ETV Bharat / state

সচেতনতার অভাবে পৃথিবী দেখার স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে দৃষ্টিহীনদের, হতাশার ছবি চক্ষুদান দিবসে - EYE DONATION DAY

আজ আন্তর্জাতিক চক্ষুদান দিবস ৷ তবে সচেতনতার অভাবে মৃত্যুর পর চোখ দান করার দায়িত্ববোধ আজও জন্মাচ্ছে না মানুষের মধ্যে ৷ একটি প্রতিবেদন ৷

ETV BHARAT
হতাশার ছবি চক্ষুদান দিবসে (ফাইল চিত্র)
author img

By ETV Bharat Bangla Team

Published : June 10, 2025 at 7:46 PM IST

7 Min Read

আসানসোল, 10 জুন: একজন মৃত ব্যক্তির কর্নিয়া থেকে দু'জন মানুষ দৃষ্টি ফিরে পায় । অর্থাৎ পরিবার বা কোনও আপনজন যদি প্রয়াত হন, তাহলে তাঁর শরীরের অংশ বেঁচে থাকে আরও দু'জনের দেহে । মৃতদেহের কোনও বিকৃতি না ঘটিয়েই এই কর্নিয়া তোলা হয় । শুধু প্রয়োজন একটু সচেতনতার । মৃত্যুর 6 ঘণ্টার মধ্যেই এই কর্নিয়া তোলা সম্ভব । যার জন্য প্রয়োজন শুধুমাত্র একটা ফোন । বিষয়টা এতটাই সহজ হলেও, আন্তর্জাতিক চক্ষুদান দিবসে এই নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ধরা পড়ল একরাশ হতাশার ছবি ৷

সচেতনতার অভাবে 'চক্ষুদান' এখনও পর্যন্ত মানুষের মনে সেভাবে দায়িত্ববোধের জায়গা নিতে পারেনি । ফলে শবদেহের সঙ্গেই সৎকার হয়ে যায় দু'জন দৃষ্টিহীনের পৃথিবীকে দেখার সম্ভাবনা । আর এই কষ্টই কুঁড়ে কুঁড়ে খায়, যাঁরা এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে, সেই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে ।

হতাশার ছবি চক্ষুদান দিবসে (নিজস্ব ভিডিয়ো)

নয়ের দশকে আসানসোলে শুরু হয় চক্ষুদান

1993 সালে আসানসোলে তৈরি হয়েছিল আসানসোল প্রিভেনশন অফ ব্লাইন্ডনেস সোসাইটি । যাদের প্রধান কাজ ছিল, মৃত মানুষের চোখ থেকে কর্নিয়া তুলে তা সরকারি হাসপাতালে যথাসময়ে পাঠিয়ে দিয়ে দৃষ্টিহীনদের দৃষ্টি ফিরিয়ে দেওয়া ৷ 1993 সালে আসানসোলের এক স্বাধীনতা সংগ্রামীর মৃত্যুর পর প্রথম চক্ষুদান করেছিল তার পরিবার । পারিবারিক সচেতনতায় তার মৃত্যুর পর পরিবারের লোকেরা চোখ দুটি দান করেছিলেন । সেই শুরু । এখনও পর্যন্ত প্রায় দু'হাজার মৃত মানুষের কর্নিয়া সংগ্রহ করেছেন এই সংগঠনের সদস্যরা ও চিকিৎসকরা ।

তা সরকারি হাসপাতাল ও অন্যান্য দৃষ্টি হাসপাতালের সহযোগিতায় সফলভাবে প্রতিস্থাপিত হয়েছে দৃষ্টিহীনদের চোখে । বহু মানুষ দৃষ্টি ফিরে পেয়েছেন । পৃথিবীর আলো দেখেছেন । কিন্তু যেভাবে এই সচেতনতা গড়ে ওঠা দরকার ছিল, মানুষের দায়িত্ববোধ বেড়ে ওঠার দরকার ছিল, তা আজও হয়নি । একদিকে সচেতনতার অভাব, অন্যদিকে কুসংস্কার । নানা কারণে মৃত্যুর পর কর্নিয়া শবদেহের সঙ্গেই পুড়িয়ে দেওয়া হয় বা কবর দিয়ে দেওয়া হয় । অথচ একজন মৃত মানুষের কর্নিয়া দিয়ে দু'জন দৃষ্টিহীন দৃষ্টি ফিরে পেতে পারতেন !

