মালদা, 26 মার্চ: গ্রামে পাঁচশোরও বেশি পরিবার ৷ সুসংহত শিশু বিকাশ প্রকল্পের অধীনে নিয়ে আসা হয়েছে গোটা গ্রামকেই ৷ রয়েছে দু’টি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র ৷ তাতে রয়েছেন পর্যাপ্ত কর্মী ও রাঁধুনিও ৷ কিন্তু সমস্যার বিষয়, কোনও আইসিডিএস সেন্টারেরই নিজস্ব রান্নাঘর নেই ৷ নেই শিশু ও প্রসূতিদের খাওয়ানোর জায়গাও ৷
অথচ সেন্টার দু’টি তৈরি করার জন্য গ্রামে রয়েছে সরকারি খাস জমি ৷ অভিযোগ, সেই জমি দখল করে বসে রয়েছেন এলাকার এক প্রভাবশালী তৃণমূল নেতা ৷ সমস্যার কথা জানিয়ে গ্রামবাসীরা একাধিকবার স্থানীয় পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে প্রশাসনিক মহলে অভিযোগ জানিয়েছেন ৷ কিন্তু প্রশাসন এখনও পর্যন্ত কোনও পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগ সবার ৷ তাহলে কি সরকারি জমি তৃণমূল নেতার দখল থেকে সরাতে পারছে না প্রশাসন? প্রশ্ন গোটা গ্রামে ৷
এই ছবি গাজোল ব্লকের দেওতলা গ্রাম পঞ্চায়েতের ধাওয়েল গ্রামের ৷ এই গ্রামে রয়েছে 512 ও 514 নম্বর আইসিডিএস সেন্টার ৷ কিন্তু সেন্টারের নিজস্ব ঘর না থাকায় কখনও কারও বাড়ির বারান্দায়, কখনও বা খোলা জায়গায় শিশু ও প্রসূতিদের জন্য খাবার রান্নার ব্যবস্থা হয় ৷ প্রসূতি ও শিশুরা নিয়মিত দুই সেন্টারে আসেন ৷ রান্না করা খাবার নিয়ে বাড়ি চলে যান ৷
অনেক সময় আবার গ্রামের মূল রাস্তার ধারেই খাবার খেতে বসে পড়েন ৷ বাচ্চারা পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত ৷ গ্রামবাসীদের কথা অনুযায়ী আইসিডিএস সেন্টার নির্মাণের জন্য গ্রামে থাকা সরকারি খাস জমি দেখা হয়েছিল ৷ কিন্তু সেই জমি দখল করে রয়েছেন তৃণমূল নেতা বাদিরুদ্দিন শেখ নামে এক ব্যক্তি ৷ তিনি আবার তৃণমূলের নেতা ৷ তাই তাঁকে সরাতে পারা যাচ্ছে না ৷ এমনকি প্রশাসনও তাঁকে ওই জমি থেকে সরাতে ব্যর্থ বলে অভিযোগ ৷
এই দু’টি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের ইনচার্জ কুমকুম দাস অধিকারী বলেন, "আমার দু’টি সেন্টারেই খুব অসুবিধে ৷ আমাকে লোকের বাড়িতে রান্না করতে হয় ৷ তারা আমাকে রান্না করতে দিতে চায় না ৷ এমনকি সেন্টার চালাতে দিতেও চায় না ৷ যখন তখন আমাকে সেন্টার তুলে নেওয়ার কথা বলে ৷ তারা সেন্টারের মালও নামাতে দেয় না ৷ হেল্পারের বাড়িতে মাল থাকে ৷ সেটাতেও অনেকের আপত্তি ৷ অন্য সেন্টারে নামিয়ে সেখান থেকে মাল এনে রান্না করতে বলছে ৷"

