মালদা, 20 মার্চ: সম্প্রতি বিধানসভায় সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইয়া ঘোষণা করেছেন, ঘাটালের মতো এবার মালদা ও মুর্শিদাবাদ জেলার গঙ্গা ভাঙন প্রতিরোধে মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হবে ৷ কিন্তু কবে হবে এই মাস্টারপ্ল্যান, তা নিয়ে অবশ্য কিছু বলেননি তিনি ৷ তবে কি তাঁর এই ঘোষণা ছাব্বিশের বিধানসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে ? প্রশ্ন গঙ্গাতীরের বাসিন্দাদের ৷ তাঁদের অভিযোগ, শুখা মরশুম শুরু হওয়ার পর চার মাস হয়ে গেল ৷ এখনও ভাঙন রোধের কাজ শুরুই হয়নি ৷ কবে সেই কাজ শুরু হবে, কবেই বা শেষ হবে তা কেউ জানে না ৷
সময় থাকতে থাকতেই রতুয়ার গঙ্গা তীরবর্তী এলাকার অনেকে নিজেদের ঘরবাড়ি সরিয়ে নিতে শুরু করেছেন ৷ কারণ, একবার ভাঙন শুরু হয়ে গেলে গঙ্গা আর সময় দেবে না ৷ বাড়িঘর নিজের গর্ভে টেনে নেবে ৷ যদিও সেচ দফতরের প্রতিমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন, আর কয়েকদিনের মধ্যে গঙ্গা ভাঙন রোধের কাজে হাত দেওয়া হবে ৷
কালীপুজোর পর থেকে বর্ষা শুরুর আগে পর্যন্ত শুখা মরশুম হিসাবে বিবেচিত হয় ৷ রতুয়া এক নম্বর ব্লকের গঙ্গা ভাঙন দুর্গত মহানন্দটোলা ও বিলাইমারি গ্রাম পঞ্চায়েতের মানুষজন অনেকদিন ধরেই দাবি জানাচ্ছেন, শুখা মরশুমে গঙ্গা ভাঙন রোধের কাজ করা হোক ৷ তাতে মাটি কিছুটা বাঁচবে ৷ কিন্তু তাঁদের অভিযোগ, তাঁদের দাবিকে কোনও গুরুত্বই দেয় না প্রশাসন ৷ গত বছর ভাঙন রোধের কাজ হয়নি ৷ এবার এখনও পর্যন্ত সেই কাজ শুরু হয়নি ৷ শুরু যে হবে তারও কোনও নিশ্চয়তাও নেই ৷
মহানন্দটোলা গ্রাম পঞ্চায়েতের শ্রীকান্তটোলা গত বছরের ভাঙনে প্রায় নিশ্চিহ্ন ৷ এখন গোটা দশেক ঘর রয়েছে পুরো গ্রামে ৷ তাঁদেরই একজন হেমন্ত মণ্ডল জানালেন, “এখনই ভাঙন রোধের কাজ করার সময় ৷ কিন্তু কেন্দ্র কিংবা রাজ্য, কোনও সরকারই কাজ করবে না ৷ আমরা কার কাছে কাজের আবেদন জানাব ৷ কত সংবাদমাধ্যম এল ৷ ছবি তুলে চলে গেল ৷ এমএলএ, এমপি, ডিএম, বিডিও সবাই এল ৷ সবাই পরিস্থিতি দেখল ৷ কিন্তু কাজ কিছু হল না ৷ 2011 সাল থেকে এখনও পর্যন্ত গঙ্গা পশ্চিম থেকে 15-16 কিলোমিটার ভিতরে ঢুকে এসেছে ৷ তার কোপে জঞ্জালিটোলা, জামুনটোলা আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে ৷ গত দু’তিন বছর ধরে শ্রীকান্তটোলা, কান্তটোলা, খাকসাবোনা, বিলাইমারি কেটেই চলেছে ৷ প্রতি বছর গঙ্গা ভিতরে ঢুকে আসছে ৷ দু’তিনটে গ্রাম কমে যাচ্ছে ৷ এই গতিতে ভাঙন চললে নদীর ধারে যত গ্রাম আছে সব কেটে যাবে ৷"

সরকারের বিরুদ্ধে তোপ দেগে তিনি বলেন, "মন্ত্রী-আমলারা এসেছিলেন ৷ কিন্তু আমাদের জন্য তাঁদের কোনও প্রতিশ্রুতি ছিল না ৷ এখানকার মানুষজন নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে, কেউ আমাদের উপকার করে দেবে না ৷ তাই আর কেউ মুখ খুলতে চায় না ৷ এর পিছনে ভোটের কোনও গল্প রয়েছে কি না তা যারা রাজনীতি করে, যাদের রাজনীতি পেশা কিংবা ব্যবসা, তারাই বলতে পারবে ৷ আমরা শুধু জানি, খাটতে পারলে আমরা খেতে পাব ৷ আমরা কেউ সরকারি সহায়তা পাই না ৷ কেউ সরকারি সাহায্য দিতেও আসে না ৷”
শ্রীকান্তটোলার মতিলাল মণ্ডল বলছেন, “অবস্থা খুব শোচনীয় ৷ কান্তটোলা পুরোটাই শেষ হয়ে গিয়েছে ৷ শ্রীকান্তটোলা শেষ হওয়ার মুখে ৷ গোটা দশেক ঘরই এখন বেঁচে রয়েছে ৷ অথচ এখনও পর্যন্ত গঙ্গার ভাঙন রুখতে কোনও কাজ হয়নি ৷ দু’বছর ধরে আমরা আশা করে রয়েছি ভাঙন রোধের কাজ হবে ৷ কিন্তু কোনও কাজ হয় না ৷ প্রশাসন কিংবা সরকার আমাদের কিছুই দিচ্ছে না ৷ আমাদের আর কী চাওয়ার আছে ? আমাদেরও ঘর আর গ্রাম ছেড়ে অন্য কোথাও আশ্রয় নিতে হবে ৷”

