কলকাতা, 3 জুন: হৃদযন্ত্রের জটিল সমস্যায় ভুগছিল মালদার এক শিশু ৷ বছর ছয়েকের ওই শিশুকে নিয়ে বেঙ্গালুরুতেও গিয়েছিলেন তার মা-বাবা ৷ কিন্তু কোনও সুরাহা হয়নি৷ শেষ পর্যন্ত কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতাল সুস্থ করল ওই শিশুকে ৷
তার পরিবার থেকে জানা গিয়েছে, সে দীর্ঘদিন ধরে জ্বর, সর্দি-কাশিতে ভুগছিল । বাড়ির সামনের চিকিৎসককে দেখাতেই তিনি ধরে ফেলেন যে শিশুটির হৃদযন্ত্রে রয়েছে একাধিক সমস্যা । সেই চিকিৎসা করানোর জন্যই ছেলেকে নিয়ে বেঙ্গালুরু গিয়েছিলেন ওই দম্পতি ।
শিশুর বাবা বলেন, "সেখান থেকে রেফার করা হয় দিল্লিতে । তবে সেখানে না-গিয়ে নিজের রাজ্যেই ফিরে আসি । তখন আমরা যাই কলকাতার আলিপুরের এক বেসরকারি হাসপাতাল বিএম বিড়লা হার্ট হাসপাতালে ।" সেখানে চিকিৎসক কুন্তল রায়চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করে পরিবার । একাধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর দেখা যায়, জটিল এক রোগে ভুগছে এই শিশুটি । চিকিৎসকের কথায়, এই ঘটনা অত্যন্ত বিরল । সারা পৃথিবীতে খুব কম শিশুর এই ধরনের সমস্যা হয় ।
কিন্তু কী হয়েছিল এই শিশুটির ?
কার্ডিয়াক সার্জেন কুন্তল রায়চৌধুরী বলেন, "আমাদের হৃদয়ের যা গঠন থাকে, ওর ক্ষেত্রে তা ঠিক বিপরীত এবং খুব জটিল । সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে ডানদিকের অলিন্দ যুক্ত থাকে ডানদিকের নিলয়ের সঙ্গে এবং সেটা যুক্ত থাকে ফুসফুসের সঙ্গে । ফুসফুস থেকে অক্সিজেন নিয়ে রক্ত বামদিকে যায় ।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘কিন্তু এই শিশুটির ক্ষেত্রে তা ছিল বিপরীত । অর্থাৎ ওই শিশুটির ডানদিকের অলিন্দর সঙ্গে বাঁদিকের নিলয় যুক্ত ছিল । এর ফলে ডানদিকের অলিন্দ থেকে দূষিত রক্ত যাচ্ছে বাঁদিকের অলিন্দে । এবার সেটা আবার যুক্ত রয়েছে ফুসফুসের সঙ্গে ।’’ এক্ষেত্রে অক্সিজেনের সমস্যা হওয়ার কথা ৷ তবে ওই শিশুর অক্সিজেনের সমস্যা অবশ্য হচ্ছিল না ৷ হৃদযন্ত্রে অক্সিজেন সরবরাহ স্বাভাবিক ছিল ৷ চিকিৎসার ভাষাতে এই সমস্যাকে বলা হয় Congenitally corrected Transposition of Great arteries (CCTGA) ৷
কিন্তু সমস্যা ছিল অন্য জায়গায় । ড. কুন্তল রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘আমাদের সকলের শরীরে বাঁদিকের যে নিলয়, সেটা সবথেকে বেশি শক্তিশালী এবং পেশীবহুল হয় । সেখানেই যুক্ত থাকে মহাধমনী । কিন্তু এই শিশুটার ক্ষেত্রে মহাধমনী ছিল ডান দিকের নিলয়ের সঙ্গে যুক্ত । এর ফলে ওর পাম্পিং চেম্বারে সমস্যা হচ্ছিল । তার পাশাপাশি ওর ডানদিকে যে ভালভ রয়েছে (ট্রাইকাস্পিড ভালভ) সেখানে ছিদ্র ছিল । যেটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকবে এবং ডানদিকের নিলয় অকেজো হয়ে যাবে ৷ তখন হয়তো আর কিছু করার উপায় থাকবে না ।’’
