমরা । তারা দাবি করেছেন, সারা বছরে শুধু আমার কাছ থেকেই 3 টন লঙ্কা নিতে পারবেন । আমি ছাড়াও এই সবজি চাষের যুক্ত 70 জন কৃষক রয়েছে । উৎপাদন করলে রাজ্যের বাজারে চেয়েও কুড়ি শতাংশ বেশি দাম পাওয়া যাবে । আমার কাছে এমনটাই তো দাবি করেছেন জাপানি সংস্থা ।"

জাপানি সংস্থার সঙ্গে কিছু চুক্তিবদ্ধ ও চুক্তিবদ্ধ নয় এমন চাষিরা এই প্রকল্পের অংশ রয়েছেন । যাদের মাধ্যমে সবজি ও ফল কেনা হয় । যাদের মাধ্যমে এক নম্বর কোয়ালিটির ফসল কেনা হয় । সিঙ্গুরের কৃষাণ বাজারে একটি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ওয়ার হাউস আছে । ভালো সবজি বাছাই করে এখানকার কর্মীরা সবজি প্রসেসিং করেন । ওই সংস্থার সঙ্গে 10 জন চুক্তিভিত্তিক কৃষক যুক্ত । এছাড়াও অস্থায়ীভাবে 200 জন কৃষক যুক্ত । এখানে রেফ্রিজেটারের মাধ্যমে 7 থেকে 10 দিন মজুত রাখা যায় সবজি ।

green chillies production
সোলার শক্তির মাধ্যমে চলে সিসিটিভি (নিজস্ব ছবি)

জাপানি সংস্থার এগ্রিকালচার অফিসার অর্পণ গুহ বলেন, "লঙ্কার প্রজেক্টে আমাদের সঙ্গে অনেক কৃষক যোগাযোগ করছেন ৷ তারা আগ্রহী এই লঙ্কা চাষে । আমাদের রাজ্যের তুলনায় জাপানে লঙ্কার দাম পাঁচ থেকে দশ গুণ । আমাদের সংস্থার কর্ণধার বলেছেন, রাজ্যের লঙ্কার দামের তুলনায় আমরা দ্বিগুণ দামে লঙ্কা কিনব কৃষকদের কাছ থেকে । আমরা লঙ্কা চাষের জন্য পলি হাউস, সার থেকে বীজ সবকিছুই দেব ৷ চাষিরা সততার ও পরিশ্রম মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভবান হবেন । সিঙ্গুর চাষের ক্ষেত্রে হটস্পট জোন ৷ গোটা বিশ্বের নজর রয়েছে সিঙ্গুরের উপর । সিঙ্গুর ছাড়াও ডাব গ্রামে আরেকটি ওয়ার হাউস তৈরি হয়েছে ৷ এখানে সুইট পটেটো প্রসেসিং হবে । জাপানে সুইট ক্যান্ডি তৈরি হবে । এছাড়াও কৃষ্ণনগরেও আমাদের আরেকটি প্রজেক্ট তৈরি হবে ।"

green chillies production
সিসিটিভিতে চাষে নজরদারি চলছে (নিজস্ব ছবি)

জাপানি কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার পরিচিতা চক্রবর্তী বলেন, "সিঙ্গুরে 3 হাজার স্কোয়ার ফিটের ওয়ার হাউস রয়েছে । সিঙ্গুরে ও শিলিগুড়ির ডাবগ্রামে ওয়ার হাউস হচ্ছে । বাংলায় ফসল নষ্টের পরিমাণ অনেক বেশি । সেই কারণে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ওয়ার হাউস তৈরি করার জন্য প্রস্তাব দেয় রাজ্য সরকারকে । 2 হাজার কৃষক আমাদের সঙ্গে যুক্ত । প্রতিমাসে 4 লক্ষ টাকা কৃষকদের দেওয়া হয় । বছরে সরাসরি 48 লক্ষ টাকা কৃষকদের অ্যাকাউন্টে যায় । জাপানিরা স্বাস্থ্য সচেতন হয় । তারা জানে পটেটোর (আলু) চেয়েও সুইট পটেটোর খাদ্য গুণাগুণ অনেক বেশি । শিলিগুড়িতে সুইট পটেটোর উপর খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট তৈরির পরিকল্পনা আছে । সুইট পটেটো ক্যান্ডি ও স্ন্যাকস করা হবে । বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের তত্ত্ববধানে জাপানি টেকনোলজিতে উচ্চ ফলনশীল বীজ ও জৈব চাষ হচ্ছে সিঙ্গুর ও শিলিগুড়িতে ।"

green chillies production
কাঁচা লঙ্কা চাষ করছেন হুগলির কৃষকরা (নিজস্ব ছবি)