একই বৃত্তে 'চক্ষুদান' আন্দোলন

1993 সাল থেকে আসানসোলে চক্ষুদান আন্দোলন শুরু হলেও এখনও পর্যন্ত প্রায় একই বৃত্তে আটকে এই মহান কাজ । যদি প্রতি বছরের পরিসংখ্যান দেখা হয়, তাহলে এই কাজে বিরাট জোয়ার এসেছে বলে দাবি করা যায় না । 2020-21 সালে করোনা থাকায় এই চক্ষুদান আন্দোলনে ভাটা পড়েছিল । যদি 2020 সালের ক্যালেন্ডার বর্ষ দেখা যায়, তাহলে দেখা যাবে মোট 22টি মৃতদেহ থেকে 44টি কর্নিয়া তোলা হয়েছিল । 2021 সালে সেই সংখ্যা খানিকটা বাড়ে । 26টি মৃতদেহ থেকে 52টি কর্নিয়া তোলা হয় ।

ETV BHARAT
আসানসোল প্রিভেনশন অফ ব্লাইন্ডনেস সোসাইটি (নিজস্ব চিত্র)

2022 সালে সেই সংখ্যাটি অবশ্য দ্বিগুণ হয় ৷ 50টি মৃতদেহ থেকে 100টি কর্নিয়া তোলা হয় । 2023 সালে সেই সংখ্যা খুব একটা বাড়েনি । 57টি মৃতদেহ থেকে 114টি কর্নিয়া তোলা হয় এবং 2024 সালে সেই একই বৃত্তে 52টি মৃতদেহ থেকে 104টি কর্নিয়া তোলা হয়েছিল । এবছরের মে মাস পর্যন্ত 14টি মৃতদেহ থেকে 28টি কর্নিয়া তোলা হয়েছে । আসানসোলের মতো একটি এত বড় মহাকুমা অঞ্চলে এই সংখ্যা একেবারেই তলানিতে ঠেকে আছে বলে অভিমত সমাজকর্মীদের ।

কীভাবে এগিয়ে আসতে পারেন সবাই

মৃত্যুর ছয় ঘণ্টার মধ্যে কর্নিয়া দান সম্ভব, এমনটাই জানাচ্ছেন আসানসোল প্রিভেনশন অফ ব্লাইন্ডনেস সোসাইটির সম্পাদক প্রদ্যুৎ মজুমদার । তিনি ইটিভি ভারতকে জানান, "মৃত্যুর পর প্রাথমিক শোক কাটিয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে যদি আমাদের কাছে খবর আসে, তাহলে আমরা পরবর্তী এক ঘণ্টার মধ্যে মৃত ব্যক্তির বাড়ি কিংবা হাসপাতালে পৌঁছাতে পারি । এক্ষেত্রে যাঁরা চক্ষুদান করবেন বলে মনস্থির করেছেন, তাঁদের কয়েকটি জিনিস করার থাকে । এক, খুব দ্রুত খবর পৌঁছানো আমাদের কাছে । দ্বিতীয়ত, যে স্থানে মৃতদেহ থাকবে সেখানে ফ্যান চালানো যাবে না । তাহলে চোখের কর্নিয়া শুকিয়ে যেতে পারে । এছাড়া মৃতদেহের চোখ বন্ধ ক'রে তার উপর তুলো দিয়ে দুই চোখে দুটি বরফের টুকরো রেখে দিলে, চোখটি ভেজা বা আর্দ্র অবস্থায় থাকবে । ডেথ সার্টিফিকেটের ফটোকপি অবশ্যই হাতের কাছে রাখবেন ।"

