দুর্গাপুর, 14 মে: প্রায় 150 বছর আগে অবিভক্ত বর্ধমানের রাজা বিজয়চাঁদ মহাতবের হাত ধরে দুর্গাপুরের আমরাই গ্রামে বুদ্ধ পুর্ণিমা তিথিতে গাজন উৎসবের সূচনা হয়েছিল ৷ যা পরবর্তীতে ধর্মরাজ গাজন নামে পরিচিতি পায় ৷ সেই গ্রামীণ গাজন আজও ভক্তি ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে এখানে । ভক্তরা লোহার শিক সারা শরীরে বিদ্ধ করে গ্রাম প্রদক্ষিণ করেন ৷ পাশাপাশি চড়কগাছে প্রদক্ষিণ করেও এই উৎসব পালন করা হয় ।
গ্রামবাসীদের তরফে জানা গিয়েছে, 1881 খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন অবিভক্ত বর্ধমান জেলার রাজাধিরাজ বিজয়চাঁদ মহাতব । তিনি 1903 সালে অবিভক্ত বর্ধমান জেলার রাজভার গ্রহণ করেন । অবিভক্ত বর্ধমান জেলার মধ্যেই সেই সময় অন্তর্ভুক্ত ছিল শাল, পিয়াল, বট ও বড় বড় আম গাছ দিয়ে ঘেরা প্রাচীন জনপদ আমরাই গ্রাম ।
কথিত ইতিহাস অনুযায়ী, বর্গী আক্রমণের সময় আম্রকুঞ্জে এসে আত্মগোপন করে রায় পরিবার । আর সেই থেকেই এই গ্রামের নামকরণ হয় আমরায় । তবে আমরায় থেকে অপভ্রংশে গ্রামের নামের বানানবিধি হয় আমরাই । বিজয়চাঁদ মহাতবের সময় আমরাই গ্রামের জমিদার ছিল চট্টোপাধ্যায় পরিবার । সেইসময় এই গ্রামে রাজার নির্দেশ অনুসারে মাটির ধর্মরাজ মন্দির-সহ তৈরি করা হয় শিবের গঙ্গাধর মন্দির । বর্ধমানের মহারাজা এই সমস্ত মন্দিরের সেবায়েত-সহ ঢাকি, কামার, নাপিত, মৃৎশিল্পী, ফুল প্রদানকারী, গোবরজল দেওয়ার জন্য আলাদা আলাদা ব্যক্তিদের নিয়োগ করেন । তাঁদেরকে পর্যাপ্ত পরিমাণ জমি দেওয়া হয় এই কাজের জন্য ।
সেই সময় থেকেই বুদ্ধ পূর্ণিমা তিথিতে বাৎসরিক ধর্মরাজ পুজোর আয়োজন হয়ে আসছে । মন্দিরে নিত্যপুজোও হয় । ধর্মরাজের পাশাপাশি আমরাই গ্রামের বাউড়ি পাড়ায় গাছের নীচে সুঁন্দরায়, বাগদিঘরে বীরেশ্বর, ধীবরপাড়ায় বুড়োরাই পুজিত হয় । এই পুজোয় মাটির ঘোড়া আর পদ্মফুল দিয়ে অগণিত ভক্তবৃন্দ পুজো নিবেদন করেন ।

প্রাচীন রীতি অনুযায়ী, এই ধর্মরাজ পুজো বা গাজনে ভক্তবৃন্দরা বান ফোঁড়েন । লোহার শিক নিজের শরীরে বিদ্ধ করে গোটা গ্রাম প্রদক্ষিণ করেন তাঁরা । বিশাল উচ্চতার শাল গাছের গদি, যা সারাবছর পুকুরের জলে নিমজ্জিত থাকে, সেই গাছ চড়ক হিসাবে নিয়ে আসা হয় এই পুজোর সময় । ভক্তরা সুউচ্চ এই শাল গাছের উপরে দড়ি বেঁধে ঘোরেন । মাটির চারটি ঘোড়া গরুর গাড়ির উপরে বসিয়ে গ্রাম প্রদক্ষিণ করানো হয় ।
বিজয়চাঁদ মহাতবের পরে তাঁর পুত্র উদয়চাঁদ বর্ধমানের রাজা হন । তিনিই ছিলেন বর্ধমানের শেষ রাজা । তবে রাজপাট বিলুপ্ত হলেও রাজ পরিবারের প্রচলিত আমরাই গ্রামে ধর্মরাজ পুজো এবং গঙ্গাধরের উপাসনায় কোনও বিচ্যুতি ঘটেনি । এরপর আমরাই হিন্দু ষোলো আনা কমিটি গঠন করে এই পুজোর নিরবচ্ছিন্ন আয়োজন হয়ে আসছে আজও ।

আমরাই গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে অতিথিদের আগমন হয় এই পুজোর সময় । আশপাশের এলাকারও হাজার হাজার মানুষ এই উৎসবে এসে যোগ দেন । সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই গ্রামে বিভিন্ন জনজাতির বসবাস হয়েছে । বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বর্তমানে আমরাই গ্রামের বাসিন্দা । সকলেই ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে এই আনন্দ উৎসবে এসে সামিল হন । মহারাজার প্রচলিত এই পুজোয় প্রাচীন যা রীতিনীতি ছিল সেই সমস্ত কিছু নিষ্ঠার সঙ্গে ভক্তিভরে আজও পালিত হয় ।
আমরাই হিন্দু ষোলো আনা কমিটির বর্তমান সম্পাদক অমিয় মুখোপাধ্যায় বলেন, "এই গ্রামের জাতীয় উৎসব ধর্মরাজ গাজন । পুজোর পাশাপাশি গ্রামীণ মেলার আয়োজন হয় । মহারাজার প্রচলিত এই পুজোয় যা কিছু প্রাচীন রীতিনীতি ছিল সেই সমস্ত কিছু রীতিনীতি মেনে চলা হয় আজও । সমস্ত ধর্মের মানুষ এই উৎসবের আনন্দ উপভোগ করেন ।"
আজও বেঁচে আছে প্রাচীন প্রথা । বেঁচে আছে গ্রামীণ গাজন উৎসব । আর তাকে ঘিরেই চরম উন্মাদনা দেখা গেল আমরাই গ্রামে ।