ETV Bharat / state

স্বপ্নভঙ্গের সিঙ্গুরে দুই নায়িকার লড়াই ও অসীম শূন্যতা - LOK SABHA ELECTION 2024

Hooghly LS Seat: রাজ্যের শিল্প-সম্ভাবনা ধাক্কা খেয়েছিল এখানে। রাজনৈতিক পালাবদলে বড় ভূমিকা রাখা সিঙ্গুরের সর্বত্র আজ না-পাওয়ার যন্ত্রণা । হুগলির জনপদ যেন স্বপ্নভঙ্গের অন্য নাম । ভোটের আগে সিঙ্গুর-উপাখ্যানের ইতিহাস ও বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলেন ইটিভি ভারতের দীপঙ্কর বসু...

author img

By ETV Bharat Bangla Team

Published : May 18, 2024, 10:42 PM IST

Hooghly Lok Sabha Election 2024
হুগলি লোকসভা আসনে লড়াই দুই নায়িকার মধ্যে (ইটিভি ভারত)

হুগলি, 18 মে: বিশ্বকবির ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ পড়া নেই এমন বাঙালির সংখ্যা কম। সেখান থেকে ধার করেই বলা যায়, জেন-ওয়াইয়ের কাছে সিঙ্গুর এক স্বপ্নভঙ্গের নাম। তিলোত্তমা কলকাতাকে আরও গতি দিয়েছে যে কয়েকটি সড়ক, তার অন্যতম দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে। কলকাতার দিক থেকে আসা বা কলকাতার দিকে যাওয়া যাত্রীবাহী থেকে পণ্যবাহী, বহু গাড়ি এই রাস্তা ধরেই চলে যায় ঝাড়খণ্ড, বিহার বা আরও দূরে। দিনরাত অবিরত গাড়ির স্রোত। তবে এই রাস্তার ধারে, কলকাতার পার্শ্ববর্তী একটি অঞ্চলের কেউ কেউ এখনও মনে করেন, এই গাড়ির সংখ্যা আরও অনেকটা বাড়তে পারত। বাড়ত আরও অনেক মানুষজনের আনাগোনা।

"অনেক বেশি গাড়ির চলাচল হত এখানে, কত লোক আসত!" সিংঘের ভেড়ির বাসিন্দা বনমালী পালের দৃষ্টি দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে পেরিয়ে অন্যপারের ঘাসের প্রান্তরে হারিয়ে যায়। সেই পোড়ো জমির দিকে। যা 2011-তে বাংলার রাজনৈতিক সমীকরণ আমূল বদলে দিয়েছিল। তবে আজকের সিঙ্গুর, আজকের সিংহের ভেড়ি, বেড়াবেড়ি, বাজেমেলিয়ার অধিকাংশ মানুষজন আর না-হওয়া ন্যানো গাড়ির কারখানা নিয়ে কথা বলেন না। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে আগামী 20 তারিখ আবারও তাঁরা ভোটার লাইনে দাঁড়াবেন। ওইদিন হুগলি লোকসভা কেন্দ্রে ভোট।

2019 সালে তৎকালীন সাংসদ রত্না দে নাগকে হারিয়ে বিজেপি প্রার্থী লকেট চট্টোপাধ্যায়ের জেতা অনেকের কাছেই ছিল বড় চমক। তবে সেটাই প্রথম নয়। এর আগেও হুগলিতে উড়েছিল গেরুয়া পতাকা। 1952 সালে দেশে প্রথম নির্বাচনের সময় এই আসন থেকে জিতেছিলেন অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভার প্রার্থী নির্মল চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এরপর থেকে টানা 2009 পর্যন্ত বামেদের দুর্ভেদ্য ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিল হুগলি ।

মাঝে মাত্র একবার যতিচিহ্ন পড়ে। 1984 সালে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির মৃত্যুর পরের ভোটে এই আসনে জিতেছিল কংগ্রেস। একটা সময় হুগলির সংসদীয় আসনের সঙ্গে এখানকার সিপিএম সাংসদ রূপচাঁদ পালের নাম কার্যত সমার্থক হয়ে গিয়েছিল। বদল আসে 2009 সালে।

