ETV Bharat / state

সপ্তমীর হোমের আগুন নেভে বিসর্জনে! অতীত আঁকড়ে মণ্ডল বাড়ির দুর্গাপুজো

পরিবারের প্রবীণ দম্পতি পুজোয় উপবাস করেন, সপ্তমীর হোমের আগুন নেভে দশমীতে ৷ মণ্ডল বাড়ির পুজোর বিশেষত্ব তুলে ধরলেন ইটিভি ভারতের প্রতিনিধি শুভজিৎ দাস ৷

Etv Bharat
Etv Bharat (Etv Bharat)
author img

By ETV Bharat Bangla Team

Published : September 17, 2025 at 7:52 PM IST

5 Min Read
Choose ETV Bharat

ডায়মন্ড হারবার, 17 সেপ্টেম্বর: অপেক্ষা আর মাত্র কয়েকটা দিনের ৷ আকাশের শরতের মেঘ জানান দিচ্ছে উমা আসছে বাপেরবাড়িতে। আগমনীর আনন্দে চারিদিকে সাজো সাজো রব। অতীতকে আগলে রেখে বর্তমান প্রজন্মের হাত ধরে 160তম বর্ষে পদার্পণ করল বারদ্রোণের মণ্ডল বাড়ির দুর্গাপুজো। পুজোর বেশকিছু নিয়মরীতিতে ভাটা পড়লেও একটি নিয়ম আজও অটুট ৷ তা-হল মহাসপ্তমীর দিন যে হোম-অগ্নি জ্বলে, তা নেভানো হয় দশমীতে ৷

এই মণ্ডল বাড়ির আনাচে-কানাচে কান পাতলে শোনা যায় অতীতের কথা। 1866 সালে অবিভক্ত বাংলার নবাব ছিলেন হুসেন শাহ। সেই সময় এই মণ্ডল পরিবারের উত্থান ঘটে। তৎকালীন সময় এই ডায়মন্ড হারবার শহরের নাম ছিল হাজিপুর। বারদ্রোণ গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন অযোধ্যা রাম মণ্ডল ৷ তিনি লবণ ও তাঁতের ব্যবসা করে প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক হন। হটুগঞ্জ, পাথরপ্রতিমা, রায়দিঘি, মথুরাপুর, নামখানা-সহ একাধিক এলাকায় জমিদারি শুরু করেন ৷ সেই অযোধ্যা রামের বংশধর ছিলেন জমিদার গোলকচন্দ্র মণ্ডল ৷

অবিভক্ত বাংলার নবাব হুসেন শাহের আমলে মণ্ডল পরিবারের উত্থান ঘটে (ইটিভি ভারত)

কবি গানের আসর বসত মণ্ডলবাড়িতে

আগের মতো জাঁকজমক না হলেও, নিয়ম মেনে দেবীর আরাধনা করেন মণ্ডল বাড়ির সদস্যরা ৷ বিশুদ্ধ নন্দীকেশ্বর রীতি মেনে পুজো হয় এখানে ৷ আগে অষ্টমীর সন্ধিপুজোয় গুলি ছোড়া এবং নবমীতে পাঁঠাবলির রীতি ছিল ৷ তবে জমিদারি প্রথার বিলুপ্তির সঙ্গে সেই সব বন্ধ হয়ে গিয়েছে ৷ বারদ্রোণের জমিদার বাড়িতে সুবিশাল দালান বাড়ি তৈরি করেছিলেন গোলকবাবু ৷ অতীতে সেখানে পুজোর 4 দিন গ্রামবাসীদের মনোরঞ্জনের জন্য কবি গানের আসর বসত ৷

পুজোর নিয়মের তালিকা ছিল বিরাট

মহাসপ্তমীতে এলাকায় ব্রাহ্মণ ভোজন ও মহানবমীতে কুমারী পুজোর চল ছিল ৷ তবে এখন কুমারী পুজো হলেও, বন্ধ হয়ে গিয়েছে ব্রাহ্মণ ভোজনের রীতি ৷ আর প্রতিদিনই গ্রামবাসীদের ভোজনের ব্যবস্থা করা হত জমিদার বাড়িতে ৷ জমিদার বাড়ির সামনে সুবিশাল সিংহদুয়ার রয়েছে ৷ যেখানে দিনরাত পাহারায় থাকতেন দু'জন দারোয়ান ৷ জানা যায়, সেই সময় বন্দুকের গুলির আওয়াজে শুরু হত সন্ধিপুজো ৷ বর্তমানে সেই প্রথাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে ৷ ঘরের পুরু দেওয়ালে ছিল রকমারি সব কারুকাজ । সমগ্র বাড়িতে ছিল 33টি ঘর।

DURGA PUJA 2025
অতীত আঁকড়ে মণ্ডল বাড়ির দুর্গাপুজো (ইটিভি ভারত)

মণ্ডল বাড়ির ইতিহাস যেন রূপকথার গল্প

দারোয়ান, জমিদারের পালকি বাহকদের জন্যও আলাদা ঘরের ব্যবস্থা ছিল। ছিল কাছারিবাড়িও ৷ মূল প্রবেশপথের উঁচু তোরণের উপরে দু'পাশে মুখোমুখি দু'টি সিংহমূর্তি রয়েছে । আর ফটকের ঠিক উপরে রয়েছেন সিদ্ধিদাতা গণেশ। সদর দরজার পূর্বদিকে লম্বা বারান্দা। জমিদারের কাছারিবাড়িতে ঢোকার মূল ফটকের দু'দিকে থাকত বন্দুকধারি দুই দারোয়ান। জমিদার বাড়িতে টাকাপয়সা ও সোনাদানা রাখার জন্য ছিল বড় বড় চারটি লোহার সিন্দুক। ওই সিন্দুকের পাশে রাখা থাকত কাতান। ডাকাতির সময় যাতে ওই কাতান (অস্ত্র) সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহার করতে পারা যায় । সবমিলিয়ে যেন রূপকথার গল্প !