তিনি আরও বলেন, "এরা আমাদের সেন্টার করতে দেবে না বলছে ৷ বাচ্চাদের পড়াশোনাও করাতে পারছি না ৷ এরা তো রান্না করতেই দিতে চাইছে না, পড়াশোনা কোথায় করাব ? জায়গাই তো নেই ৷ আমাদের ঘরের খুব প্রয়োজন ৷ বাচ্চা-প্রসূতিরা রাস্তায় খাচ্ছে৷ জায়গা না থাকলে ওরাই বা কী করবে ! রাস্তায় ধুলো উড়ছে, সাইকেল-টোটো যাচ্ছে, তার মধ্যেই ওরা খাবার খাচ্ছে ৷ খাবার খাওয়ার সময় গরু-ষাঁড়ও চলে আসছে ৷ এভাবেই সেন্টার চলছে ৷ অনেক সময় বাচ্চাদের মায়েরা খাবার নিয়ে চলে যায় ৷ আমরা বিভিন্ন জায়গায় ঘরের আবেদন করেছি ৷ অফিসেও কাগজপত্র জমা দেওয়া আছে ৷ তবে কবে ঘর পাওয়া যাবে জানি না ৷"
গ্রামের বাসিন্দা অঞ্জলি পাহান বলছেন, "সমস্যা যে আছে সেটা তো সবাই দেখতে পাচ্ছে ৷ এতে কোনও লুকোছাপার বিষয় নেই ৷ বাচ্চারা আসছে, খিচুড়ি নিয়ে চলে যাচ্ছে ৷ ওদের দাঁড়ানোর জায়গাটুকুও নেই ৷ এটা তো রাস্তা ৷ সবসময় সাইকেল, মোটর সাইকেল চলছে ৷ তাহলে বাচ্চাদের কোথায় পড়াবে? আমরা যে দিদিমনিকে এই বিষয়ে কিছু বলব, তার উপায় নেই ৷ দিদিমনিকে কিছু বলতেই পারি না ৷ আমাদের এখন সেন্টারের ঘর দরকার ৷ বাচ্চাদের তো পড়াশোনা করাও প্রয়োজন ৷ শুধু খিচুড়ি খেয়ে কী হবে ৷"
আরেক গ্রামবাসী জ্যোতির্ময় বিশ্বাসের অভিযোগ, "গ্রামে সরকারি জায়গা আছে ৷ কিন্তু সেই জায়গাটি এমন এক ব্যক্তিকে জবরদখলের জন্য দেওয়া হয়েছে যাঁর প্রচুর সম্পত্তি ৷ আমরা বিষয়টি বিএল অ্যান্ড এলআরও থেকে শুরু করে জেলাশাসক পর্যন্ত সবাইকে জানিয়েছি ৷ কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থা হচ্ছে না ৷ এই গ্রামের ছেলেমেয়েরা যে পড়াশোনা করার জন্য একটা সুস্থ পরিবেশ পাবে, ভালো পরিবেশে খাবার খেতে পারবে, ভালো জায়গায় রান্না হবে, তার কোনও সংস্থান নেই ৷ আমরা চাইছি, গ্রামে থাকা সরকারি 20 শতক খাস জমিতেই আইসিডিএস সেন্টারের ঘর তৈরি হোক ৷"

সরকারি খাস জমি দখল করার অভিযোগ যাঁর বিরুদ্ধে উঠেছে, সেই বাদিরুদ্দিন শেখের ছেলে ডালিম শেখ কিন্তু এনিয়ে সরাসরি কোনও উত্তর দিতে চাননি৷ তিনি বলেন, "এই জায়গা বাবার নামে রয়েছে ৷ একজনের কাছ থেকে এই জায়গা কেনা হয়েছে ৷ আপনার বাড়িতে কি আমি ঢুকে যেতে পারব ? আপনার বাড়িতে গেলে আপনি হয়তো আমাকে বসতে দেবেন ৷ থাকতে দেবেন কি ? এখানে যে থাকে তারই এটা জমি ৷ গ্রামের লোকজন যা বলছে তাতে যদি বিশ্বাস করবেন তো করুন !"
