সুপ্রিম নির্দেশে চাকরিহারা শিক্ষাকর্মী দম্পতি, পেট চালাতে স্বামীর হাতে স্টিয়ারিং, স্ত্রী বিক্রি করছেন চপ-মুড়ি
সংসার চালাতে চপ-মুড়ি শিল্পে আস্থা চাকরিহারা শিক্ষাকর্মীর ৷ স্কুল ছেড়ে চপের দোকান নিয়ে বিদ্রুপ শুনতে হলেও জীবনধারণে নিরুপায় সিংহ দম্পতি ৷

Published : October 9, 2025 at 5:12 PM IST
মালদা, 9 অক্টোবর: নিয়োগ দুর্নীতিতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে চাকরি গিয়েছে শিক্ষাকর্মী দম্পতির ৷ পেট চালাতে ও ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে স্বামী হাতে তুলে নিয়েছেন স্টিয়ারিং ৷ আর স্ত্রী আঁকড়ে ধরেছেন রাজ্যে বহুল চর্চিত 'চপ শিল্প'কেই ৷ তাঁদের এই পরিস্থিতির জন্য সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীকে দায়ী করেছেন তনুশ্রী সাহা ৷
রতুয়ায় বাড়ি তনুশ্রী সাহা সিংহের ৷ 2018 সালে রতুয়া 2 নম্বর ব্লকের সম্বলপুর অঞ্চল হাইস্কুলে চাকরি পান তনুশ্রী ৷ শিক্ষাকর্মী হিসাবে ওই স্কুলে যোগদান করেন ৷ ওই একই স্কুলে শিক্ষাকর্মী হিসাবে সেই বছরই কাজে যোগ দেন তাঁর স্বামী বিজয় সিংহ ৷ দু’জনের চাকরিতে সংসার ভালোভাবেই চলছিল ৷ তাঁদের এক ছেলে, এক মেয়ে ৷ ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে মালদা শহরের গৌড় রোড এলাকায় ভাড়া বাড়িতে বসবাস শুরু করে দম্পতি ৷ শহর থেকেই প্রতিদিন স্কুলে যাতায়াত করতেন ৷ ছেলেকে শহরের অন্যতম নামী স্কুল, ললিতমোহন শ্যামমোহিনী উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি করেন ৷ ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে ৷
সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল ৷ সিংহ দম্পতির মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ৷ শীর্ষ আদালত 2018 সালে রাজ্যে শিক্ষাকর্মী নিয়োগের পুরো প্যানেল বাতিল করে দেয় ৷ চাকরিহারা হয়ে পড়েন 26 হাজার মানুষ ৷ যার রয়েছে এই সিংহ দম্পতি ৷ চাকরি হারানোর পর কিছুদিন কোনও কাজ করতে পারেননি তাঁরা ৷ আশেপাশের মানুষের কটাক্ষে কিছুদিন বাড়ি থেকেই বেরোতে পারেননি ৷ জমানো টাকা দিয়ে সংসার চলছিল ৷ সেই টাকা ধীরে ধীরে শেষ হতে থাকে ৷ রয়েছে ঋণের বোঝাও ৷ ছেলেমেয়ের পড়াশোনা প্রায় বন্ধ হতে বসে ৷ বাড়ির ভাড়া বকেয়া হতে শুরু করে ৷ এই পরিস্থিতিতে সংসার চালানো তাঁদের পক্ষে কঠিন হয়ে উঠেছিল ৷ চাকরি ফিরে পেতে প্রথমে দু’জনেই আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন ৷ কিন্তু কোনও লাভ হয়নি ৷ উল্ট বারবার কলকাতা যাতায়াতে খরচও হচ্ছিল অনেক ৷ তাই শেষ পর্যন্ত গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে তুলে নেন বিজয় সিংহ ৷ ভোর থেকে রাত পর্যন্ত গাড়ি চালান ৷ আর তনুশ্রী সিংহ শহরের ব্যস্ততম রথবাড়ি এলাকায়, তৃণমূলের জেলা সদর দফতর থেকে মাত্র 100 মিটার দূরে স্টেশন রোডের ধারে একটি গুমটি ভাড়া নিয়ে শুরু করেন চপ-মুড়ি আর ঘুঘনির ব্যবসা ৷ সেই গুমটিতে বিভিন্ন ধরনের ঠাণ্ডা পানীয়, চিপস, বিড়ি-সিগারেটও রেখেছেন তিনি ৷ তবে মূলত চপ-মুড়ি আর ঘুঘনির উপরেই তাঁর ব্যবসা নির্ভরশীল ৷
তনুশ্রী সিংহ বলেন, “আমাদের এই অবস্থার জন্য মুখ্যমন্ত্রীই সম্পূর্ণ দায়ী ৷ তাঁর জন্য আমাদের চাকরি চলে গিয়েছে ৷ সম্বলপুর অঞ্চল হাইস্কুলে শিক্ষাকর্মী হিসাবে কাজ করতাম ৷ মাঝেমধ্যে পড়ুয়াদের পড়াতামও ৷ হঠাৎ করেই সুপ্রিম কোর্ট পুরো নিয়োগ প্যানেলটাই বাতিল করে দিল ৷ 26 হাজার জনের চাকরি গেল ৷ এখন চপ-ঘুঘনি বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছি ৷ এমনটা যে হতে পারে, তা কখনও ভাবতে পারিনি ৷ আমার কিছু বলার নেই ৷ আমাদের মানসিক পরিস্থিতির কথা বলে বোঝাতে পারব না ৷ বাড়িতে আমরা চারজন ছাড়াও শাশুড়ি রয়েছেন ৷ সংসার তো চালাতে হবে ৷”