প্রদ্যুৎ মজুমদার আরও জানান, "কর্নিয়া তোলার পর বিশেষ রাসায়নিক ব্যবহার করে তা রাখা হয় এবং সেটি 96 ঘণ্টা পর্যন্ত ঠিক থাকতে পারে । তার মধ্যেই বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে আমরা সেই কর্নিয়া দুটিকে পাঠিয়ে দিই এবং তা কর্নিয়া খারাপ থাকা দৃষ্টিহীনদের চোখে প্রতিস্থাপিত হয় । এছাড়াও এই কর্নিয়া চিকিৎসা বিজ্ঞানের আরও অনেক কাজে লাগে ৷ তাই মৃতদেহের সঙ্গে এই অমূল্য সম্পদ পুড়িয়ে নষ্ট করবেন না একটা মাত্র ফোন করুন আমাদের তাহলেই হবে । প্রায় 200 বছর বাঁচে একটি কর্নিয়া ৷"

চক্ষুদান করলে মৃতদেহের বিকৃতি হয় না

প্রদ্যুৎ মজুমদার আরও জানান, সচেতনতার অভাব থেকেই অনেকে চক্ষুদানে এগিয়ে আসেন না । পরিবারের লোক ভাবেন হয়তো বা চক্ষুদান করলে মৃতদেহের বিকৃতি হতে পারে । জানিয়ে রাখা ভালো, মৃতদেহ থেকে কিন্তু সম্পূর্ণ চোখ তোলা হয় না । তোলা হয় শুধুমাত্র কর্নিয়াটুকু এবং তার বদলে সেখানে ক্যাপ লাগিয়ে দেওয়া হয় । ফলে সাধারণ চোখে দেখে বোঝা যায় না যে মৃতদেহের কর্নিয়া তোলা হয়েছে । সাধারণ মানুষের কাছে এই বার্তা পৌঁছানো প্রয়োজন, চক্ষুদান করার পর মৃতদেহের কোনওরকম ভাবেই কোনও বিকৃতি ঘটে না ।

মানুষজন এগিয়ে আসছেন না সচেতনতার অভাবে

সমাজকর্মী প্রদ্যুৎ মজুমদারের আক্ষেপ, এ রাজ্যে রক্তদান আন্দোলন যতটা গতি পেয়েছে, চক্ষুদান নিয়ে ততটা সচেতনতা গড়ে ওঠেনি । এতে খানিকটা সরকারেরও অনীহা রয়েছে বলেই দাবি তাঁর ।

তিনি বলেন, "এর আগে পুরনিগম বা অন্যান্য সংস্থার কাছ থেকে সরকারিভাবে হোর্ডিং কিংবা বিভিন্ন প্রচারের আয়োজন করা হত । এখন সেসব আর হয় না । আগে বহু সংগঠন এগিয়ে আসত এইসব কাজে, এখন সংগঠনগুলিও সেই উৎসাহ পাচ্ছে না । ফলে মানুষ সচেতন হচ্ছে না । যত বেশি সেমিনার হবে, যত বেশি প্রচার হবে, যত বেশি বিভিন্ন সংগঠন মানুষের কাছে বিষয়টিকে নিয়ে যাবে, ততই মানুষ ধীরে ধীরে সচেতন হবে । মৃত্যুর পর কোনও পরিবারের কাছে এই বার্তা পৌঁছানোর প্রয়োজন তাঁর আত্মীয় পরিজন কিংবা বন্ধু-বান্ধবদের । সেই ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে যাচ্ছে বিষয়টা অর্থাৎ প্রচার ও সচেতনতা না বাড়লে চক্ষুদান আন্দোলন এই বৃত্তেই থেকে যাবে ।"

