মালদা, 17 এপ্রিল: বৃহস্পতিবার ভোর তিনটে ৷ পুরাতন মালদার বাচামারিতে বেজে উঠল ঢাক ৷ শেষ রাতে দূর থেকেও ভেসে এল ঢ্যাং কুরকুর ৷ জানান দিল, শুরু হল এ'বছরের গম্ভীরা মরশুম ৷
মালদা জেলার প্রাচীন লোকসংস্কৃতি গম্ভীরা ৷ প্রতি বছর বৈশাখ মাসে গম্ভীরার মাধ্যমে শিব বন্দনা করা হয় ৷ আগে গোটা জেলায় এই উৎসবের ব্যাপ্তি থাকলেও বর্তমানে শুধুমাত্র পুরাতন মালদার বাচামারি এলাকাতেই প্রাচীন সেই ধারা অটুট রয়েছে ৷ এদিন শেষ রাতে শুরু হওয়া এই উৎসবের প্রহর চলবে সারা মাস ৷ শেষ হবে 31 বৈশাখ ৷ বড় তামাশার মাধ্যমে ৷
গম্ভীরা শিবের আরাধনা ৷ এর অন্যতম অংশ চামুণ্ডা ও বুড়িকালীর মুখা নৃত্য ৷ প্রতি বছর বৈশাখের দ্বিতীয় দিবাগত রাতে মশাল নাচের মাধ্যমে এই উৎসবের সূচনা হয় ৷ আর উৎসব শেষ হয় চামুণ্ডা মুখা নৃত্যের মাধ্যমে ৷ কালের নিয়মে এই লোকসংস্কৃতির অনেক ধারা বিলুপ্তপ্রায় ৷ তবে এখনও বাচামারিতে মুখা নৃত্য চালু রয়েছে ৷ জেলাবাসীর বক্তব্য, এদিন মা কালীর দুই রূপ, বুড়িকালী ও চামুণ্ডাকালীর মিলনের দিন ৷ বাচামারিতে পাশাপাশি দুই পাড়ায় থাকা দুই বোনের মন্দিরই এদিন ভোর থেকে ছিল সরগরম ৷ দুই বোনের মিলন উৎসবের সাক্ষী হতে স্থানীয়দের সঙ্গে ভিড় করেছিলেন দূর থেকে আসা অনেক মানুষজনও ৷
এলাকার এক প্রৌঢ়া পূরবী দাস বর্মার কথায়, "এই প্রথা অন্তত 400 বছরের পুরনো ৷ বিয়ের পর আমি এখানে এসে থেকেই এই প্রথা দেখে আসছি ৷ এখানে মা কালীরা দুই বোন থাকেন ৷ বড় বোন চামুণ্ডাকালী আমাদের পাড়ায় থাকেন ৷ পাশের পাড়ায় থাকেন ছোট বোন বুড়িকালী ৷ আজ দুই বোনের মিলন হয় ৷ আগে এখানে এঁরা তিন বোন ছিলেন ৷ আমাদের পাড়ার মহানন্দা ঘাট থেকেই তিন বোন উঠে এসেছিলেন ৷ কিন্তু তিন বোন নাকি সবসময় ঝগড়া করতেন ৷ মা চামুণ্ডা এখানে নাকি একাই থাকবেন ৷ তখন আমার শ্বশুরের পূর্বপুরুষরা এক বোনকে পাশের পাড়ায় দিয়ে দেন ৷ আরেক বোনের মুখোশ প্রায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল ৷ সেটি বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল ৷"

তিনি আরও বলেন, "প্রতি বছর দোসরা বৈশাখ মাঝরাতে গম্ভীরা গানের আসর বসে ৷ রাতভর গান চলে ৷ ভোরবেলায় সবাই স্নান সেরে মূল উৎসবে অংশ নেয় ৷ প্রথমে বড় বোনের মুখা নাচ হয় ৷ মা চামুণ্ডা নাচতে নাচতে ছোট বোনের কাছে যান ৷ সেখানে দুই বোনের নাচ হয় ৷ নাচতে নাচতেই দুই বোন ফের এ'পাড়ায় আসেন ৷ এখানে মা চামুণ্ডা নিজের ঘরে ঢুকে যান ৷ পরে বুড়িকালীকেও তাঁর ঘরে নিয়ে গিয়ে রাখা হয় ৷ দেবীর আদেশেই আজ দুই বোনের পুজো করা হয় ৷"
প্রাচীন প্রথার সাক্ষী থাকতে এদিন ভোর রাতেই বাচামারি পৌঁছে গিয়েছিলেন পুরাতন মালদা পুরসভার চেয়ারম্যান কার্তিক ঘোষ ৷ তিনি বলেন, "বাচামারি অনেক পুরনো পাড়া ৷ পুরসভার 7 নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে পড়ে ৷ মালদা জেলার লোকসংস্কৃতির বাহক হল গম্ভীরা ৷ চৈত্র সংক্রান্তি থেকে এই উৎসব শুরু হলেও বৈশাখের দুই তারিখ থেকে এই সংস্কৃতির বিস্তার ঘটে ৷ গোটা বৈশাখ মাস ধরে এই উৎসব চলে ৷"
তাঁর সংযোজন, "গম্ভীরার অর্থ মহাকাল বা শিব ৷ আমরা এই উৎসবের মাধ্যমে শিবের কাছে প্রার্থনা করি ৷ মানুষ দুঃখ-কষ্ট থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসবে তার উপায় জানতে চাই ৷ সাধারণত স্থানীয় এলাকার সমস্যা নিয়েই প্রতিটি জায়গায় গম্ভীরা পালিত হয় ৷ এখানে আজ অনেকেই এসেছেন ৷ শিল্পীরা প্রাচীন এই লোকসংস্কৃতি তুলে ধরছেন ৷ এখানে প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে মুখা নাচ হয়ে থাকে ৷ এই উৎসবে আমরা মালদাবাসীকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি ৷"