2004 সালের পর থেকে ভরা বাম আমলেও হুগলি নিয়ে ক্রমশ চিন্তিত হয়ে উঠেছিলেন সিপিএম নেতৃত্ব। এককালের নিশ্চিত আসন শিল্পতালুক হুগলিতে ততদিনে ঘটে গিয়েছে বেশ কয়েকটি ঘটনা। দেশকে আইকনিক অ্যাম্বাসাডর গাড়ি দেওয়া হিন্দমোটর কারখানা বন্ধের মুখে। বন্ধ শাহগঞ্জের ডানলপ কারখানাও। রিষড়া থেকে ত্রিবেণী পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা পাট শিল্পের অবস্থাও বেশ শোচনীয়। কাপড়ের মিল থেকে সার তৈরির কারখানাগুলির অবস্থাও বলার মতো নয়। এমনই বিষম দৃশ্যের প্রেক্ষাপটে আবির্ভাব সিঙ্গুর-উপাখ্যানের।

সপ্তমবার বিধানসভা নির্বাচনে জিতে সিঙ্গুরে টাটাদের নিয়ে এসে কারখানা করার পরিকল্পনা করে বাম সরকার। প্রায় হাজার একরের কাছাকাছি জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা হয়। প্রথম থেকেই আপত্তি জানান তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। হাতে ধানের শিস নিয়ে নিজের প্রতিবাদ ধ্বনিত করেন লোকসভাতেও। এরই মধ্যে কারখানা তৈরি শুরু হয়। 2006 সালের ডিসেম্বর মাসে আমরণ অনশন শুরু করেন মমতা। তাতেও কারখানা নির্মাণ বন্ধ হয়নি। 2008-এর জানুয়ারিতে জমি অধিগ্রহণের পক্ষেই রায় দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট। তবে নিজের অবস্থান থেকে সরে আসেননি মমতা।

সে বছর মে মাসের পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় মাথা তুলে দাঁড়ায় তৃণমূল। ততদিনে নন্দীগ্রামের ঘটনাও ঘটে গিয়েছে। একদিকে গ্রামে নির্বাচনী সাফল্য, অন্যদিকে সমাজের বিভিন্ন স্তরে তৈরি হওয়ার চাপকে কাজে লাগিয়ে অগস্টে নয়া রাজনৈতিক কর্মসূচি শুরু করলেন মমতা। কলকাতার বুকে শুরু হল অনির্দিষ্টকালের ধরনা। সামগ্রিক চাপের মুখে পরের মাসে কাজ বন্ধ করল টাটারা। সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী হয়েছিল বাম সরকার। বিরোধী নেত্রীর সঙ্গে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে আলোচনা চলল। মাত্র দু'দিনের মধ্যেই বোঝা গেল এই আলোচনা থেকে সমাধান সূত্র বেরবে না।

কিছুদিন পর এলো 2008-এর অক্টোবর মাসের 3 তারিখ। রতন টাটা ঘোষণা করলেন তাঁরা সিঙ্গুর থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন। পরের বছর লোকসভা ভোটে প্রবল বাম বিরোধী হাওয়ায় রত্না দে নাগের কাছে প্রায় 81,100 ভোটে হেরে গেলেন রূপচাঁদ পাল। লোকসভা নির্বাচনে ভালো ফল মমতার রাজনৈতিক লক্ষ্যের অর্ধেক পথ পেরিয়ে আসা। 2011 সালের বিধানসভা নির্বাচনে বৃত্ত সম্পন্ন হল। সাড়ে তিন দশক পর বামেদের বিদায় হল বাংলার মসনদ থেকে।

