বেলঘরিয়া, 16 জুলাই: আড়িয়াদহের 'ত্রাস' জয়ন্ত সিংয়ের কীর্তিতে নাম জড়িয়েছে শাসকদল তৃণমূলের ৷ জয়ন্ত'র বেআইনি দুধসাদা প্রাসাদোপম বাড়ি ঘিরে বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়েছিল ৷ পাশাপাশি তাঁর ক্লাব তালতলা স্পোর্টিং নিয়েও নতুন বিতর্ক তৈরি হয়েছে ৷
অভিযোগ, কংগ্রেস এবং তৃণমূল কংগ্রেসের পার্টি অফিস দখল করেই সেখানে জয়ন্ত গড়ে তুলেছেন এই 'ঠ্যাঙারে' ক্লাব ৷ বিতর্কের এখানেই শেষ নয় ! আরও অভিযোগ, যে জমির উপর তালতলা স্পোর্টিং ক্লাব গড়ে উঠেছে, সেই জমিতেই নাকি একসময় পুকুর ছিল বলে দাবি স্থানীয়দের একাংশের ৷ সেখানে বসতিও ছিল ৷ রাতারাতি সেই পুকুর বুজিয়ে এবং বাসিন্দাদের রীতিমতো মারধর করে জমি থেকে তুলে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ ৷ এই বেআইনি কাজের প্রতিবাদ করে স্থানীয় এক তৃণমূল নেতা সেই সময় আদালতে মামলাও করেছিলেন ৷ কিন্তু, এতকিছুর পরেও তালতলা স্পোর্টিং ক্লাব তৈরি হওয়া ঠেকানো যায়নি ৷ যা এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে আড়িয়াদহের নওদা পাড়ায় ৷
স্থানীয় সূত্রে খবর, বাম আমলে ওই জমির উপরে প্রথমে কংগ্রেসের কার্যালয় ছিল ৷ তবে, সেটি পাকা নয়, দরমার বেড়া দেওয়া ৷ পরে, তৃণমূল দল গঠিত হলে ধীরে ধীরে সেই পার্টি অফিসের কর্তৃত্ব চলে যায় বতর্মান শাসকদলের কাছে ৷ এই পার্টি অফিস থেকেই স্থানীয় তৃণমূল কর্মীরা দলের যাবতীয় কাজ পরিচালনা করতেন ৷ প্রোমোটিংয়ের পর সেখানে পার্টি অফিস করে দেওয়ার কথা থাকলেও তা করে দেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ ৷ উলটে, সেখানে গড়ে উঠে জয়ন্ত'র তালতলা স্পোর্টিং ক্লাব ৷
এনিয়ে সমাজমাধ্যমে সবর হয়েছেন অনেকে ৷ প্রতিবাদ করেছেন এলাকার বাসিন্দারাও ৷ গায়ের জোরে পার্টি অফিস দখল করেই যে তালতলা স্পোটিং ক্লাব গড়ে তোলা হয়েছে তা একপ্রকার মেনে নিয়েছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতা ৷ এনিয়ে দলের একাংশের দিকে আঙুল তুলছেন তৃণমূলের এই প্রাক্তন কাউন্সিলর ৷
প্রসঙ্গত, আড়িয়াদহ কাণ্ডে তোলপাড় পড়ে গিয়েছে গোটা রাজ্যে ৷ মা-ছেলেকে গণপিটুনি থেকে শুরু করে ক্লাবঘরে একের পর এক পাশবিক অত্যাচারের ভিডিয়ো সিরিজ দেখে শিউরে উঠেছেন সবাই ৷ আর এইসব ঘটনায় মূল অভিযুক্ত আড়িয়াদহের বেতাজ বাদশা জয়ন্ত সিং-সহ তাঁর গ্যাংয়ের একাধিক সদস্যকে ইতিমধ্যে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ ৷ এরই মধ্যে জয়ন্তর বিলাসবহুল বাড়ি ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়েছে ৷ তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে ৷ এরই মাঝে এবার জয়ন্তর তালতলা স্পোর্টিং ক্লাবের জমি নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, যা ঘিরে এখন সরগরম আড়িয়াদহ ৷