স্কুল এখন ছুটি ৷ তাই মাকে সাহায্যের জন্য দোকানে আসে বিশালও ৷ সে জানায়, “মা-বাবার চাকরি চলে গিয়েছে ৷ তাই স্কুল যখন ছুটি থাকে, তখন মাকে সাহায্য করতে চলে আসি ৷” ছোট ছেলেটাও যেন বুঝে গিয়েছে, চাকরিহারা মা-বাবার পক্ষে সংসারের বিশাল দায়িত্ব পালন করা কতটা কঠিন ৷

তনুশ্রীর দোকানের নিয়মিত খদ্দের অটোস্ট্যান্ডের চালক থেকে যাত্রীরা ৷ স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল একতাজ জানান, “সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এই দম্পতির চাকরি চলে গিয়েছে ৷ তাই এই মহিলা বর্তমানে চপ-ঘুঘনির দোকান করছেন ৷ তিনি দোকান শুরু করার সময় আমরা বিষয়টি জানতে পারি ৷ তারপর থেকে আমরা নিয়মিত এখানে আসি ৷ খাবার খাই ৷ তাঁকে সামান্য সাহায্যের চেষ্টা করি ৷”
এই ঘটনা ঘিরে জলঘোলা হয়েছে রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও ৷ বিজেপি নেতা বিশ্বজিৎ রায় বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী নিজে বারবার নিদান দিয়েছেন, এমএ, পিএইচডি-এমফিল করে সবাই যেন চপ-মুড়ির দোকান করেন ৷ তিনি বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন, চপ-মুড়ি বিক্রি করে নাকি তিনতলা বাড়ি করা যায় ৷ এই ঘটনা মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের জ্বলন্ত উদাহরণ ৷ সুপ্রিম রায়ে 26 হাজার চাকরিজীবীর মধ্যে এই দম্পতিরও চাকরি গিয়েছে ৷ স্ত্রী এখন চপের দোকান করছেন ৷ মাননীয়ার কাছে আমার প্রশ্ন, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর পরিবারে যাঁরা আছেন, তাঁরা বিদেশে পড়াশোনা করছেন ৷ আর পশ্চিমবঙ্গের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করার পর চপ-ঘুঘনির দোকান করবে ৷ এটা কোন নিদান ? চাকরি হারিয়ে বা না-পেয়ে উচ্চশিক্ষিত বেকার যুবকরা নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে মুখ ঢেকে রাতে টোটো চালাচ্ছেন ৷ 2026 সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে সাধারণ জনগণ এবং চাকরিহারারা এর যোগ্য জবাব দেবেন ৷”
বিজেপি নেতার মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে তৃণমূলের জেলা সহসভাপতি শুভময় বসুর গলায় যেন দলনেত্রীরই বক্তব্যের প্রতিধ্বনি ৷ তিনি বলেন, “জীবনধারণ করার জন্য কোনও কাজই ছোট নয় ৷ এই শহরে অনেকেই রাস্তার ধারে বিরিয়ানি বিক্রি করতেন ৷ আজ তাঁরা বড় বড় দোকান করেছেন ৷ যারা এসব কাজ ছোট করে দেখে, তাদের হাতে আসলে অন্য রাস্তা দিয়ে অর্থ আসে ৷ আর মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন, সবাই যেন স্বনির্ভর হয় ৷ কে চা বিক্রি করল, কে ঘুঘনি বিক্রি করল, কে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মশলা বিক্রি করল, সেটা বড় বিষয় নয় ৷ অনেক শিক্ষিত লোকজন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্য হিসাবে বাড়ি বাড়ি সামগ্রী বিক্রি করেন ৷ এসব মানুষকে বিজেপি-র মতো মনুবাদী দলই কটাক্ষ করতে পারে ৷ ওই দম্পতির চাকরি খোয়ানোর বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন ৷ এনিয়ে দলীয়ভাবে আমাদের কোনও বক্তব্য নেই ৷”
সংসার-সন্তানদের লেখাপড়া চালাতে শিক্ষাকর্মীর চাকরি হারানো মালদার এই দম্পতি বাধ্য হয়েই চপ-মুড়ির শিল্পে আস্থা রেখেছে ৷ স্কুল ছেড়ে চপের দোকান নিয়ে অনেক বিদ্রুপ শুনতে হলেও জীবনধারণে নিরুপায় সিংহ দম্পতি ৷