সিঙ্গুর লঙ্কা চাষের হাব তৈরি হওয়ায় মুখ্যমন্ত্রীর সাফল্য দেখছেন কৃষি বিপণন মন্ত্রী বেচারাম মান্না ৷ তিনি বলেন, "মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সব সময় চেয়ে এসেছেন কৃষকরা ফসলের ন্যায্য দাম পাক । সিঙ্গুরে কৃষাণ বাজারে রাজ্য ও জাপানি সংস্থার উদ্যোগে ইতিমধ্যেই জৈব পদ্ধতিতে কৃষকদের চাষ করানো হচ্ছে । আগামিদিনে রাজ্যে চাষ হওয়া লঙ্কা বিদেশে রাজ করবে । এছাড়াও মিশন নির্মল বাংলার মাধ্যমে কৃষকদের হাতে জৈব সার তুলে দিচ্ছি আমরা । যাতে কৃষকরা আরও লাভবান হয় ।"

সিঙ্গুর/ হরিপাল (হুগলি), 17 মে: আলু উৎপাদনে তালিকার শীর্ষের দিকে থাকে হুগলি ৷ এবার সেই হুগলিতে রমরমিয়ে চাষ হচ্ছে লঙ্কা ৷ আর সেই কাঁচা লঙ্কা রফতানি হচ্ছে জাপানে ৷ এখানেই শেষ নয়, জাপানে লঙ্কা রফতানিতে ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডকে টেক্কা দিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ ৷ তাও আবার হুগলির সিঙ্গুর, যেখানকার জমি আন্দোলন বিশ্বখ্যাত ৷ টাটারা শিল্প করতে পারেনি বলে একদিন মুখ ফিরিয়েছিল এই সিঙ্গুর থেকেই ৷ সেই সিঙ্গুরই এখন লঙ্কা উৎপাদনের হাব হয়ে উঠছে ৷ একদিকে এই লঙ্কা চাষ করে অনেক বেশি লাভের মুখ দেখছেন চাষিরা ৷ অন্যদিকে অন্যান্য দেশের বাজার দর বেশি হওয়ায় লঙ্কার জন্য ভারতমুখী হচ্ছে জাপানিরা ।

মূলত 2019 সালে টাটারা সিঙ্গুর ছেড়ে চলে যাওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র জাপানি এক সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন । তারা রাজ্যের সবজি ও ফল প্রসেসিং ইউনিট তৈরির পরিকল্পনা নেয় । সিঙ্গুরে তাপসী মালিক কৃষক বাজারে একটি ছোট ইউনিট তৈরি করা হয় । সেই অনুযায়ী ওই জাপানি সংস্থা রাসায়নিক ও কীটনাশকবিহীন কৃষকদের দিয়ে চুক্তিভিত্তিতে চাষ করায় ।

কাঁচা লঙ্কা উৎপাদনের হাব হয়ে উঠছে সিঙ্গুর, জাপানে রফতানিতে ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডকে টেক্কা (ইটিভি ভারত)

বর্তমানে কলকাতা-সহ বেশ কিছু শপিং মলে জাপানি সংস্থার প্রসেসিং সবজি ও ফল বাজারজাত করা হয় । এবার ওই সংস্থা জাপানের মার্কেট অনুযায়ী কাঁচা লাল লঙ্কা (কাঁচা অথচ লাল রঙের)সাপ্লাইয়ের পরিকল্পনা নিয়েছে । পাইলট প্রজেক্ট হিসাবে হুগলির হরিপালে আট ধরনের প্রজাতির লঙ্কা চাষ করা হচ্ছে, যা প্রসেসিং করা হবে সিঙ্গুর থেকেই । ইতিমধ্যেই চার ধরনের 160 কিলো লাল লঙ্কা জাপানে পাঠানো হয়েছিল । তার মধ্যে থেকে আপাতত দুই প্রজাতির লঙ্কা সিলেক্ট হয়েছে । আগামিদিনে আরও চার প্রজাতির লঙ্কা পাঠানো হবে ।

green chillies production
চাষি শুভেন্দু সিংহ রায়ের সঙ্গে জাপানি সংস্থার কর্মীরা (ছবি সূত্র - জাপানি সংস্থা)