এই বিষয়ে উত্তর 24 পরগনা জেলা (শহর) কংগ্রেসের সম্পাদক সুব্রত দাস বলেন, "ওই জমিটির মালিক প্রয়াত দিলীপ ঘোষ ৷ তিনি কংগ্রেস দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ৷ পার্টি অফিস তৈরির জন্য জমিটি দিয়েছিলেন তিনি ৷ দীর্ঘদিন ধরে ওখানে আমাদের কাজকর্ম চলেছে ৷ 1998 সালে তৃণমূল কংগ্রেস গঠিত হওয়ার পর সংখ্যাধিক্যের জেরে সেটি তৃণমূলের দখলে চলে যায় ৷"
তিনি আরও জানান, 2006 সালে ওই পার্টি অফিসটি ভেঙে দিয়ে বহুতল নির্মাণের পরিকল্পনা করেন জমির মালিক ৷ শুধু তাই নয়, রাতারাতি জমির পাশে একটি পুকুরও ভরাট হয়ে যায় ৷ সেই জমিতে যাঁরা বসবাস করতেন তাঁদেরকেও তুলে দেওয়া হয় গায়ের জোরে ৷ সেই সময় বলা হয়েছিল প্রোমোটিংয়ের পর পার্টি অফিসের জন্য একটি ঘর দেওয়া হবে ৷ কিন্তু কংগ্রেসও পার্টি অফিস উদ্ধার করতে পারেনি, তৃণমূলও পারেনি ৷ কংগ্রেস নেতা বলেন, "আগেও আমাদের দাবি ছিল কংগ্রেসের পার্টি অফিস ফিরিয়ে দেওয়া হোক, এখনও একই দাবি রাখছি ৷"
যিনি ওখানে প্রোমোটিং করেছিলেন তাঁর বাবা এই জমিতে পার্টি অফিসটি করতে দিয়েছিলেন বলেও জানান সুব্রত দাস ৷ তাঁর কথায়, "তালতলা স্পোর্টিং ক্লাবকে কেন্দ্র করে যা চলছে, তা দুর্ভাগ্যের ৷ যে ভিডিয়োগুলো ইদানীং সামনে এসেছে, তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ৷ আড়িয়াদহ শান্তিপূর্ণ এলাকা ৷ কিন্তু সেখানে দিনের পর দিন জয়ন্ত ও তাঁর বাহিনীকে কাজে লাগিয়েছে শাসকদল ৷ আমি মনে করি, জয়ন্ত সিং-কে যাঁরা তৈরি করেছেন, তাঁরাই প্রকৃত দোষী ৷ এদের দোষ দিয়ে লাভ নেই ৷"
একই মত কামারহাটি পৌরসভার প্রাক্তন তৃণমূল কাউন্সিলর দেবাশিস মহাপাত্রেরও ৷ তবে তাঁর দাবি, "ওই জমিতে কংগ্রেসের নামেই ইন্দিরা সমাজ কল্যাণের পার্টি অফিস চলত ৷ সেখানে কংগ্রেস তাঁদের পার্টির দৈনন্দিন কাজকর্ম চালাত ৷ পরে, তৃণমূল তৈরি হলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আমরা দলের কাজ করতাম সেখানে ৷ প্রোমোটিং করার জন্য রাতারাতি সেই ঘর ভেঙে দেওয়া হল ৷ তখন তৃণমূলকে একটি ঘর দেওয়া হবে বলে জানা গিয়েছিল ৷ কিন্তু, দেখা গেল বাস্তবে সেখানে একটি ক্লাব হয়ে গেল, যার নাম তালতলা স্পোর্টিং ক্লাব ৷ সেই জমিটি কিনেছে, নাকি বেচেছে, নাকি দান করেছে সেই সব তথ্য আমার কাছে নেই ৷ পুরসভার কাছে নিশ্চয় আছে ৷ যা শুনেছি, ওই ক্লাবের জমি এখনও পুরসভার নামে ৷" তৃণমূল নেতা এই ক্লাব তৈরির নেপথ্যে প্রোমোটারের সঙ্গে জয়ন্ত সিংয়ের ভালো সম্পর্কের কথা জানান ৷
এদিকে, জয়ন্ত সিংয়ের বিরুদ্ধে আসরে নেমেছে বিরোধীরা ৷ বিশেষত পদ্ম শিবির তো সরাসরি এই ঘটনার জন্য শাসকদলকে দুষেছে ৷ এই বিষয়ে বিজেপির রাজ্য নেতা রাজু বন্দোপাধ্যায় বলেন, "স্থানীয় কাউন্সিলর ও বিধায়কের মদত ছাড়া জমি দখল করে ক্লাবঘর তৈরি হতে পারে না ৷ বিধায়ক সবকিছুই জানেন ৷ আর জয়ন্ত সিং তো এলাকারই ছেলে নয় ৷ বে-পাড়া থেকে এসে দাদাগিরি করত ৷ বাইরের ছেলেদের এলাকায় এনে অসামাজিক কার্যকলাপ চালাত ৷ এতেই তো মানুষ বিরক্ত হয়ে প্রতিবাদ করার সাহস দেখিয়েছে ৷ বেআইনি প্রোমোটিংয়ে ছেয়ে গিয়েছে কামারহাটি ৷ যাঁরা বলছেন কিছুই জানি না, তাঁদের মুখোশ খুলে দেব আমরা ৷"