2009 সালের লোকসভা নির্বাচনে হুগলিতে আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল। 1952 সালের পর এই প্রথমবার এখানে 40 হাজারের বেশি ভোট পায় বিজেপি। 2014 সালের মোদি ঝড়ে সেই ভোট আরও বাড়ে। বিজেপি প্রার্থী সাংবাদিক চন্দন মিত্র 2 লক্ষের বেশি ভোট পান। শতাংশের বিচারে প্রায় 13 শতাংশ ভোট গিয়েছিল বিজেপির ঝুলিতে। হুগলির উর্বর জমিতে ফসল ফলবে বুঝতে পেরেছিল গেরুয়া শিবির। 2019 সালে অভিনেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যাকে প্রার্থী করার সিদ্ধান্ত সেই ভাবনারই ফল। এবং এলো জয়। রত্না দে নাগ-কে পরাজিত করেন লকেট। ব্যবধান 73,000-এর কিছু বেশি ভোট।

লোকসভা নির্বাচনের বছর দুয়েক পরে হওয়া বিধানসভা নির্বাচনে অবশ্য সম্পূর্ণ বিপরীত পরিস্থিতি দেখেছিল হুগলি। এই লোকসভা আসনের অন্তর্গত সাতটি বিধানসভাতেই জয় পেয়েছিল বাংলার শাসক শিবির। খোদ সাংসদ লকেটও হেরে গিয়েছিলেন চুঁচুড়া বিধানসভা কেন্দ্র থেকে। এবার সেই হুগলি আসনে লড়াই টলিউডের দুই তারকার। লকেটের মুখোমুখি তাঁরই একসময়ের সতীর্থ রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়। জনপ্রিয় টেলিভিশন শো দিদি নম্বর ওয়ানের হাত ধরে রচনার জনপ্রিয়তা গত কয়েক বছরে আরও বহুগুণ বেড়েছে। আর এই দু’জনের সঙ্গেই আছেন বাম প্রার্থী মনোদীপ ঘোষ।

নির্বাচনের আগে লকেট বা রচনা কেউই যে দারুণ স্বস্তিতে আছেন তা বলা যাবে না। বাংলা সিনেমার নায়িকার সহজাত স্টার তকমা অনেক দিন আগেই ঝেড়ে ফেলেছেন লকেট। এখন তিনি পূর্ণ সময়ের রাজনীতিবিদ। সমস্যা এই সময় নিয়েই। হুগলি লোকসভা কেন্দ্রে নানা প্রান্তে পোস্টার সেঁটে বলা হয়েছে নিজের সংসদীয় এলাকায় তেমন সময় দেন না লকেট। তাঁর ছবির উপরে নিখোঁজ তকমা পর্যন্ত পড়েছে। সুখে নেই রচনাও। শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগের পাশাপাশি তাঁর অস্বস্তির বড় কারণ তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। বলাগড় থেকে শুরু করে পান্ডুয়ার, দলীয় অসন্তোষ রচনাকে চিন্তায় রেখেছে । তবে তাঁর একটি বাড়তি সুবিধে আছে । তিনি হুগলির ঘরের মেয়ে নন । অতএব, বাইরে থেকে এসেছেন বলে এই গোষ্ঠীকোন্দল এর শরিকও নন।

অন্যদিকে বাম প্রার্থীর জন্য লড়াইটা বেশ কঠিন বললেও কম বলা হয়। এবারে বাংলায় বাম-কংগ্রেসের আসন সমঝোতা হয়েছে। সেই হিসেব করলে গত নির্বাচনে তাদের প্রাপ্ত ভোট ছিল মাত্র দশ শতাংশ। এই হিসেবে বদলে দিয়ে বামেদের নয়া রূপচাঁদ হওয়া মনোদীপের পক্ষে মোটেই সহজ কাজ হবে না।

দুই নায়িকার লড়াইতে জমজমাট হুগলির নির্বাচন। তবে এই সব কিছুর থেকে অনেকটা দূরে, ওই দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের পশ্চিমপারের আগাছায় ছেয়ে যাওয়া জমি, আজও নিঃশব্দে তাকিয়ে রয়েছে। সিঙ্গুর জানে ওই রাস্তাটায় গাড়ির সংখ্যা আরও বাড়তে পারত , আরও লোকজনের সমাগমও ঘটতো। কিন্তু, হয়নি । হুগলিতে ভোট আগামী 20 তারিখ।