গ্রামের শিব মন্দিরের ছায়ায় বসে মুলিরামটোলার নিখিল মণ্ডল আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, “এবার মুলিরামটোলা আর শ্রীকান্তটোলা থাকছে না ৷ এই মন্দির তো কিছুতেই থাকবে না ৷ মন্দির থেকে এখন নদীর দূরত্ব 25 মিটারের বেশি নয় ৷ 50 মিটার দূরে মুলিরামটোলা প্রাথমিক স্কুল ৷ এবার স্কুলটাও আর থাকবে কি না সন্দেহ রয়েছে ৷ কালীপুজোর পর থেকে ভাঙন রোধের কাজ করার ভালো সময় ৷ ছ’মাস শুখা মরশুম চলে ৷ এখন সময় পেরোতে চলছে ৷ আর কবে ভাঙন রোধের কাজ করবে ৷ শ্রাবণ মাসে ? যখন নদী পাড় কাটবে, বন্যা হবে, তখন ? এখনই সেই কাজ করার সময় ৷ চৈত্র মাস শুরু হয়ে গিয়েছে ৷ বৈশাখ আসছে ৷ এখনও কাজ শুরু করলে কিছুটা রক্ষা ছিল ৷ প্রশাসন শুধু তারিখ দিয়ে চলেছে ৷”
নিজেদের অধিকার নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন শ্রীকান্তটোলার দীপককুমার মণ্ডল ৷ তিনি বলেন, “শুখা মরশুম চলে যাচ্ছে ৷ বর্ষা চলে আসছে ৷ এখনও গঙ্গা বাঁধার কাজ শুরু হল না ৷ আজ হবে, কাল হবে বলে প্রশাসন শুধু মানুষকে ধোঁকা দিচ্ছে ৷ তাই সময় থাকতে মানুষ ঘরবাড়ি সরিয়ে নিচ্ছেন ৷ আর স্থানীয় নেতারা এসে বলছেন, কেউ যাতে বাড়ি না ভাঙে ৷ সরকার গঙ্গা বাঁধবে ৷ এদিকে একের পর এক বাড়ি নদীতে পড়ে গেল ৷ ভাঙন রোধের কাজ হবে কি না তা নিয়ে মমতাদিদি কিংবা মোদিদাদা এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি ৷ কারও কোনও চিন্তা নেই ৷ বাড়ি পড়ছে, পড়ুক ৷ লোক মরছে, মরুক ৷ স্থানীয় নেতার পয়সা হচ্ছে, হোক ৷ মোদ্দা কথা, মানুষ মরছে আর নেতার পয়সা হচ্ছে ৷ এখনও পর্যন্ত ভাঙন রোধের কোনও কাজই হয়নি ৷ কেউ কেউ বলছে, এখানে নাকি 21 কোটি টাকার কাজ হয়েছে ৷ অথচ মাত্র 21টা বস্তা নদীতে পড়ে রয়েছে ৷"

তাঁর কথায়, "এখনই কাজ করার সময় ৷ কিন্তু এখনও কাজ হচ্ছে না ৷ যখন ভাদ্র মাসে বন্যা আসবে, তখন এমএলএ, এমপি আসবে ৷ গালে হাত দিয়ে কথা বলবে ৷ মানুষকে দেখিয়ে কয়েক কোটি টাকার কাজ করাবে ৷ সামান্য টাকার কাজ করিয়ে বাকি টাকা নিজেদের পকেটে ঢোকাবে ৷ এই টাকা নেতা থেকে শুরু করে ইঞ্জিনিয়ার, অফিসার, সবার পকেটে যাচ্ছে ৷ দেশের সংবিধান অনুযায়ী ভারতের মানুষকে রক্ষা করার দায়িত্ব কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ৷ কিন্তু এরা বড়লোকের সরকার ৷ একটা বড় কোম্পানির লোক রাস্তা দিয়ে হাঁটলে ওর পিছনে 10টা পুলিশ থাকবে ৷ কিন্তু সাধারণ মানুষ বিপদে পড়লেও তার পিছনে কেউ থাকবে না ৷ এটা ভারতের কী ধরনের সংবিধান ? সংবিধান শুধু কি নামেই ? কাজের জন্য কি সংবিধান লেখানো হয়নি ? গরিবের জন্য সংবিধান উলটো হচ্ছে ৷ প্রশাসন এখন শুধু বড়লোকের জন্য, গরিবের জন্য নয় ৷”
সেচ দফতরের প্রতিমন্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন অবশ্য আশ্বাস দিয়েছেন, “শুখা মরশুমেই ভাঙন রোধের কাজ হবে ৷ ইতিমধ্যে তার পরিকল্পনা তৈরি হয়ে গিয়েছে ৷ কয়েকদিনের মধ্যেই সেই কাজে হাত দেওয়া হবে ৷”