মালদা, 3 এপ্রিল: 6 এপ্রিল রামনবমী উৎসব ৷ আর তাতে সামিল হতে চলেছেন ইসলাম ধর্মের মানুষজনও ৷ গোটা দেশে সম্প্রীতির উদাহরণ তৈরি করতে চলেছে মালদা শহর ৷
দু'দিন আগেই পেরিয়েছে ঈদ-উল-ফিতর ৷ খুশির ঈদে মালদা শহরে ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে অংশ নিয়েছিল মানুষ ৷ তার ক'দিন আগেই উত্তেজনা ছড়িয়েছিল মোথাবাড়িতে ৷ কিন্তু ঈদের খুশি সেই উত্তেজনায় জল ঢেলে চাঁদনি আলোয় ঢেকে দিয়েছিল মালদা শহরকে ৷ প্রমাণ করে দিয়েছিল, মালদার মানুষ সেই পুরনো দিনের মতোই একে অন্যের সঙ্গে রয়েছে ৷
এবার সামনে রামনবমী ৷ এই উৎসবেও সম্প্রীতির বার্তা দিতে তৈরি মালদার মুসলিম সমাজ ৷ রামের জন্মতিথির উৎসবে সামিল হতে চলেছেন এই শহরের মুসলমানরাও ৷ শহরের রাজমহল রোডে টেন্ট তৈরি করে রবিবারের ধর্মীয় শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করা মানুষজনকে পানীয় জল দেবেন ইসলাম ধর্মের মানুষজন ৷ বিলি করবেন চকোলেট ৷ সঙ্গে থাকছে মিষ্টিমুখের ব্যবস্থাও ৷ সবচেয়ে বড় বিষয়, এবার সনাতনীদের ধর্মীয় মিছিলে পা মেলাতে পারেন তাকিয়া (মুসলিমদের টুপি) পরা মানুষজনও ৷ যদিও এ'বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি ৷

কীভাবে মালদা শহরের মুসলমানরা হিন্দুদের আরাধ্য রামচন্দ্রের জন্মদিবস পালনে সামিল হবেন, তার চূড়ান্ত রূপরেখা ঠিক করতে বৃহস্পতিবার রাতে মালদা শহরের সুভাষপল্লি ঈদগাহ ময়দানে একটি বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ৷ শহরের 31টি মুসলিম মহল্লার প্রতিনিধিদের নিয়ে সেই বৈঠক করবে মালদা শহর মুসলিম কমিটি, আটকোশি আঞ্জুমান আকবরিয়া ইসলামিয়া ৷ ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছে মালদার বিশ্ব হিন্দু পরিষদ নেতৃত্বও ৷
আটকোশি আঞ্জুমান আকবরিয়া ইসলামিয়ার সম্পাদক মহম্মদ আসিফ হোসেন এদিন ইটিভি ভারতকে বলেন, "শহরের ঈদগাহ ময়দানে আমরা হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে ঈদ পালন করেছি ৷ বিভিন্ন মহল্লাতেও সেদিন দুই ধর্মের মানুষের সহাবস্থান লক্ষ্য করা গিয়েছে ৷ রামনবমীর উৎসবে আমরা প্রতি বছরই অংশগ্রহণ করি ৷ আমরা এবারও অংশগ্রহণ করব ৷ রামনবমীর দিন আমরা আটকোশিয়া আঞ্জুমান আকবরিয়া ইসলামিয়ার সদস্যরা শহরের রাজমহল রোডে থাকি ৷ এবারও থাকব ৷"
তাঁর কথায়, "এ'বছর আমরা কীভাবে রামনবমী তিথি পালন করব তা চূড়ান্ত করতে আজ রাতে শহরের সমস্ত মুসলিম মহল্লার প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠকে বসছি ৷ তবে সেদিনের ধর্মীয় মিছিলে অংশ নেওয়া ভাইদের মধ্যে জল-সরবত থেকে শুরু করে মিষ্টিমুখের ব্যবস্থা থাকবে ৷ মালদার মাটি সম্প্রীতির মাটি ৷ এখানে কোনও অশুভ সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচাড়া দিতে পারবে না ৷ তার জন্য আমরা সবাই সজাগ রয়েছি ৷"