সংগঠনগুলি কেন হারাচ্ছে উৎসাহ

রক্তদান আন্দোলনে যেভাবে অন্যান্য সংগঠন এগিয়ে আসে সেরকমভাবে চক্ষুদান আন্দোলন নিয়ে খুব একটা সাংগঠনিক তৎপরতা দেখা যায় না বলে সমাজকর্মীদের দাবি । কারণ, চক্ষুদান করার সময় বড় উৎসব কিংবা ইভেন্ট তৈরি করা যায় না । শোকের পরিবেশে মৃতের বাড়িতে গিয়ে সেখান থেকে চোখ তুলে নিয়ে আসতে হয় । ফলে অনেক ক্ষেত্রেই বিভিন্ন সংগঠন কোনও কাজের পরিপ্রেক্ষিতে যে ক্রেডিট আশা করে তা আর হয়ে ওঠে না । কারণ সেই চোখ দ্রুত পাঠিয়ে দেওয়া হয় বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে। চক্ষুদান বিষয়টি পরিবার ও যাঁরা কর্নিয়া সংগ্রহ করবেন, তাঁদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাওয়ার কারণে এই আন্দোলন ব্যাপ্তি পায়নি ।

চোখ অমূল্য, বাঁচাতেই হবে

আসানসোল প্রিভেনশন অফ ব্লাইন্ডনেস সোসাইটির আরেক সমাজকর্মী সুব্রত বাগচী জানালেন, "আমরা মানুষের কাছে এখনও পর্যন্ত এই বিষয়টি উপস্থাপিত করতে ব্যর্থ যে, মৃত্যুর পরে ওই মৃতদেহের দুটি চোখ দিয়ে দু'জন দৃষ্টিহীন মানুষ দৃষ্টি ফিরে পেতে পারেন । আমাদের প্রিয়জনরা বেঁচে থাকতে পারেন আরও দু'জনের মধ্যে । এটুকু আমরা এখনও পর্যন্ত বোঝাতে পারিনি । আগে গ্রামে গঞ্জে মৃতের আত্মীয়, পরিজন, প্রতিবেশীদের কাছ থেকে আমরা সহযোগিতা পেতাম । কিন্তু এখন দিনে দিনে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি হয়ে যাওয়ায় কেউ আর এগিয়ে এসে আমাদের কাছে ফোন করে না৷ বর্তমান প্রজন্মেরও এসব নিয়ে কোনও উৎসাহ নেই । কোনও ব্যক্তির মৃত্যু হলে পুরোহিত থেকে শুরু করে দশকর্মা অন্যান্য সমস্ত জিনিসের জোগাড় করার জন্য সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেও চক্ষুদানের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস, যেটা একটি ফোন করলেই হয়, সেই ফোনটুকু আর আমাদের কাছে আসে না । কীভাবে এই সচেতনতা গড়ে উঠতে পারে, সেটাই আমরা ভেবে আকুল, আমরা কাজ করে চলেছি ।"

আসানসোল, 10 জুন: একজন মৃত ব্যক্তির কর্নিয়া থেকে দু'জন মানুষ দৃষ্টি ফিরে পায় । অর্থাৎ পরিবার বা কোনও আপনজন যদি প্রয়াত হন, তাহলে তাঁর শরীরের অংশ বেঁচে থাকে আরও দু'জনের দেহে । মৃতদেহের কোনও বিকৃতি না ঘটিয়েই এই কর্নিয়া তোলা হয় । শুধু প্রয়োজন একটু সচেতনতার । মৃত্যুর 6 ঘণ্টার মধ্যেই এই কর্নিয়া তোলা সম্ভব । যার জন্য প্রয়োজন শুধুমাত্র একটা ফোন । বিষয়টা এতটাই সহজ হলেও, আন্তর্জাতিক চক্ষুদান দিবসে এই নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ধরা পড়ল একরাশ হতাশার ছবি ৷

সচেতনতার অভাবে 'চক্ষুদান' এখনও পর্যন্ত মানুষের মনে সেভাবে দায়িত্ববোধের জায়গা নিতে পারেনি । ফলে শবদেহের সঙ্গেই সৎকার হয়ে যায় দু'জন দৃষ্টিহীনের পৃথিবীকে দেখার সম্ভাবনা । আর এই কষ্টই কুঁড়ে কুঁড়ে খায়, যাঁরা এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে, সেই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে ।

হতাশার ছবি চক্ষুদান দিবসে (নিজস্ব ভিডিয়ো)

