বর্ধমান, 28 এপ্রিল: কবি লিখে গিয়েছেন, 'নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু পাছে পাছে' ৷ আরও লিখেছেন, 'তপন তারা নাচে, নদী সমুদ্র নাচে/জন্মমরণ নাচে, যুগযুগান্ত নাচে/ভকতহৃদয় নাচে বিশ্বছন্দে মাতিয়ে/প্রেমে প্রেমে নাচে ৷' যথার্থই ৷ নাচেই প্রেম, নাচেই মাতে বিশ্বজগৎ ৷
ধরুন, দুর্গাপুজোর বিসর্জনের কার্নিভাল বেরিয়েছে । একদিকে ঢাকের বোল, অন্যদিকে তাসা ক্যাসিওতে বাজছে নানা গানের সুর । যা শুনে ছোট্ট বছর তিনেকের শিশুটি তার বাড়ির দুয়ারে দাদুর কোলে চেপে সমানে হাত-পা-কোমর নাড়িয়ে চলেছে । মনের মতো গানের সুরে হৃদয়ে দোলা লাগলে, নিজের অজান্তেই কোমরও দুলে ওঠে আট থেকে আশির ৷ তা সে নাচ জানুক বা না জানুক ৷
যদিও নৃত্যশিল্পীদের কথায়, নাচ শুধুই বিনোদনের মাধ্যম নয় ৷ শরীর ও মনে এর প্রভাব গভীর ৷ শারীরিক সুস্থতা থেকে স্মৃতিশক্তি উন্নত করা, উদ্বেগ দূর করা এমনকি বিষণ্ণতা কাটাতে নাচের জুড়ি মেলা ভার । নাচ নিজে একটি শিল্প হলেও সেটাই ভাব বিনিময়ের অনবদ্য ভাষা ৷ নিজেকে ভালো রাখার পাশাপাশি গোটা পৃথিবীকে ভালো রাখার অন্যতন শক্তিশালী হাতিয়ার এই নাচ ৷ বিশ্ব নৃত্য দিবসে সেই বার্তাই দিচ্ছেন নৃত্যশিল্পীরা ।

ফরাসি নৃত্যশিল্পী জিন-জর্সেস নোভেরের হাত ধরে আধুনিক ব্যালের সূচনা হয়েছিল । 29 এপ্রিল তাঁরই জন্মদিন । এই দিনটিকেই আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস হিসেবে পালন করা হয় । বিখ্যাত আমেরিকান নৃত্যশিল্পী ও কোরিয়োগ্রাফার অ্যাগনেস ডি মিল-এর মতে, নাচ মানে নিজের থেকে বেরিয়ে আসা । আরও বড়, আরও সুন্দর, আরও শক্তিশালী রূপে আত্মপ্রকাশ । অপর আমেরিকান নৃত্যশিল্পী ও কোরিয়োগ্রাফার মার্থা গ্রাহাম বলেছেন, নৃত্য হল আত্মার লুকনো ভাষা ।

সারা ভারতে সাধারণত 15 রকমের নৃত্য আছে । প্রত্যেক রাজ্যের আবার নিজস্ব কিছু নৃত্য আছে । তবে এর মধ্যে কথক, ভরতনাট্যম, কথাকলি, মণিপুরী, কুচিপুড়ি ও ওডিসি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । প্রতিটিই ক্লাসিক্যাল নৃত্য । তামিলনাড়ুর ভারতনাট্যম, উত্তর পশ্চিম ভারতে কথক, কেরলের কথাকলি, মোহিনীয়াট্টম, ওডিশার ওডিসি ইত্যাদি ।
এছাড়াও আছে সৃজনশীল ও বেশকিছু লোকনৃত্য । যেমন এই রাজ্যের পুরুলিয়ার ছৌ নাচ, অসমের বিহু, রাসলীলা, কর্ণাটকের বেদারা ভেশা-সহ আরও বেশকিছু নৃত্য ৷ নৃত্যশিল্পীদের মতে, 10-14 বছরের ছেলেমেয়েরা যদি নিয়মিত নৃত্যাভ্যাস, তাহলে সবক্ষেত্রেই তাদের সৃজনশীলতা প্রকাশ পায় । তাদের বুদ্ধির বিকাশ ঘটে । শরীর সুস্থ থাকে । মনসংযোগ বাড়ে । নৃত্যগুরুরা বলছেন, প্রতিদিন অন্তত 15 মিনিট থেকে আধ ঘণ্টা নাচ প্র্যাকটিস করলেই তার এতগুলো ভালো দিকের অধিকারী হবে ছেলেমেয়েরা ৷

ভরতনাট্যম শিল্পী তথা বর্ধমানের নৃত্যাঙ্গণের পরিচালক মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় বলেন, "আমি 57 বছর বয়সে এখনও নিয়মিত নাচ প্র্যাকটিস করি । তবে নাচের আগে কিছুক্ষণ বেশকিছু ব্যায়াম করতে হয় । কারণ শরীর যদি আপনার ঠিক না-থাকে, সেক্ষেত্রে কোনও মানুষ নৃত্যশিল্পী হয়ে উঠতে পারবেন না । নাচের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি তাঁর গোটা শরীর দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করেন ৷ তাই আমরা প্রথমে চেষ্টা করি প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর শরীরের গঠন যেন ঠিক থাকে ।"

তাঁর কথায়, "বিভিন্ন এক্সারসাইজকে আমরা নৃত্যের মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করি । কারণ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মাধ্যমেই নাচকে ফুটিয়ে তোলা হয় । নৃত্যশিল্পীদের শরীরের যত্ন নেওয়াটা খুবই জরুরি ৷ সেজন্যই নাচের আগে কিছুক্ষণ ব্যায়াম করে নাচ করা উচিত । আমার গুরুজির বয়স 85 বছর । তিনি এখনও পর্যন্ত নিয়মিত ব্যায়াম করেন, তার পর নাচ প্র্যাকটিস করেন । তাই শরীর ফিট রাখতে গেলে নাচের আগে অবশ্যই 15-30 মিনিট ব্যায়াম করতে হবে ।"

বর্ধমান ছন্দমের পরিচালক তথা সৃজনশীল ও ভরতনাট্যম নৃত্যশিল্পী মেহবুব হাসান বলেন, "নাচের প্রথম কথাই হল আগে নিজে আনন্দ পাও, তারপর অপরকে আনন্দ দাও । নৃত্য করতে গিয়ে যদি মনের সঙ্গে আত্মার যোগ হয়, তাহলে সেটা সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করা যায় । এর কোনও ভাষা নেই । অর্থাৎ শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা যাবে না । বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, 10-14 বছরের ছেলেমেয়েরা যদি নৃত্য করে, তাহলে তাদের সৃজনশীলতা প্রকাশ পায় । তাদের বুদ্ধির বিকাশ ঘটে । নৃত্য করলে নিজের যদি ভালো লাগে, তাহলে অন্যদেরও সেটা আনন্দ দেবে । যদি কেউ নিয়মিত 5-10 মিনিট নাচ প্র্যাকটিস করে, তার সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পেতে বাধ্য ।"

আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসে নৃত্যশিল্পীদের বার্তা, মন খুলে নিজের জন্য নাচুন । তাতে শরীর সুস্থ থাকবে, নিজে ভালো থাকবেন, মানুষ ভালো থাকবে, দেশ ভালো থাকবে, ফলে ভালো থাকবে পৃথিবীও । যা বলে গিয়েছেন কবিও, 'নৃত্যের তালে তালে, নটরাজ/ঘুচাও ঘুচাও ঘুচাও সকল বন্ধ হে'৷