আরও পড়ুন:

  1. লকেট না রচনা, কে হবেন হুগলির 'দিদি নম্বর 1'
  2. ‘ধোঁয়া’ বিতর্ক দূরে ঠেলে প্রচারের শেষদিনে মানুষের হাসিমুখই শুধু নজরে এল ‘রাজনীতিক’ রচনার
  3. লকেটের বিরুদ্ধে টাকা বিলির অভিযোগ অভিষেকের, পালটা জবাব হুগলির বিজেপি প্রার্থীর

হুগলি, 18 মে: বিশ্বকবির ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ পড়া নেই এমন বাঙালির সংখ্যা কম। সেখান থেকে ধার করেই বলা যায়, জেন-ওয়াইয়ের কাছে সিঙ্গুর এক স্বপ্নভঙ্গের নাম। তিলোত্তমা কলকাতাকে আরও গতি দিয়েছে যে কয়েকটি সড়ক, তার অন্যতম দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে। কলকাতার দিক থেকে আসা বা কলকাতার দিকে যাওয়া যাত্রীবাহী থেকে পণ্যবাহী, বহু গাড়ি এই রাস্তা ধরেই চলে যায় ঝাড়খণ্ড, বিহার বা আরও দূরে। দিনরাত অবিরত গাড়ির স্রোত। তবে এই রাস্তার ধারে, কলকাতার পার্শ্ববর্তী একটি অঞ্চলের কেউ কেউ এখনও মনে করেন, এই গাড়ির সংখ্যা আরও অনেকটা বাড়তে পারত। বাড়ত আরও অনেক মানুষজনের আনাগোনা।

"অনেক বেশি গাড়ির চলাচল হত এখানে, কত লোক আসত!" সিংঘের ভেড়ির বাসিন্দা বনমালী পালের দৃষ্টি দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে পেরিয়ে অন্যপারের ঘাসের প্রান্তরে হারিয়ে যায়। সেই পোড়ো জমির দিকে। যা 2011-তে বাংলার রাজনৈতিক সমীকরণ আমূল বদলে দিয়েছিল। তবে আজকের সিঙ্গুর, আজকের সিংহের ভেড়ি, বেড়াবেড়ি, বাজেমেলিয়ার অধিকাংশ মানুষজন আর না-হওয়া ন্যানো গাড়ির কারখানা নিয়ে কথা বলেন না। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে আগামী 20 তারিখ আবারও তাঁরা ভোটার লাইনে দাঁড়াবেন। ওইদিন হুগলি লোকসভা কেন্দ্রে ভোট।

2019 সালে তৎকালীন সাংসদ রত্না দে নাগকে হারিয়ে বিজেপি প্রার্থী লকেট চট্টোপাধ্যায়ের জেতা অনেকের কাছেই ছিল বড় চমক। তবে সেটাই প্রথম নয়। এর আগেও হুগলিতে উড়েছিল গেরুয়া পতাকা। 1952 সালে দেশে প্রথম নির্বাচনের সময় এই আসন থেকে জিতেছিলেন অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভার প্রার্থী নির্মল চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এরপর থেকে টানা 2009 পর্যন্ত বামেদের দুর্ভেদ্য ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিল হুগলি ।

মাঝে মাত্র একবার যতিচিহ্ন পড়ে। 1984 সালে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির মৃত্যুর পরের ভোটে এই আসনে জিতেছিল কংগ্রেস। একটা সময় হুগলির সংসদীয় আসনের সঙ্গে এখানকার সিপিএম সাংসদ রূপচাঁদ পালের নাম কার্যত সমার্থক হয়ে গিয়েছিল। বদল আসে 2009 সালে।