নয়ের দশকে আসানসোলে শুরু হয় চক্ষুদান

1993 সালে আসানসোলে তৈরি হয়েছিল আসানসোল প্রিভেনশন অফ ব্লাইন্ডনেস সোসাইটি । যাদের প্রধান কাজ ছিল, মৃত মানুষের চোখ থেকে কর্নিয়া তুলে তা সরকারি হাসপাতালে যথাসময়ে পাঠিয়ে দিয়ে দৃষ্টিহীনদের দৃষ্টি ফিরিয়ে দেওয়া ৷ 1993 সালে আসানসোলের এক স্বাধীনতা সংগ্রামীর মৃত্যুর পর প্রথম চক্ষুদান করেছিল তার পরিবার । পারিবারিক সচেতনতায় তার মৃত্যুর পর পরিবারের লোকেরা চোখ দুটি দান করেছিলেন । সেই শুরু । এখনও পর্যন্ত প্রায় দু'হাজার মৃত মানুষের কর্নিয়া সংগ্রহ করেছেন এই সংগঠনের সদস্যরা ও চিকিৎসকরা ।

তা সরকারি হাসপাতাল ও অন্যান্য দৃষ্টি হাসপাতালের সহযোগিতায় সফলভাবে প্রতিস্থাপিত হয়েছে দৃষ্টিহীনদের চোখে । বহু মানুষ দৃষ্টি ফিরে পেয়েছেন । পৃথিবীর আলো দেখেছেন । কিন্তু যেভাবে এই সচেতনতা গড়ে ওঠা দরকার ছিল, মানুষের দায়িত্ববোধ বেড়ে ওঠার দরকার ছিল, তা আজও হয়নি । একদিকে সচেতনতার অভাব, অন্যদিকে কুসংস্কার । নানা কারণে মৃত্যুর পর কর্নিয়া শবদেহের সঙ্গেই পুড়িয়ে দেওয়া হয় বা কবর দিয়ে দেওয়া হয় । অথচ একজন মৃত মানুষের কর্নিয়া দিয়ে দু'জন দৃষ্টিহীন দৃষ্টি ফিরে পেতে পারতেন !

একই বৃত্তে 'চক্ষুদান' আন্দোলন

1993 সাল থেকে আসানসোলে চক্ষুদান আন্দোলন শুরু হলেও এখনও পর্যন্ত প্রায় একই বৃত্তে আটকে এই মহান কাজ । যদি প্রতি বছরের পরিসংখ্যান দেখা হয়, তাহলে এই কাজে বিরাট জোয়ার এসেছে বলে দাবি করা যায় না । 2020-21 সালে করোনা থাকায় এই চক্ষুদান আন্দোলনে ভাটা পড়েছিল । যদি 2020 সালের ক্যালেন্ডার বর্ষ দেখা যায়, তাহলে দেখা যাবে মোট 22টি মৃতদেহ থেকে 44টি কর্নিয়া তোলা হয়েছিল । 2021 সালে সেই সংখ্যা খানিকটা বাড়ে । 26টি মৃতদেহ থেকে 52টি কর্নিয়া তোলা হয় ।

ETV BHARAT
আসানসোল প্রিভেনশন অফ ব্লাইন্ডনেস সোসাইটি (নিজস্ব চিত্র)

2022 সালে সেই সংখ্যাটি অবশ্য দ্বিগুণ হয় ৷ 50টি মৃতদেহ থেকে 100টি কর্নিয়া তোলা হয় । 2023 সালে সেই সংখ্যা খুব একটা বাড়েনি । 57টি মৃতদেহ থেকে 114টি কর্নিয়া তোলা হয় এবং 2024 সালে সেই একই বৃত্তে 52টি মৃতদেহ থেকে 104টি কর্নিয়া তোলা হয়েছিল । এবছরের মে মাস পর্যন্ত 14টি মৃতদেহ থেকে 28টি কর্নিয়া তোলা হয়েছে । আসানসোলের মতো একটি এত বড় মহাকুমা অঞ্চলে এই সংখ্যা একেবারেই তলানিতে ঠেকে আছে বলে অভিমত সমাজকর্মীদের ।

