মালদা, 7 এপ্রিল: দুর্গাপুজোর সময় পরিচয়৷ যা অচিরেই পরিণত হয় প্রেমের সম্পর্কে ৷ কিন্তু মাস ছয়েকের মধ্যে সেই সম্পর্কে পূর্ণচ্ছেদ পড়ে গেল চিরতরে ৷ অভিযোগ, প্রেমের রাস্তায় পরিবারের বিছানো কাঁটায় বিদ্ধ হয়ে প্রেমিক-প্রেমিকা দু’জনেই এখন তারার দেশে ৷
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শোরগোল পড়েছে মালদার বামনগোলা ব্লকে ৷ দুই পরিবারই একে অন্যের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছে ৷ তবে এখনও পর্যন্ত এনিয়ে পুলিশের খাতায় কোনও অভিযোগ জমা পড়েনি ৷ ইংরেজবাজার থানার পুলিশ আপাতত অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা রুজু করে বিষয়টি খতিয়ে দেখা শুরু করেছে ৷

বামনগোলা ব্লকের খুয়ারডাঙা গ্রামের বাসিন্দা ছিল ফুলটুস মণ্ডল ৷ এলাকায় রাহুল নামেই সবাই চিনত তাঁকে ৷ বছর বাইশের ফুলটুস পেশায় ছিলেন দিনমজুর ৷ পরিবারের আর্থিক সংকটে ক্লাস এইটের বেশি পড়াশোনা করতে পারেননি তিনি ৷ বাড়ির সবার অন্ন সংস্থানে নেমে পড়েন শ্রমিকের কাজে ৷ অন্যদিকে এলাকারই রাখালপুকুর গ্রামের রাখি মণ্ডল দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়াশোনা করতেন ৷ এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন ৷ পড়াশোনার পাশাপাশি নাচ-গানেও দক্ষ ছিলেন তিনি ৷ ভালো মেয়ে হিসাবে এলাকায় সুনাম ছিল তাঁর ৷
এলাকার মানুষজন জানাচ্ছেন, দু’জনেই খুব ভালো ছিল৷ কারও সম্পর্কে কোনও খারাপ কথা কখনও শোনা যায়নি ৷ এবার দুর্গাপুজোয় রাহুল আর রাখির পরিচয় হয় ৷ ধীরে ধীরে সেই পরিচয় প্রেম পর্যায়ে পৌঁছোয় ৷ মোবাইল ফোনে নিয়মিত কথা হতে থাকে দু’জনের ৷ স্থানীয়রা বলছেন, রাহুল-রাখির এই সম্পর্কের কথা জানতে পেরেছিল দুই পরিবার ৷ তারপর থেকেই সমস্যার শুরু ৷ বিশেষ করে রাখির অভিভাবকরা মেয়ের এই সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি ৷
প্রেমের মাঝে পরিবারের এই কাঁটা মেনে নিতে পারেনি ফুলটুস আর রাখিও ৷ শনিবার তাঁরা দু’জন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান ৷ দু’জনে চলে যান গাজোল থানার আগমপুর গ্রামে ৷ অভিযোগ, সেখানে একটি আমবাগানে বসে দু’জনেই একসঙ্গে বিষ পান করেন ৷ বিষ খাওয়ার পর রাহুল এক বন্ধুকে ভিডিয়ো কল করে সমস্ত ঘটনা জানিয়ে দেন ৷ ওই ছবি দেখেই ওই বন্ধু লোকজন নিয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান ৷
দু’জনকে নিয়ে যান স্থানীয় গাজোল গ্রামীণ হাসপাতালে ৷ সেখানকার চিকিৎসকরা পাকস্থলী পরিষ্কার করে দু’জনকেই মালদা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে রেফার করে দেন ৷ কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হয়নি৷ রবিবার রাত আটটা নাগাদ রাখি মারা যান ৷ রাত একটা নাগাদ ফুলটুসও তাঁর প্রেমিকার পথ অনুসরণ করেন ৷ সোমবার দু’জনের মৃতদেহের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে ৷
ফুলটুসের মা উজ্জ্বলা মণ্ডল বলেন, “ওরা দু’জন একে অন্যকে ভালোবাসত ৷ তার মধ্যেই শনিবার ওরা বিষ খায় ৷ দুর্গাপুজোয় ওদের মধ্যে আলাপ হয় ৷ ওদের এই সম্পর্ক মেয়ের বাবা আর পিসি মানতেন না ৷ আগমপুরের একটি আমবাগানে বিষ খেয়ে ওরা দু’জন মাথায় মাথা লাগিয়ে পড়ে ছিল ৷ ছেলে ওর এক বন্ধুকে মোবাইলে ফোন করে ৷ সে গোটা ঘটনা বন্ধুকে খুলে বলে ৷ কিন্তু ওর বন্ধু সেকথা বিশ্বাস করেনি ৷ তখন ছেলে ওর মোবাইল ফোন থেকে ভিডিয়ো কল করে ৷ তখন থেকেই ওদের বিষ খাওয়ার খবর জানাজানি হয় ৷ সেই ছবি দেখে ওর বন্ধুরাই দু’জনকে গাজোল হাসপাতালে নিয়ে যায় ৷ সেখান থেকে মালদা নিয়ে আসে ৷ আমরা ওদের এই সম্পর্ক মেনে নিয়েছিলাম ৷ কিন্তু মেয়ের বাড়ি সেটা মানতে পারেনি ৷”
এদিকে রাখির বাবা গোকুল মণ্ডলের বক্তব্য, “শনিবার আমার জামাই ফোন করে জানায়, মেয়ে বিষ পান করেছে ৷ গাজোল হাসপাতালে ওর পাকস্থলী পরিষ্কার করা হয়েছে ৷ সেখান থেকে মালদা নিয়ে আসা হয় ৷ শনিবার আগেই আমার ছেলে আমাকে জানায়, ওই ছেলেটি তার দিদিকে বাজার থেকে জোর করে নিয়ে গিয়েছে ৷ এরপর আগমপুরের একটি আমবাগানে ছেলেটি আগে আমার মেয়েকে বিষ খাওয়ায়, তারপর নিজেও বিষ খায় ৷’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘ওদের মধ্যে কতদিনের সম্পর্ক আমি জানি না ৷ ছেলেটি আগে আমাকে নিজের নাম রাহুল বলেছিল ৷ আজ শুনছি, ওর নাম ফুলটুস ৷ ছেলেটি একদিন আমাকে ফোন করে বলেছিল, আমার মেয়ে ওর সঙ্গে প্রেম করে ৷ ওর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে না দিলে ও বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করবে ৷ আমি ওকে মাথা ঠান্ডা রাখতে বলি ৷ সুতরাং আমি যে ওই ছেলে আর আমার মেয়ের সম্পর্কে বাধা সৃষ্টি করেছিলাম, সেটা সঠিক নয় ৷’’
গোকুল মণ্ডল আরও বলেন, ‘‘মেয়েটা আমার এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল ৷ পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল ৷ নাচে-গানে পারদর্শী ৷ সেই মেয়ে যে এভাবে একটি ছেলের জন্য আত্মহত্যা করবে ভাবতে পারিনি ৷ মেয়েটাকে আমার হাতে ধরে মেরে ফেলল ৷”
ইংরেজবাজার থানার এক অফিসার জানিয়েছেন, এই ঘটনায় কোনও পরিবারের তরফেই কোনও লিখিত অভিযোগ জমা পড়েনি ৷ অভিযোগ দায়ের হলে সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ করা হবে ৷ আপাতত দু’টি অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু করা হয়েছে ৷