গাজোলের বিজেপি বিধায়ক চিন্ময় দেববর্মনের কথায়, "এটা সত্যিই লজ্জাজনক বিষয় ৷ ধাওয়েল গ্রামে দু’টি আইসিডিএস সেন্টার রয়েছে ৷ দু’টির নম্বর 512 এবং 514 ৷ ওই দু’টি সেন্টারে গিয়ে আমি দেখতে পাই, সেখানে কোনও স্থায়ী ঘর নেই ৷ খাবার নেওয়ার জন্য বাচ্চাদের দাঁড়ানোরও জায়গা নেই ৷ গ্রামের এক সহৃদয় ব্যক্তি তাঁর বাড়ির একটি অংশে রান্না করার অনুমতি দিয়েছেন ৷ সেখানে পঠনপাঠনের কোনও ব্যবস্থা নেই ৷ যিনি দিদিমনি, তিনি 514 নম্বরের দায়িত্বে রয়েছেন ৷ তাঁকেই 512 নম্বরের ইনচার্জ করা হয়েছে ৷ তিনি আসেন ৷ খিচুড়ি বিলি করেন ৷ মায়েরা সেই খিচুড়ি নিয়ে চলে যান ৷ কারণ, বাচ্চাদের খাবার খাওয়ার জায়গা নেই ৷"
তাঁর সংযোজন, "গ্রামবাসীরা একাধিকবার প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছে ৷ বিএল অ্যান্ড এলআরও থেকে শুরু করে জেলাশাসককে পর্যন্ত চিঠি দিয়েছে ৷ সম্প্রতি ব্লক ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের আধিকারিক ওই জমির জবরদখলকারীকে সাতদিনের উচ্ছেদ নোটিশ পাঠিয়েছেন ৷ সাতদিনের মধ্যে জমি খালি করার নির্দেশ দিয়েছেন ৷ কিন্তু সাতদিন পেরিয়ে গেলেও জবরদখলকারী ব্যক্তি সেই জমি খালি করেননি ৷ বিডিও আর আইসি শুধু বলছেন, তাঁরা দেখছেন ৷ প্রশাসনিক কর্তারাই যদি শাসকদলের ভয়ে মেরুদণ্ডহীন হয়ে থাকেন, তবে সাধারণ মানুষ আজ কোথায় যাবে? এই ঘটনায় পশ্চিবঙ্গ সরকারের কঙ্কালসার চেহারার ছবি প্রকাশ পেয়েছে ৷"

সুসংহত শিশু বিকাশ প্রকল্পের আধিকারিক খোকন বৈদ্য বলেন, "ঘটনাটি ধাওয়েল আদিবাসী পাড়ার ৷ সেখানে ভাড়া বাড়িতে আমাদের সেন্টার চলে ৷ সেখানে আমাদের নিজস্ব ঘর তৈরির জন্য ইতিমধ্যে প্রস্তাব পাঠানো আছে ৷ এনিয়ে বিডিওর সঙ্গে আমার কথাও হয়েছে ৷ আমরা বলেছি, ধাওয়েলে আমরা একটি ভেস্ট জমির সন্ধান পেয়েছি ৷ সেখানকার মানুষজনও আমাদের লিখিতভাবে বিষয়টি জানিয়েছেন ৷ তাঁরা সেখানে সেন্টারের ঘর তৈরির আবেদন করেছেন ৷ আমরা জেলায় প্রকল্প পাঠিয়েছি ৷ কিন্তু সেখান থেকে এখনও আমাদের কাছে নতুন ঘরের তালিকা চায়নি ৷ কিন্তু খাস জমি দখল করে রাখার খবর আমরা এখনও পাইনি ৷ তবে খাস জমি থাকলে তা দখল করা যাবে না ৷ সেখানে আইসিডিএস ভবন হবেই ৷ বিডিও নিজেও সেকথা জানিয়ে দিয়েছেন ৷ আমি এনিয়ে দ্রুত বিডিওকে চিঠি পাঠাব ৷"
যদিও ধাওয়েল গ্রামে খাস জমি থাকার কথাই মানতে চাননি তৃণমূল পরিচালিত গাজোল পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি মোজাম্মেল হোসেন ৷ উলটে এতে বিজেপির চক্রান্ত দেখতে পাচ্ছেন তিনি ৷ তাঁর সাফ কথা, "যে আইসিডিএস সেন্টার নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে, সেটি পঞ্চায়েত সমিতি ও ব্লক প্রশাসনের প্রত্যেকের নজরে রয়েছে ৷ এটা বিরোধীদের অপপ্রচার ৷ যে খাস জমি নিয়ে বিতর্ক, সেই জমি নিয়ে বিএল অ্যান্ড এলআরও, বিডিও এবং গাজোল থানার আইসির তিন সদস্যের কমিটি তদন্ত শুরু করেছিল ৷ তদন্তে উঠে এসেছে, ওই ভদ্রলোক সরকারি জায়গায় নেই ৷ এই জায়গার সঙ্গে আইসিডিএস সেন্টারের কোনও সম্পর্ক নেই ৷"
তাঁর কথায়, "গ্রামবাসীরা নয়, বিজেপি আশ্রিত ওই এলাকার কিছু স্বার্থাণ্বেষী মানুষ, যাদের এককথায় দুষ্কৃতী বললেই চলে, তারাই এই মিথ্যে অপপ্রচার চালাচ্ছে ৷ তারা এনিয়ে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছে ৷ আমরা তবু বিএল অ্যান্ড এলআরওকে তদন্ত করতে বলেছি ৷ আশা করি, কয়েকদিনের মধ্যেই বিরোধীরা আসল তথ্য পেয়ে যাবে ৷ তবে আগামিদিনে ওখানে আইসিডিএস সেন্টার নিয়ে কোনও সমস্যা থাকবে না ৷ আমরা অল্পদিনের মধ্যেই এই সমস্যার সমাধান করতে চাইছি ৷"