কীভাবে এগিয়ে আসতে পারেন সবাই

মৃত্যুর ছয় ঘণ্টার মধ্যে কর্নিয়া দান সম্ভব, এমনটাই জানাচ্ছেন আসানসোল প্রিভেনশন অফ ব্লাইন্ডনেস সোসাইটির সম্পাদক প্রদ্যুৎ মজুমদার । তিনি ইটিভি ভারতকে জানান, "মৃত্যুর পর প্রাথমিক শোক কাটিয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে যদি আমাদের কাছে খবর আসে, তাহলে আমরা পরবর্তী এক ঘণ্টার মধ্যে মৃত ব্যক্তির বাড়ি কিংবা হাসপাতালে পৌঁছাতে পারি । এক্ষেত্রে যাঁরা চক্ষুদান করবেন বলে মনস্থির করেছেন, তাঁদের কয়েকটি জিনিস করার থাকে । এক, খুব দ্রুত খবর পৌঁছানো আমাদের কাছে । দ্বিতীয়ত, যে স্থানে মৃতদেহ থাকবে সেখানে ফ্যান চালানো যাবে না । তাহলে চোখের কর্নিয়া শুকিয়ে যেতে পারে । এছাড়া মৃতদেহের চোখ বন্ধ ক'রে তার উপর তুলো দিয়ে দুই চোখে দুটি বরফের টুকরো রেখে দিলে, চোখটি ভেজা বা আর্দ্র অবস্থায় থাকবে । ডেথ সার্টিফিকেটের ফটোকপি অবশ্যই হাতের কাছে রাখবেন ।"

প্রদ্যুৎ মজুমদার আরও জানান, "কর্নিয়া তোলার পর বিশেষ রাসায়নিক ব্যবহার করে তা রাখা হয় এবং সেটি 96 ঘণ্টা পর্যন্ত ঠিক থাকতে পারে । তার মধ্যেই বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে আমরা সেই কর্নিয়া দুটিকে পাঠিয়ে দিই এবং তা কর্নিয়া খারাপ থাকা দৃষ্টিহীনদের চোখে প্রতিস্থাপিত হয় । এছাড়াও এই কর্নিয়া চিকিৎসা বিজ্ঞানের আরও অনেক কাজে লাগে ৷ তাই মৃতদেহের সঙ্গে এই অমূল্য সম্পদ পুড়িয়ে নষ্ট করবেন না একটা মাত্র ফোন করুন আমাদের তাহলেই হবে । প্রায় 200 বছর বাঁচে একটি কর্নিয়া ৷"

চক্ষুদান করলে মৃতদেহের বিকৃতি হয় না

প্রদ্যুৎ মজুমদার আরও জানান, সচেতনতার অভাব থেকেই অনেকে চক্ষুদানে এগিয়ে আসেন না । পরিবারের লোক ভাবেন হয়তো বা চক্ষুদান করলে মৃতদেহের বিকৃতি হতে পারে । জানিয়ে রাখা ভালো, মৃতদেহ থেকে কিন্তু সম্পূর্ণ চোখ তোলা হয় না । তোলা হয় শুধুমাত্র কর্নিয়াটুকু এবং তার বদলে সেখানে ক্যাপ লাগিয়ে দেওয়া হয় । ফলে সাধারণ চোখে দেখে বোঝা যায় না যে মৃতদেহের কর্নিয়া তোলা হয়েছে । সাধারণ মানুষের কাছে এই বার্তা পৌঁছানো প্রয়োজন, চক্ষুদান করার পর মৃতদেহের কোনওরকম ভাবেই কোনও বিকৃতি ঘটে না ।

মানুষজন এগিয়ে আসছেন না সচেতনতার অভাবে

সমাজকর্মী প্রদ্যুৎ মজুমদারের আক্ষেপ, এ রাজ্যে রক্তদান আন্দোলন যতটা গতি পেয়েছে, চক্ষুদান নিয়ে ততটা সচেতনতা গড়ে ওঠেনি । এতে খানিকটা সরকারেরও অনীহা রয়েছে বলেই দাবি তাঁর ।

