ভদ্রেশ্বর, 25 মার্চ: রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় রাজনীতির নামে সাম্প্রদায়িক পোস্টার ছেয়ে গিয়েছে ৷ সেখানে তৃণমূল, বিজেপি ও বাম বলে কোনও ভেদাভেদ নেই ৷ সবপক্ষই সমানভাবে এগিয়ে রয়েছে ৷ এই ভেদাভেদের রাজনীতির মাঝে হুগলির ভদ্রেশ্বরে দেখা গেল এক অভূতপূর্ব সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ৷ যেখানে পীরের মাজারের দেখভাল ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে একটা হিন্দু পরিবার ৷
1967 সাল থেকে ভদ্রেশ্বরের পালপাড়ার দাস পরিবার সৈয়দ শাহ পীরের মাজারের দেখভাল করে আসছে ৷ দু’বেলা মাজার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা থেকে, নিয়ম করে ধূপ-মোমবাতি জ্বালানো ৷ সবই করে দাস পরিবারের সদস্যরা ৷ তবে, এর পিছনেও রয়েছে একটি কাহিনি ৷
প্রায় 120 বছর আগে এই অঞ্চল জঙ্গলে ভরা ছিল ৷ ভদ্রেশ্বর পালপাড়া ও হিন্দুস্তান পার্ক ছিল মুসলমান অধ্যুষিত এলাকা ৷ সেই সময় একাধিক পীরের মাজার তৈরি হয়েছিল সেখানে ৷ পরবর্তীকালে দেশভাগের সময় ওপার বাংলা থেকে আসা মানুষজন এবং বহু অবাঙালি মানুষ এই অঞ্চলে বসবাস শুরু করে ৷ সেই থেকে এই অঞ্চলে পুরোপুরি হিন্দুদের বাস ৷ তেমনই 1967 সালে পালপাড়ায় শ্রীধামচন্দ্র দাস এক মুসলমান ব্যক্তির কাছ থেকে জায়গা কিনেছিলেন ৷ সেই সময় সৈয়দ শাহ পীরের মাজারের দায়িত্ব পান তিনি ৷ তখন থেকে দেখভালের দায়িত্ব পালন করে আসছে এই পরিবার ৷ সারা বছর মাজারের দেখভাল করেন তাঁরা ৷ ঈদ, সবেবরাতের মতো অনুষ্ঠানে মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকজন এখানে প্রার্থনা করতে আসেন ৷

দাস পরিবারের সদস্য শুক্লা দাস বলেন, "আমার শ্বশুর মাজার সমেত এক মুসলিম ব্যক্তির কাছ থেকে এই জমি কিনে ছিলেন ৷ সেই থেকে আমার শ্বশুর পুজো করে আসছেন ৷ উনি মারা যাওয়ার পর আমাদের গোটা পরিবার এই পীরের সেবা করছে ৷ প্রতিবছর 26 জানুয়ারি মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজন আসেন প্রার্থনা করতে ৷ আগে এটা মাটির ছিল ৷ এখন টিনের চাল দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ৷ এখানে হিন্দু-মুসলিম সবাই সমান ৷ কখনই ভাগাভাগি করা উচিত নয় ৷ জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকলেই এক ৷ এটা পশ্চিমবঙ্গেই দেখা যায় ৷"
ভদ্রেশ্বরে আরও দু’টি পীরের মাজার রয়েছে ৷ একটি হিন্দুস্তান পার্কে মানিক শাহ পীর বাবা ৷ আরেকটি ভদ্রেশ্বর পুরসভার ভাগারের কাছে করিম শাহের মাজার ৷ এই দু’টি মাজারের দেখভালের দায়িত্বেও রয়েছেন হিন্দুরা ৷ আর্থিক সাহায্যও করা হয় রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৷
এই তিন পীরের মাজারের মৌলবী হলেন মহম্মদ সেলিম ৷ তিনি বলেন, "এখানে তিনটি মাজার আছে ৷ সেখানে অনুষ্ঠান হয় ৷ আমরা দেখাশোনা করি ৷ আগে পুরোটাই জঙ্গল ছিল ৷ সেই সময় এখানে পীরেরা থাকতেন ৷ তাঁরা মারা যাওয়ার পর, কবর দিয়ে মাজার তৈরি হয় ৷ পরবর্তীকালে এখানে হিন্দুস্তান কারখানা হয়েছিল ৷ কিন্তু, তা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর জায়গা জমি বিক্রি হয়ে যায় ৷ তারপর থেকে হিন্দুরা এখানে বাস করে ৷ তাঁরাই মাজারের জন্য আর্থিক সাহায্য করেন ৷ সকলে মিলে দেখা শোনা করি আমরা ৷ এখানে সমস্ত জাতি মিলে মাজারে উৎসব পালন করা হয় ৷"

যদিও, রাজনীতির একটা আকচাআকচি এখানেও রয়ে গিয়েছে ৷ ভদ্রেশ্বর পুরসভার চেয়ারম্যান প্রলয় চক্রবর্তী বলেন, "সমস্ত ধর্মের মানুষ এখানে একত্রিত হয়ে বাস করেন ৷ কিছু মানুষ আছে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করে ৷ কিন্তু, ভদ্রেশ্বরে সেরকম নেই ৷ আমরা শান্তিতে একসঙ্গে থাকতে চাই ৷ এই জায়গায় তিনটি মাজার রয়েছে ৷ সকলে মিলে দেখা শোনা করে ৷ মুখে ভাই-ভাই বললে কিছু হবে না ৷ সকলকে সকলের পাশে থাকতে হবে ৷ ধর্ম কোনোদিন শেখায় না ভাগ করতে ৷
যার আবার জবাবও দিয়েছেন হুগলি বিজেপির সাংগঠনিক জেলার সাধারণ সম্পাদক সুরেশ সাউ ৷ তিনি বলেন, "শুধু ভদ্রেশ্বর কেন ৷ সারা ভারতবর্ষে যেখানে হিন্দুরা রয়েছে, সবসময় সম্প্রীতির বার্তা দিয়েছে ৷ এটাই তো আমাদের সংস্কৃতি ৷ এটাই তো আমরা বহন করে নিয়ে চলি ৷ কিন্তু, দুর্ভাগ্যের বিষয়, এখানে হিন্দুরা সুরক্ষিত নয় ৷ সেই কারণেই আমরা এক হওয়ার বার্তা দিয়েছি ৷ হিন্দুরা এক হলেই সমন্বয় তৈরি হবে, সম্প্রীতি রক্ষা হবে ৷"