তাছাড়া বাচ্চার হার্টের ফুটোর (Ventricular septal defect) সঙ্গে ফুসফুসের রাস্তা ছোট ছিল (পালমোনারি স্টেনোশিশ)। এই রোগ চিকিৎসকের কথায় অত্যন্ত বিরল । তারই অস্ত্রোপচার করেন চিকিৎসকরা । এই চিকিৎসা পদ্ধতিকে বলা হয় ‘ডাবল সুইচ সার্জারি’ অর্থাৎ সেনিং ও রাসটেলি । এর সঙ্গে ডিকেএস (ড্যামাস-কেয়-স্টানশেল) করা হয় । অর্থাৎ ডাবল সুইচ ও ডিকেএস সার্জারি, দু’টোই করা হয় ।
ড. কুন্তল রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘পূর্বভারতে প্রথম এই সার্জারি করা হল । ওই হার্টের ফুটোকে কাজে লাগিয়ে আমরা ওর অস্ত্রোপচার করেছি । বাঁদিকের নিলয়ের সঙ্গে মহাধমনীকে যুক্ত করেছি । যেটা ওই ছিদ্রটাকে দিয়েই করা হয়েছে । কিন্তু আমরা সেখানে আরও একটা রাস্তা করেছি । অর্থাৎ মহাধমনীতে বাঁদিকের নিলয় যুক্ত হওয়ার জন্য ওর দু’টো রাস্তা রয়েছে । ও যখন বড় হবে, তখন আর ওই ছিদ্রটা বাড়বে না । সেই সময় যাতে রক্ত চলাচলে বাধা না হয়, তাই আরেকটা অতিরিক্ত পথ তৈরি করা মহাধমনীতে রক্ত যাওয়ার জন্য । এর সঙ্গেই সেনিং অপারেশন করে আমরা ডানদিকের অলিন্দের দূষিত রক্ত ডানদিকের নিলয়ের সঙ্গে যুক্ত করেছি ৷"
এই পুরো অস্ত্রোপচার করতে সময় লেগেছে প্রায় আট ঘণ্টার বেশি । এই অস্ত্রপ্রচারে কার্ডিয়াক সার্জেন ড. কুন্তল রায়চৌধুরী ছাড়াও ছিলেন পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজিসট ড. শ্যামাজিৎ সমাদ্দার, পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক ইনটেনসিভিসট ড. শতরূপা মুখোপাধ্যায়, কার্ডিয়াক আন্যাসথেটিসট ড. প্রবীরকুমার দাস । ওই শিশুটির চিকিৎসা হওয়ার সময় হৃদযন্ত্রকে প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা বন্ধ রাখা হয়েছিল । সেই সময় ফুসফুস ও হৃদযন্ত্রের একটি মেশিনের সাহায্যে তাকে রাখা হয়েছিল । এইরকম অপারেশনের জন্য পারফিউশন এবং নার্সিং টিমের সকলের ভূমিকাই খুব গুরুত্বপূর্ণ ।
শিশুটির বাবা বলেন, "আমি পেশায় একটি বেসরকারি পেট্রল পাম্পে কাজ করি । শিশুসাথী কার্ডের সাহায্যে আমরা এই চিকিৎসা করিয়েছি বিনামূল্যে । 5 মে ওর অস্ত্রোপচার করা হয়। 27 মে ওকে হাসপাতাল থেকে ছুটি দিয়েছে । আমার ছেলে সম্পূর্ণ সুস্থ এখন । কোনও সমস্যা নেই ।" ড. কুন্তল রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘এইরকম অপারেশন আশা জাগায় ও প্রমাণ করে যে বাচ্চাদের হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বাইরে যাওয়ার দরকার নেই ।’’