তিনি বলেন, "এর আগে পুরনিগম বা অন্যান্য সংস্থার কাছ থেকে সরকারিভাবে হোর্ডিং কিংবা বিভিন্ন প্রচারের আয়োজন করা হত । এখন সেসব আর হয় না । আগে বহু সংগঠন এগিয়ে আসত এইসব কাজে, এখন সংগঠনগুলিও সেই উৎসাহ পাচ্ছে না । ফলে মানুষ সচেতন হচ্ছে না । যত বেশি সেমিনার হবে, যত বেশি প্রচার হবে, যত বেশি বিভিন্ন সংগঠন মানুষের কাছে বিষয়টিকে নিয়ে যাবে, ততই মানুষ ধীরে ধীরে সচেতন হবে । মৃত্যুর পর কোনও পরিবারের কাছে এই বার্তা পৌঁছানোর প্রয়োজন তাঁর আত্মীয় পরিজন কিংবা বন্ধু-বান্ধবদের । সেই ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে যাচ্ছে বিষয়টা অর্থাৎ প্রচার ও সচেতনতা না বাড়লে চক্ষুদান আন্দোলন এই বৃত্তেই থেকে যাবে ।"

সংগঠনগুলি কেন হারাচ্ছে উৎসাহ

রক্তদান আন্দোলনে যেভাবে অন্যান্য সংগঠন এগিয়ে আসে সেরকমভাবে চক্ষুদান আন্দোলন নিয়ে খুব একটা সাংগঠনিক তৎপরতা দেখা যায় না বলে সমাজকর্মীদের দাবি । কারণ, চক্ষুদান করার সময় বড় উৎসব কিংবা ইভেন্ট তৈরি করা যায় না । শোকের পরিবেশে মৃতের বাড়িতে গিয়ে সেখান থেকে চোখ তুলে নিয়ে আসতে হয় । ফলে অনেক ক্ষেত্রেই বিভিন্ন সংগঠন কোনও কাজের পরিপ্রেক্ষিতে যে ক্রেডিট আশা করে তা আর হয়ে ওঠে না । কারণ সেই চোখ দ্রুত পাঠিয়ে দেওয়া হয় বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে। চক্ষুদান বিষয়টি পরিবার ও যাঁরা কর্নিয়া সংগ্রহ করবেন, তাঁদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাওয়ার কারণে এই আন্দোলন ব্যাপ্তি পায়নি ।

চোখ অমূল্য, বাঁচাতেই হবে

আসানসোল প্রিভেনশন অফ ব্লাইন্ডনেস সোসাইটির আরেক সমাজকর্মী সুব্রত বাগচী জানালেন, "আমরা মানুষের কাছে এখনও পর্যন্ত এই বিষয়টি উপস্থাপিত করতে ব্যর্থ যে, মৃত্যুর পরে ওই মৃতদেহের দুটি চোখ দিয়ে দু'জন দৃষ্টিহীন মানুষ দৃষ্টি ফিরে পেতে পারেন । আমাদের প্রিয়জনরা বেঁচে থাকতে পারেন আরও দু'জনের মধ্যে । এটুকু আমরা এখনও পর্যন্ত বোঝাতে পারিনি । আগে গ্রামে গঞ্জে মৃতের আত্মীয়, পরিজন, প্রতিবেশীদের কাছ থেকে আমরা সহযোগিতা পেতাম । কিন্তু এখন দিনে দিনে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি হয়ে যাওয়ায় কেউ আর এগিয়ে এসে আমাদের কাছে ফোন করে না৷ বর্তমান প্রজন্মেরও এসব নিয়ে কোনও উৎসাহ নেই । কোনও ব্যক্তির মৃত্যু হলে পুরোহিত থেকে শুরু করে দশকর্মা অন্যান্য সমস্ত জিনিসের জোগাড় করার জন্য সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেও চক্ষুদানের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস, যেটা একটি ফোন করলেই হয়, সেই ফোনটুকু আর আমাদের কাছে আসে না । কীভাবে এই সচেতনতা গড়ে উঠতে পারে, সেটাই আমরা ভেবে আকুল, আমরা কাজ করে চলেছি ।"

ETV Bharat Logo

Copyright © 2025 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.