ওই সংস্থার তরফে জানা গিয়েছে, জাপানি রেস্তরাঁগুলিতে স্যুপ ও বিভিন্ন খাবারে লাল রঙের কাঁচা লঙ্কার চাহিদা রয়েছে । সেই অনুযায়ী সিঙ্গুর ও হরিপাল-সহ বিভিন্ন জায়গায় যদি লঙ্কার উৎপাদন বাড়ানো যায়, তাহলে ওই চাহিদা মেটানো সম্ভব । এই লঙ্কা চাষে রাজ্যের কৃষকরা এগিয়ে এলে তাঁরা লাভবান হবেন বলে মনে করা হচ্ছে । এছাড়াও শিলিগুড়িতে সুইট পটেটো (রাঙা আলু) ইউনিট করার পরিকল্পনা করছে ওই জাপানি সংস্থা । রাঙা আলু দেশে রফতানি করা এবং তার থেকে ক্যান্ডি করবে জাপান । এছাড়াও নদিয়াতে একটি সবজির প্রসেসিং ইউনিটও করা হয়েছে ।

green chillies production
চাষিদের সঙ্গে জাপানি সংস্থার কর্মীরা (ছবি সূত্র - জাপানি সংস্থা)

জাপানিরা খাওয়ার ব্যাপারে যথেষ্টই স্বাস্থ্য সচেতন । সেই অনুযায়ী এই চাষ করতে নিদির্ষ্ট কতগুলি নিয়ম মানতে হবে । সেগুলি হল:

  • পলি হাউসের মধ্যে এই চাষ করতে হবে ।
  • চাষে কোনও রাসায়নিক বা কীটনাশক ব্যবহার করা চলবে না ।
  • সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে চাষ করতে হবে ।
  • সারিবদ্ধভাবে পলিথিনের উপর লঙ্কা গাছ লাগিয়ে, নির্দিষ্ট জল ব্যবহার করতে হবে ।
  • সম্পূর্ণ জাপানি প্রযুক্তিতে এই চাষ করতে হবে ।
  • সোলার শক্তির মাধ্যমে পলি হাউজে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো থাকে ।
  • সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে চাষের জায়গায় নজরদারি চালানো হয় ।

বর্তমানে এই লঙ্কার পাইলট প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত হরিপালের দু'জন চাষি । একজন শুভেন্দু সিংহ রায় ও গৌতম দাস ৷ হরিপালের কৃষক শুভেন্দু সিংহ রায় বলেন, "আমরা যে লঙ্কা চাষ করছি, সেটা সম্পূর্ণ পলি হাউসের মধ্যে । সেখানে নির্দিষ্ট পরিমাণে জল, নির্দিষ্ট পরিমাণের জৈব সার ও তাপমাত্রায় চাষ করা হচ্ছে । কোনও রাসায়নিক সার এখানে ব্যবহার করা হচ্ছে না । মাটিতে যাতে আগাছা না বেরোয়, তার জন্য পলিথিন পেতে নির্দিষ্ট জায়গায় সারিবদ্ধভাবে লঙ্কা গাছ তৈরি করা হয় । লঙ্কা গাছগুলিকে বেঁধে নির্দিষ্ট উচ্চতায়ও রাখা হয়, যাতে ফলন বৃদ্ধি পায় । চাষির পরিশ্রমের চেয়ে দেখাশোনা করাটাই বেশি জরুরি । এছাড়াও রোগ পোকার দেখার জন্য সিসিটিভি ক্যামেরাও রয়েছে পলি হাউজের মধ্যে ।"

GREEN CHILLIES HUB
কাঁচা লঙ্কা উৎপাদনের হাব হয়ে উঠছে সিঙ্গুর (ইটিভি ভারত)
GREEN CHILLIES HUB
কাঁচা লঙ্কা উৎপাদনের হাব হয়ে উঠছে সিঙ্গুর (ইটিভি ভারত)

