মালদা, 15 এপ্রিল: নতুন করে অশান্তির খবর পাওয়া যায়নি ৷ কিন্তু পরিস্থিতি যে স্বাভাবিক, তাও বলা যাচ্ছে না ৷ উত্তাপের আঁচ এখনও রয়েছে মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর মহকুমায় ৷ প্রাণ বাঁচাতে গঙ্গা পেরিয়ে মালদায় আশ্রয় নিয়েছেন ধুলিয়ান, সুতি, সামশেরগঞ্জের মানুষ ৷ নদী পেরিয়েছেন দিনে এবং রাতেও ৷ কালিয়াচক 3 নম্বর ব্লকের পারলালপুর হাইস্কুলে তাঁদের থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে প্রশাসন ৷
স্থানীয়দের কাছে তাঁরা নিজেদের যে অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন, সেসব শুনলে শিউরে উঠতে হয় ৷ হিংসায় উন্মত্ত দৃষ্কৃতীরা বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে ৷ ঘরে থাকা শিশুদের উদ্ধারে বাধা দিচ্ছে ৷ এমনকী কোথাও কোথাও পানীয় জলে বিষ মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ ৷ চলছে বোমাবাজি ৷ এই সবকিছু চলছে এলাকার জনপ্রতিনিধিদের সামনেই ৷ কোথাও আবার জনপ্রতিনিধিরাই হামলাকারীদের উস্কানি দিচ্ছেন ৷ পুলিশ থেকেও নেই ৷ বিএসএফ-এর সাহায্যে তাঁরা কোনওরকমে প্রাণ হাতে মালদায় পালিয়ে এসেছেন ৷
গত 11 এপ্রিল, শুক্রবার থেকেই উপদ্রুত এলাকাগুলি ছেড়ে মালদায় ঢুকতে শুরু করেছিলেন আক্রান্ত মানুষজন ৷ এদিন সকালেও ঘরছাড়াদের সেই স্রোত দেখা গেল ৷ নৌকা থেকে নেমে দু’জন জানালেন, "ওখানে আমাদের প্রাণ বাঁচানোর কেউ নেই ৷ পুলিশ কিছুই করছে না ৷ চারদিকে বোমাবাজি হচ্ছে ৷ ঘরে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে ৷ বিএসএফ নামার পর ওরা একটু ঠান্ডা হয়েছে ৷ তবে তার মধ্যেও শাসাচ্ছে, পুলিশ-বিএসএফ কতদিন থাকবে ? চলে গেলেই ওরা আমাদের উপর হামলা চালাবে ৷"
মালদায় পা রেখে ওপারের বেদবোনা গ্রামের সুভাষ সরকার বলেন, "এত অত্যাচার সহ্য করা যায় না ৷ বাড়িঘর সমস্ত পুড়িয়ে দিয়েছে ৷ যারা বাধা দিতে যাচ্ছে, তাদের বেধড়ক মারধর করছে ৷ মাঝেমধ্যে পুলিশ এলেও কিছুক্ষণের মধ্যে পালিয়ে যাচ্ছে ৷ আমাদের আর কিছু নেই ৷ কোথায় থাকব জানি না ৷ প্রাণ নিয়ে কোনও রকমে মালদায় চলে এসেছি ৷"
মালদায় পারলালপুর হাইস্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন ধুলিয়ান পুরসভার 16 নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা জয়ন্তী মণ্ডল ৷ তিনি বলেন, "হঠাৎই আমাদের উপর ওরা আক্রমণ শুরু করে ৷ কী কারণে আমাদের উপর এই হামলা, সেটা কেউ বলছে না ৷ প্রথমে আমাদের বাড়ি ভাঙচুর করে ৷ এর মধ্যেই হঠাৎ বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় ৷ চারটে ছেলেমেয়ে নিয়ে কোনওমতে এখানে পালিয়ে এসেছি ৷ স্বামী ওপারেই আছে ৷ ওর সঙ্গে এখনও যোগাযোগ হয়নি ৷ কেমন আছে, কোথায় আছে জানি না ৷ গতকাল এখানে এলেও সরকারের তরফে কেউ যোগাযোগ করেনি ৷ এই এলাকার মানুষজন নদীর ঘাটে মুড়ি খেতে দিয়েছিল ৷ পরে স্কুলে খিচুড়ি দিয়েছে ৷"
ঘরছাড়া সুমিতা সরকারের অভিজ্ঞতা আরও ভয়াবহ ৷ তিনি বলেন, "ওরা মেয়েদের জামাকাপড় ধরে টানাটানি করছে ৷ মানসম্মান বাঁচাতে এপারে চলে এসেছি ৷ আপনারা সবাই সহযোগিতা করুন ৷" পাশ থেকে মীরা মণ্ডল বললেন, "বোমা ফেলছে ৷ আমরা সবাই ধুলিয়ান পুরসভার 4 নম্বর ওয়ার্ডে থাকি ৷ ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর রাজা আবার পুরসভার চেয়ারম্যান ৷ ও দাঁড়িয়ে থেকে হামলা করাচ্ছে ৷"
মালদা জেলা প্রশাসন রবিবার থেকে ঘরছাড়া এই মানুষগুলিকে ফের ঘরে ফেরানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে ৷ এদিন জেলাশাসক নীতীন সিংহানিয়া বলেন, "পারলালপুর হাইস্কুলে মোট 170টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল ৷ গতকাল থেকেই পরিবারগুলি ফের নিজেদের ঘরে ফিরে যাচ্ছে ৷ আপাতত ওই স্কুলে 77টি পরিবার রয়েছে ৷ তাঁদের জন্য খাবার, ওষুধ, পোশাক, পানীয় জল, শিশুখাদ্যের ব্যবস্থা করা হয়েছে ৷ কালিয়াচক 3 নম্বর ব্লকের বিডিও সবসময় নজর রাখছেন ৷"
সোমবার ঘরছাড়া মানুষদের সঙ্গে দেখা করতে যান বিজেপির রাজ্য সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার ৷ প্রত্যেক পরিবারকে আর্থিক সাহায্য করেছেন তিনি ৷ তিনি বলেন, "এই ঘটনার প্রতিবাদে আমরা যেমন জেলায় জেলায় রাস্তায় নামব, তেমনই আদালতে আইনি লড়াই শুরু করব ৷" তিনি পুরো বিষয়টি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে জানাবেন বলেছিলেন ৷
সুকান্ত আরও বলেন, "ঘরছাড়া এই মানুষগুলি যা জানাচ্ছেন, তা ভয়াবহ ৷ তাই মুর্শিদাবাদের উপদ্রুত এলাকায় যাতে কেন্দ্রীয় বাহিনী আরও কিছুদিন রাখা হয়, তা নিয়ে কোর্টে আবেদন জানাব ৷ দলের তরফে আমরা আদালতকে জানাব, কেন্দ্রীয় বাহিনীকে পুলিশ প্রশাসন ঠিকভাবে কাজে লাগাচ্ছে না ৷ তাদের বসিয়ে রাখা হয়েছে ৷ তাই কেন্দ্রীয় বাহিনীকে যেন রাজ্য প্রশাসনের এক্তিয়ারের বাইরে নিয়ে এসে কাজ করানো হয় ৷ এনিয়ে আমি ইতিমধ্যে আমার আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলেছি ৷ আর এই মানুষগুলিকে যদি বাড়ি ফেরাতে হয়, তবে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ এবং নিরাপত্তা দিয়েই তাঁদের ঘরে ফেরাতে হবে ৷"