2004 সালের পর থেকে ভরা বাম আমলেও হুগলি নিয়ে ক্রমশ চিন্তিত হয়ে উঠেছিলেন সিপিএম নেতৃত্ব। এককালের নিশ্চিত আসন শিল্পতালুক হুগলিতে ততদিনে ঘটে গিয়েছে বেশ কয়েকটি ঘটনা। দেশকে আইকনিক অ্যাম্বাসাডর গাড়ি দেওয়া হিন্দমোটর কারখানা বন্ধের মুখে। বন্ধ শাহগঞ্জের ডানলপ কারখানাও। রিষড়া থেকে ত্রিবেণী পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা পাট শিল্পের অবস্থাও বেশ শোচনীয়। কাপড়ের মিল থেকে সার তৈরির কারখানাগুলির অবস্থাও বলার মতো নয়। এমনই বিষম দৃশ্যের প্রেক্ষাপটে আবির্ভাব সিঙ্গুর-উপাখ্যানের।

সপ্তমবার বিধানসভা নির্বাচনে জিতে সিঙ্গুরে টাটাদের নিয়ে এসে কারখানা করার পরিকল্পনা করে বাম সরকার। প্রায় হাজার একরের কাছাকাছি জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা হয়। প্রথম থেকেই আপত্তি জানান তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। হাতে ধানের শিস নিয়ে নিজের প্রতিবাদ ধ্বনিত করেন লোকসভাতেও। এরই মধ্যে কারখানা তৈরি শুরু হয়। 2006 সালের ডিসেম্বর মাসে আমরণ অনশন শুরু করেন মমতা। তাতেও কারখানা নির্মাণ বন্ধ হয়নি। 2008-এর জানুয়ারিতে জমি অধিগ্রহণের পক্ষেই রায় দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট। তবে নিজের অবস্থান থেকে সরে আসেননি মমতা।

সে বছর মে মাসের পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় মাথা তুলে দাঁড়ায় তৃণমূল। ততদিনে নন্দীগ্রামের ঘটনাও ঘটে গিয়েছে। একদিকে গ্রামে নির্বাচনী সাফল্য, অন্যদিকে সমাজের বিভিন্ন স্তরে তৈরি হওয়ার চাপকে কাজে লাগিয়ে অগস্টে নয়া রাজনৈতিক কর্মসূচি শুরু করলেন মমতা। কলকাতার বুকে শুরু হল অনির্দিষ্টকালের ধরনা। সামগ্রিক চাপের মুখে পরের মাসে কাজ বন্ধ করল টাটারা। সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী হয়েছিল বাম সরকার। বিরোধী নেত্রীর সঙ্গে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে আলোচনা চলল। মাত্র দু'দিনের মধ্যেই বোঝা গেল এই আলোচনা থেকে সমাধান সূত্র বেরবে না।

কিছুদিন পর এলো 2008-এর অক্টোবর মাসের 3 তারিখ। রতন টাটা ঘোষণা করলেন তাঁরা সিঙ্গুর থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন। পরের বছর লোকসভা ভোটে প্রবল বাম বিরোধী হাওয়ায় রত্না দে নাগের কাছে প্রায় 81,100 ভোটে হেরে গেলেন রূপচাঁদ পাল। লোকসভা নির্বাচনে ভালো ফল মমতার রাজনৈতিক লক্ষ্যের অর্ধেক পথ পেরিয়ে আসা। 2011 সালের বিধানসভা নির্বাচনে বৃত্ত সম্পন্ন হল। সাড়ে তিন দশক পর বামেদের বিদায় হল বাংলার মসনদ থেকে।

2009 সালের লোকসভা নির্বাচনে হুগলিতে আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল। 1952 সালের পর এই প্রথমবার এখানে 40 হাজারের বেশি ভোট পায় বিজেপি। 2014 সালের মোদি ঝড়ে সেই ভোট আরও বাড়ে। বিজেপি প্রার্থী সাংবাদিক চন্দন মিত্র 2 লক্ষের বেশি ভোট পান। শতাংশের বিচারে প্রায় 13 শতাংশ ভোট গিয়েছিল বিজেপির ঝুলিতে। হুগলির উর্বর জমিতে ফসল ফলবে বুঝতে পেরেছিল গেরুয়া শিবির। 2019 সালে অভিনেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যাকে প্রার্থী করার সিদ্ধান্ত সেই ভাবনারই ফল। এবং এলো জয়। রত্না দে নাগ-কে পরাজিত করেন লকেট। ব্যবধান 73,000-এর কিছু বেশি ভোট।