তিনি আরও বলেন, "জাপানি সংস্থা সরাসরি সিসিটিভির মাধ্যমে লঙ্কার রোগ ও পোকার উপর নজর রাখতে পারবে । জাপানি প্রযুক্তি এবং বিশেষজ্ঞরা এসে সরাসরি যোগাযোগ রাখেন চাষিদের সঙ্গে । এমনকি চাষের সমস্ত খরচ সংস্থা দেন । এই চাষ করলে ওই সংস্থা ও চাষি উভয়ই উপকৃত হবে । বর্তমান রাজ্যের বাজারের চেয়েও লঙ্কা এক্সপোর্ট হলে চারগুণ দাম পাওয়ার আশা করছি আমরা । এটা আপাতত পাইলট প্রজেক্টে কাজ চলছে । ভবিষ্যতে 50 থেকে 60 জন কৃষক এই লঙ্কা চাষের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে । হুগলির মাটি যথেষ্টই উর্বর ৷ যেকোনও চাষ এখানে ভালো হবে ৷ সেটা গোটা বিশ্ব জানে । সেই কারণেই এই জায়গাটাকে বেছে নিয়েছে জাপানিরা ।"

green chillies production
পলি হাউসের মধ্যে হচ্ছে কাঁচা লঙ্কা চাষ (নিজস্ব ছবি)

হরিপালের পানিশ্যাওলার বাসিন্দা চাষি গৌতম দাস বলেন, "আমাদের ধারণা ছিল খাদ্যশস্য উৎপাদন করব, সেই খেয়েই জীবন ধারণ করব । বর্তমানে জাপানিরা আমাদের শেখাচ্ছে কৃষি একটা ব্যবসা । নির্দিষ্ট ফসল তৈরি করে মার্কেটিং করে বিক্রি করতে হবে । এতদিন গতানুগতিক ধান, আলু ও পাট এই ধরনের চাষ করতাম । বর্তমানে বিদেশে রফতানি করার মতো ফসল তৈরি করছি । জাপানিরা আসছেন এখানে ৷ তাদের টেকনোলজিতে আমরা চাষবাস শিখতে পারছি ।"

green chillies production
কোনও রাসায়নিক বা কীটনাশক ব্যবহার হয় না চাষে (নিজস্ব ছবি)

তাঁর কথায়, "বাজারে জৈবর নামে মিথ্যা প্রচার করে শাক সবজি বিক্রি করা হয় । কিন্তু আমরা পুরোপুরি রাসায়নিকবিহীনভাবে জৈব চাষ করছি । সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারপরে এক্সপোর্ট হচ্ছে । এখনও পর্যন্ত টেস্টের জন্য 160 কিলো লঙ্কা পাঠিয়েছি জাপানে । দু’টো প্রজাতি সিলেট করেছে জাপানিরা । আর এই চাষ করলে আর্থিক দিক থেকেও এগিয়ে যাব আমরা । তারা দাবি করেছেন, সারা বছরে শুধু আমার কাছ থেকেই 3 টন লঙ্কা নিতে পারবেন । আমি ছাড়াও এই সবজি চাষের যুক্ত 70 জন কৃষক রয়েছে । উৎপাদন করলে রাজ্যের বাজারে চেয়েও কুড়ি শতাংশ বেশি দাম পাওয়া যাবে । আমার কাছে এমনটাই তো দাবি করেছেন জাপানি সংস্থা ।"

জাপানি সংস্থার সঙ্গে কিছু চুক্তিবদ্ধ ও চুক্তিবদ্ধ নয় এমন চাষিরা এই প্রকল্পের অংশ রয়েছেন । যাদের মাধ্যমে সবজি ও ফল কেনা হয় । যাদের মাধ্যমে এক নম্বর কোয়ালিটির ফসল কেনা হয় । সিঙ্গুরের কৃষাণ বাজারে একটি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ওয়ার হাউস আছে । ভালো সবজি বাছাই করে এখানকার কর্মীরা সবজি প্রসেসিং করেন । ওই সংস্থার সঙ্গে 10 জন চুক্তিভিত্তিক কৃষক যুক্ত । এছাড়াও অস্থায়ীভাবে 200 জন কৃষক যুক্ত । এখানে রেফ্রিজেটারের মাধ্যমে 7 থেকে 10 দিন মজুত রাখা যায় সবজি ।

green chillies production
সোলার শক্তির মাধ্যমে চলে সিসিটিভি (নিজস্ব ছবি)

জাপানি সংস্থার এগ্রিকালচার অফিসার অর্পণ গুহ বলেন, "লঙ্কার প্রজেক্টে আমাদের সঙ্গে অনেক কৃষক যোগাযোগ করছেন ৷ তারা আগ্রহী এই লঙ্কা চাষে । আমাদের রাজ্যের তুলনায় জাপানে লঙ্কার দাম পাঁচ থেকে দশ গুণ । আমাদের সংস্থার কর্ণধার বলেছেন, রাজ্যের লঙ্কার দামের তুলনায় আমরা দ্বিগুণ দামে লঙ্কা কিনব কৃষকদের কাছ থেকে । আমরা লঙ্কা চাষের জন্য পলি হাউস, সার থেকে বীজ সবকিছুই দেব ৷ চাষিরা সততার ও পরিশ্রম মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভবান হবেন । সিঙ্গুর চাষের ক্ষেত্রে হটস্পট জোন ৷ গোটা বিশ্বের নজর রয়েছে সিঙ্গুরের উপর । সিঙ্গুর ছাড়াও ডাব গ্রামে আরেকটি ওয়ার হাউস তৈরি হয়েছে ৷ এখানে সুইট পটেটো প্রসেসিং হবে । জাপানে সুইট ক্যান্ডি তৈরি হবে । এছাড়াও কৃষ্ণনগরেও আমাদের আরেকটি প্রজেক্ট তৈরি হবে ।"

green chillies production
সিসিটিভিতে চাষে নজরদারি চলছে (নিজস্ব ছবি)

জাপানি কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার পরিচিতা চক্রবর্তী বলেন, "সিঙ্গুরে 3 হাজার স্কোয়ার ফিটের ওয়ার হাউস রয়েছে । সিঙ্গুরে ও শিলিগুড়ির ডাবগ্রামে ওয়ার হাউস হচ্ছে । বাংলায় ফসল নষ্টের পরিমাণ অনেক বেশি । সেই কারণে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ওয়ার হাউস তৈরি করার জন্য প্রস্তাব দেয় রাজ্য সরকারকে । 2 হাজার কৃষক আমাদের সঙ্গে যুক্ত । প্রতিমাসে 4 লক্ষ টাকা কৃষকদের দেওয়া হয় । বছরে সরাসরি 48 লক্ষ টাকা কৃষকদের অ্যাকাউন্টে যায় । জাপানিরা স্বাস্থ্য সচেতন হয় । তারা জানে পটেটোর (আলু) চেয়েও সুইট পটেটোর খাদ্য গুণাগুণ অনেক বেশি । শিলিগুড়িতে সুইট পটেটোর উপর খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট তৈরির পরিকল্পনা আছে । সুইট পটেটো ক্যান্ডি ও স্ন্যাকস করা হবে । বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের তত্ত্ববধানে জাপানি টেকনোলজিতে উচ্চ ফলনশীল বীজ ও জৈব চাষ হচ্ছে সিঙ্গুর ও শিলিগুড়িতে ।"

green chillies production
কাঁচা লঙ্কা চাষ করছেন হুগলির কৃষকরা (নিজস্ব ছবি)

সিঙ্গুর লঙ্কা চাষের হাব তৈরি হওয়ায় মুখ্যমন্ত্রীর সাফল্য দেখছেন কৃষি বিপণন মন্ত্রী বেচারাম মান্না ৷ তিনি বলেন, "মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সব সময় চেয়ে এসেছেন কৃষকরা ফসলের ন্যায্য দাম পাক । সিঙ্গুরে কৃষাণ বাজারে রাজ্য ও জাপানি সংস্থার উদ্যোগে ইতিমধ্যেই জৈব পদ্ধতিতে কৃষকদের চাষ করানো হচ্ছে । আগামিদিনে রাজ্যে চাষ হওয়া লঙ্কা বিদেশে রাজ করবে । এছাড়াও মিশন নির্মল বাংলার মাধ্যমে কৃষকদের হাতে জৈব সার তুলে দিচ্ছি আমরা । যাতে কৃষকরা আরও লাভবান হয় ।"

ETV Bharat Logo

Copyright © 2025 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.