তিনি আরও বলেন, "হিন্দু ও মুসলমান একে অন্যের পরিপূরক ৷ আমরা সেই সহাবস্থান বজায় রেখে এই শহরে বাস করি ৷ এখানে কোনও সাম্প্রদায়িক শক্তি কিছু করতে পারবে না ৷ আর সব সম্প্রদায়ের মধ্যেই কিছু দুষ্কৃতী রয়েছে ৷ মোথাবাড়িতে ক'দিন আগে যেটা ঘটেছে সেটা বিক্ষিপ্ত ঘটনা ৷ এর কোনও প্রভাব মালদার মাটিতে পড়েনি, পড়বেও না ৷ আমরা হিন্দু-মুসলমান এতদিন যেভাবে থেকে এসেছি, সেভাবেই থাকতে চাই ৷"

শহরের মুসলিম কমিটির এই মনোভাবকে স্বাগত জানিয়েছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ৷ সংগঠনের নেতা তথা রামনবমী উদযাপন কমিটির কার্যকরী সভাপতি কাজল গোস্বামী বলছেন, "রামচন্দ্র আমাদের ইষ্টদেব ৷ পরমারাধ্য ৷ প্রতি বছর রামনবমীর দিন শহরে একটি ভব্য শোভাযাত্রা বেরোয় ৷ সেই শোভাযাত্রায় লাখ লাখ সনাতনী হিন্দু অংশগ্রহণ করেন ৷ সেই সময় রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের মানুষ জল দিয়ে, ফল দিয়ে, বিভিন্নভাবে মিছিলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করে ৷ আমরা স্বপ্ন দেখি, সুপ্রশাসক ৷ মানে রাজা রাম ৷ আদর্শ রাজ্য মানেই রামরাজ্য ৷ সেই রামে যদি সব ধর্ম ও বর্ণের মানুষ মিশে যেতে পারে তাতে আমাদের কোনও আপত্তি নেই ৷"
তিনি আরও বলেন, "তবে এর সঙ্গে মাথায় রাখতে হবে, সেদিন যে ভব্য শোভাযাত্রা বেরোয় সেটা কিন্তু শুধু সনাতনী হিন্দুদের ৷ শুধুমাত্র হিন্দুরাই এই শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে ৷ রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে যদি অন্যও ধর্ম বা বর্ণের মানুষ রাজা রামের নামে স্লোগান দেয় সেটা তো ভালোই ৷ আর সমস্ত ধর্মই তো সৃষ্টি হয়েছে সনাতনী ধর্ম থেকে ৷ যদি অন্য ধর্মের মানুষ ফের সনাতন ধর্মে মিশে যেতে পারে তবে তাতে আপত্তি কোথায়? এই শোভাযাত্রা রাজা রামের শোভাযাত্রা ৷"
কাজল গোস্বামীর সংযোজন, "এটা শুধুমাত্র সনাতনী হিন্দুদের শোভাযাত্রা ৷ অন্য ধর্ম কিংবা বর্ণের মানুষ শোভাযাত্রায় পা মেলাতেই পারেন ৷ তবে আমরা তাঁদের কোনও আহ্বান করছি না ৷ এতে সমাজে ভুল বার্তা যেতে পারে ৷ সাম্প্রদায়িক বিভেদ তৈরি হতে পারে ৷ আমরা এই বিভেদ তৈরি করতে চাইছি না ৷ আমরা তো বলেছি, যে কোনও রাজনৈতিক দল এই মিছিলে অংশ নিতে পারে ৷ হিন্দুধর্মের এই শোভাযাত্রায় অন্য ধর্মের মানুষ যদি প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন, তাঁদের স্বাগতম ৷"
এই শহরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে দুই ধর্মের মানুষজনের এই প্রচেষ্টা ছুঁয়ে গিয়েছে জেলা প্রশাসনিক কর্তাদের মনও ৷ জেলাশাসক নিতীন সিংহানিয়া বলেন, "এমনটাই তো হওয়া উচিত ৷ এবারের রামনবমী উৎসবে মালদার মানুষের এই প্রচেষ্টা গোটা বিশ্বে উদাহরণ হয়ে উঠুক ৷ আমরা সবাই সেটাই চাই ৷"