লোকসভা নির্বাচনের বছর দুয়েক পরে হওয়া বিধানসভা নির্বাচনে অবশ্য সম্পূর্ণ বিপরীত পরিস্থিতি দেখেছিল হুগলি। এই লোকসভা আসনের অন্তর্গত সাতটি বিধানসভাতেই জয় পেয়েছিল বাংলার শাসক শিবির। খোদ সাংসদ লকেটও হেরে গিয়েছিলেন চুঁচুড়া বিধানসভা কেন্দ্র থেকে। এবার সেই হুগলি আসনে লড়াই টলিউডের দুই তারকার। লকেটের মুখোমুখি তাঁরই একসময়ের সতীর্থ রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়। জনপ্রিয় টেলিভিশন শো দিদি নম্বর ওয়ানের হাত ধরে রচনার জনপ্রিয়তা গত কয়েক বছরে আরও বহুগুণ বেড়েছে। আর এই দু’জনের সঙ্গেই আছেন বাম প্রার্থী মনোদীপ ঘোষ।

নির্বাচনের আগে লকেট বা রচনা কেউই যে দারুণ স্বস্তিতে আছেন তা বলা যাবে না। বাংলা সিনেমার নায়িকার সহজাত স্টার তকমা অনেক দিন আগেই ঝেড়ে ফেলেছেন লকেট। এখন তিনি পূর্ণ সময়ের রাজনীতিবিদ। সমস্যা এই সময় নিয়েই। হুগলি লোকসভা কেন্দ্রে নানা প্রান্তে পোস্টার সেঁটে বলা হয়েছে নিজের সংসদীয় এলাকায় তেমন সময় দেন না লকেট। তাঁর ছবির উপরে নিখোঁজ তকমা পর্যন্ত পড়েছে। সুখে নেই রচনাও। শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগের পাশাপাশি তাঁর অস্বস্তির বড় কারণ তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। বলাগড় থেকে শুরু করে পান্ডুয়ার, দলীয় অসন্তোষ রচনাকে চিন্তায় রেখেছে । তবে তাঁর একটি বাড়তি সুবিধে আছে । তিনি হুগলির ঘরের মেয়ে নন । অতএব, বাইরে থেকে এসেছেন বলে এই গোষ্ঠীকোন্দল এর শরিকও নন।

অন্যদিকে বাম প্রার্থীর জন্য লড়াইটা বেশ কঠিন বললেও কম বলা হয়। এবারে বাংলায় বাম-কংগ্রেসের আসন সমঝোতা হয়েছে। সেই হিসেব করলে গত নির্বাচনে তাদের প্রাপ্ত ভোট ছিল মাত্র দশ শতাংশ। এই হিসেবে বদলে দিয়ে বামেদের নয়া রূপচাঁদ হওয়া মনোদীপের পক্ষে মোটেই সহজ কাজ হবে না।

দুই নায়িকার লড়াইতে জমজমাট হুগলির নির্বাচন। তবে এই সব কিছুর থেকে অনেকটা দূরে, ওই দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের পশ্চিমপারের আগাছায় ছেয়ে যাওয়া জমি, আজও নিঃশব্দে তাকিয়ে রয়েছে। সিঙ্গুর জানে ওই রাস্তাটায় গাড়ির সংখ্যা আরও বাড়তে পারত , আরও লোকজনের সমাগমও ঘটতো। কিন্তু, হয়নি । হুগলিতে ভোট আগামী 20 তারিখ।

আরও পড়ুন:

  1. লকেট না রচনা, কে হবেন হুগলির 'দিদি নম্বর 1'
  2. ‘ধোঁয়া’ বিতর্ক দূরে ঠেলে প্রচারের শেষদিনে মানুষের হাসিমুখই শুধু নজরে এল ‘রাজনীতিক’ রচনার
  3. লকেটের বিরুদ্ধে টাকা বিলির অভিযোগ অভিষেকের, পালটা জবাব হুগলির বিজেপি প্রার্থীর
ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.