প্রতিবছর পুজো উপলক্ষে মণ্ডল পরিবার পত্রিকা প্রকাশ করে

জমিদারি প্রথার অবলুপ্তি ঘটলেও আজও জমিদার বাড়ির ঐতিহ্যের কিছুটা এখনও অবশিষ্ট। গেঁয়োখালি থেকে হুগলি নদীপথে নৌকায় মণ মণ দই হাঁড়ার ঘাট হয়ে বোলসিদ্ধির খালপথে আসত বারদ্রোণ গ্রামে। বস্তা বস্তা চিঁড়ে তালপুকুরের জলে ভিজিয়ে স্নানের ঘাটে চাটাই বিছিয়ে তাতে রেখে মেশানো হত হাঁড়ির পর হাঁড়ি দই আর চিনি। আজ সেসব ইতিহাস। পরিবারের সদস্যদের অনেকেই এখন কর্মসূত্রে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকেন । কথিত রয়েছে, এই পুজোয় আমন্ত্রিতদের তালিকায় থাকত ইংরেজ সরকারের আধিকারিকদের নাম। পুজোর সময় দালানবাড়িতে নিয়ম করে আসতেন সকলেই । এখনও প্রতিবছর পুজো উপলক্ষে মণ্ডল পরিবারের পক্ষ থেকে একটি করে পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সেখানে নির্ঘণ্ট ছাড়াও পুজোর ইতিহাস লেখা থাকে ।

DURGA PUJA 2025
160তম বর্ষে পদার্পণ করল বারদ্রোণের মণ্ডল বাড়ির দুর্গাপুজো (ইটিভি ভারত)

পাঁচের দশক থেকে বন্ধ পাঁঠাবলি

পরিবারের সদস্য নচিকেতা মণ্ডল জানান, জমিদারি প্রথা উঠে যেতেই পাঁচের দশক থেকে বন্ধ হয়ে যায় পাঁঠাবলি ৷ এখন শুধু নিয়মরক্ষার পুজো হয় ৷ বিশুদ্ধ নন্দীকেশ্বর মতে পুজো করা হয় ৷ এটাই এই পুজোর বিশেষত্ব ৷ মহাসপ্তমীর দিন যে হোম-অগ্নি জ্বলে, তা নেভানো হয় দশমীর দিন ৷ পরিবারের সদস্য ঋতুসি মণ্ডলের কথায়, "অতীতের সেই জৌলুস ফিকে হলেও এখনও প্রাচীন রীতিনীতি মেনে মণ্ডল বাড়ির পুজো চলে আসছে। পুজোর চারটে দিন পরিবারের মহিলাদের ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে কাটে।"

অতীতের কিছু পুজোর নিয়মে কাটছাঁট

পরিবারের সদস্য বিকাশ মণ্ডল জানান, অতীতে সন্ধিপুজোর সময় তিনি বাড়িতে গুলি চলতে দেখেছেন। দেখেছেন পাঁঠাবলিও। কিন্তু, পঞ্চাশের দশক থেকে পাঁঠাবলি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আরও এক সদস্য মানস মণ্ডল বলেন, "পঞ্চাশের দশকে পাঁঠাবলি বন্ধ করা হয়েছে। অতীতের যে জাঁকজমক ছিল সেই জাকজমক অনেকটাই ফিকে হয়েছে। জমিদারি চলে যাওয়ার পর আর্থিক সংকটের কারণে অতীতের কিছু নিয়ম কানুন কাটছাঁট করা হয়েছে। এই দুর্গাপুজোর চারটি দিন আমাদের মণ্ডল পরিবারের যে সকল সদস্যরা কর্মসূত্রে ভিন দেশে রয়েছেন তাঁরা আনন্দ করতে এখানে আসেন।"

DURGA PUJA 2025
সোনাদানা রাখার জন্য ছিল লোহার সিন্দুক (ইটিভি ভারত)

বনেদি বাড়ির পুজোকে আধুনিক ছোঁয়া দেওয়ার চেষ্টা

সুজন মণ্ডল বলেন, "পুজোর চারটে দিন আমরা চরম ব্যস্ততার মধ্যে থাকি। বাড়ির পুজো ছেড়ে অন্য কোথাও পুজো দেখার সুযোগ হয়ে ওঠে না। ঠাকুরদালান থেকে শুরু করে পুরো বাড়ি সাজিয়ে তোলার গুরু দায়িত্ব আমাদের হাতে। পুজোর দিনগুলি কীভাবে অতিথি এবং পরিবার বর্গের সঙ্গে সুন্দরভাবে কাটানো যায় সে বিষয়ে আমরা ইতিমধ্যেই প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছি। বনেদি বাড়ির পুজোকে আধুনিক যুগের ছোঁয়া দেওয়ার চেষ্টায় আমাদের এই আয়োজন ৷"

আরও পড়ুন: