কলকাতা, 30 এপ্রিল: বুধবার বিকেল তখন পাঁচটা 5টা 15 মিনিট । পরপর শববাহী গাড়ি ঢুকছে এনআরএসের মর্গে । নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশকর্মীদের হন্তদন্ত শুরু । দীর্ঘ অপেক্ষার পর ক্যামেরা, বুম নিয়ে এগিয়ে এল সংবাদিকরা । সবমিলিয়ে জনা পঞ্চাশেক । এক প্রকার কোলাহল ! মুহূর্তের মধ্যেই বদলে গেল ছবি ।
ক্যামেরার শাটার ক্লিক আর কোলের দুই সন্তান হারানো মায়ের বুকভাঙা কান্না ছাড়া, কিছুই শোনা যাচ্ছে না । চোখ মুছছেন কলকাতা পুলিশের তাবড় তাবড় আধিকরিকরা । যাঁরা কিছুক্ষণ আগে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকারের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়েছিলেন । জোর গলায় আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ করার হুঁশিয়ারি দিচ্ছিলেন । তাঁদেরই চোখে জল । কারণ, 3 ও 10 বছরের দুই সন্তান হারানো মা বুক চাপড়াচ্ছেন । কপাল চাপড়াচ্ছেন । দু'হাত আকাশে তুলে তামিলভাষায় উত্তর চাইছেন মা ! শুধু পুলিশ নয়, শববাহী গাড়ির চালক, সাংবাদিক সকলেরই চোখে জল ।

পরপর দুটি শববাহী যানে তোলা হচ্ছে তিন বছরের পি. রিথান ও দশ বছরের পি দিয়াকে । 24 ঘণ্টা আগেও যাঁদের হাসিতে জ্বলজ্বল করছিল মায়ের মুখ । মঙ্গলবার রাতে জোড়াসাঁকোর মেছুয়াবাজারের কাছে মদন মোহন বর্মণ স্ট্রিটের এক হোটেলে আগুন লাগে । 6 তলা ভবনের তৃতীয়তলায় লাগা আগুন থেকে বাঁচতে আতঙ্কে কেউ ঝাঁপ দেন । কেউ ঘরবন্দি হয়ে পড়েন । দমকল, পুলিশ, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর সদস্যরা শত চেষ্টা করেও কেউ বাঁচাতে পারেননি ।

রিথান, দিয়া ও তাঁদের দাদুর মতো 15 জনের মৃত্যু হয়েছে । শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘর, জানালা বন্ধ করা হোটেল 'ঋতুরাজ' কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গিয়ে কার্যত গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয়েছিল । তাতেই দমবন্ধ হয়ে চলে গেল 15টা প্রাণ । হোটেল মালিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে । ম্যানেজার গ্রেফতার হয়েছেন । সরকার আর্থিক সাহায্য ঘোষণা করেছে । তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে । রাজনীতিও শুরু হয়েছে । কিন্তু, কোন দোষে এতগুলো তরতাজা প্রাণকে চলে যেতে হল তার উত্তর কারও কাছে নেই ।
তবে, এনআরএসের মর্গের বাইরে তামিলনাড়ুর ভেলিয়ানাইন জোথি ভাদামের দিয়া, রিথানের মা বুক চাপড়ে বারবার বলছিলেন, হোটেল টিভি দেখছিল । দাদুর সঙ্গে তিনজনে ছিল । আমরা দুজনে বেরিয়েছিলাম । ফিরে এসে...... আবার কপাল চাপড়ালেন । নিজেকে দোষী মনে করছেন তিনি !
পুলিশ সূত্রে খবর, রিথান, দিয়া ও তাঁদের দাদু মুট্টু কৃষ্ণানের দেহ পিস ওয়ার্ল্ডে রাখা হবে । সেখান থেকেই যাবতীয় ব্যবস্থা করে তামিলনাড়ুতে পাঠানো হবে ।
অন্যদিকে, উত্তরপ্রদেশের এক যুবতী আকৃতি নাভালগাড়িয়াকে নিমতলা শ্মশানে আজই দাহ করা হয় । ওড়িশার বাসিন্দা মনোজ পত্রকে বাই রোড নিয়ে যাওয়া হবে । তাঁর এক আত্মীয় জানান, ওড়িশা থেকে কলকাতায় এসেছিলেন । বিহারে যাওয়ার কথা ছিল । পেশায় চাকুরিজীবী । খুরদা রোডের বাসিন্দা । আর ফিরতে পারলেন না !
তবে সবমিলিয়ে আজ সকালে মোট 14 জনের তালিকা পাওয়া গেলেও বিকেলে ফিরহাদ হাকিম মোট 15 জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানান । কিন্তু, 15 নম্বর মৃতের পরিচয় সম্বন্ধে স্পষ্ট করে জানাননি ।

বামফ্রন্টের শোকবার্তা ও সরকারকে কটাক্ষ :
এদিকে, এই আগুনের ঘটনায় কলকাতা পুরনিগম ও রাজ্যের সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভপ্রকাশ করেছে বিরোধীরা । গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করে বামফ্রন্ট সভাপতি বিমান বসুর বিবৃতি দিয়ে বলেন, "মঙ্গলবার রাতে বড়বাজারের মেছুয়ার ফলপট্টির একটি হোটেলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় 2 শিশু-সহ 15 জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে । সেই সঙ্গে এই মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডের পিছনে গাফিলতির জন্য দায়ী হোটেল ব্যবসায়ী ও প্রশাসনিক কর্তাদের উপযুক্ত শাস্তির দাবি করছি । ঘটনার পর থেকেই হোটেলের সুরক্ষা ও অগ্নিবিধি ব্যবস্থায় নানা গাফিলতি প্রকাশ্যে আসছে ।"
তিনি আরও বলেন, "জানা গিয়েছে, 2022 সালের পর থেকে ফায়ার ব্রিগেডের নো অবজেকশন সার্টিফিকেট ছিল না হোটেলটির । এছাড়াও হোটেলে বেআইনি নির্মাণ ও পানশালার বেআইনি সম্প্রসারণের ঘটনাও সামনে এসেছে । এই পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য সরকার, কলকাতা কর্পোরেশন, কলকাতা পুলিশ এবং ফায়ার ব্রিগেডের ভূমিকা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে । এর আগেও কলকাতায় গার্ডেনরিচে শাসকদলের মদতে বেআইনি নির্মাণে দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে, বড়বাজারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আবারও স্পষ্ট হল যে কলকাতা কর্পোরেশন ও রাজ্য সরকারের পুলিশ প্রশাসনের গাফিলতিতে নাগরিকদের জীবনের সুরক্ষা বিপন্ন হয়ে পড়েছে । বামফ্রন্ট রাজ্যপ্রশাসনের এই চরম অমানবিক ভূমিকার তীব্র নিন্দা করছে ।"