কলকাতা, 6 এপ্রিল: 16 মে, 2023 ৷ দুপুর নাগাদ হঠাৎই কেঁপে ওঠে এগরা এক নম্বর ব্লকের সাহারা গ্রাম পঞ্চায়েতের খাদিকুল গ্রাম । আচমকাই বিকট শব্দ শুনতে পান স্থানীয়রা ৷ প্রথমে তাঁরা কিছু বুঝে উঠতে পারেননি ৷ পরে, বাইরে বেরিয়ে এসে দেখেন চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দেহাংশ। গাছের মাথা থেকে, খড়ের চাল, বিস্ফোরণের অভিঘাতে দেহের টুকরো ছড়িয়ে পরে বেশ খানিকটা এলাকা জুড়ে। এটা এ রাজ্যের জন্য কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বাংলা আর সন্ত্রাস যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, দেশের সংস্কৃতির পীঠস্থানে রক্তের এই হোলি খেলার নেপথ্যে আছে রাজনৈতিক সমীকরণও।
এগরার ওই ঘটনায় প্রাণ যায় বেআইনি বাজি কারখানার মালিক কৃষ্ণপদ বাগ ওরফে ভানু বাগের ৷ বরাবরই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ৷ বাম আমলে সিপিআই নেতা ছিলেন ৷ পরে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেন ৷ 2013 থেকে 2018 সাল পর্যন্ত তিনি এগরা-1 ব্লকের সাহাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্যও ছিলেন ৷ স্থানীয়রা দাবি করেছিলেন, ভানুর কারখানায় বিস্ফোরণ নতুন নয় ৷ এর আগে চারবার বিস্ফোরণ হয়েছে ৷ অন্তত পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে ৷ প্রতিবারই রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বেঁচে গিয়েছেন তিনি ৷
বিভিন্ন মহল, বিশেষ করে বিরোধীদের দাবি ছিল তৃণমূলের আমলে জতুগৃহে পরিণত হয়েছে বাংলা ৷ শাসকদল সে সময় যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করলেও ক্রমশ বেড়েছে এ জাতীয় ঘটনা ৷ দত্তপুকুর, বজবজ, ভূপতিনগর, ইংরেজবাজার... তালিকাটা ক্রমশ দীর্ঘ হয়েছে ৷
প্রত্যেক ক্ষেত্রেই নাম জড়িয়েছে জোড়াফুল শিবিরের। সামনে এসেছে বেআইনি বাজি কারখানার তত্ব ৷ যদিও বেশিরভাগ বিস্ফোরণস্থল থেকে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বা আইইডি পাওয়া যথেষ্ট ঈঙ্গিতবহ ৷ পাশাপাশি, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে অশান্তি, বোমাবাজির মতো ঘটনাও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ৷ তার উৎসস্থল যে শাসকদলের মদতে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে গজিয়ে ওঠা একের পর এর বেআইনি বাজি কারখানা আর তার আড়ালে শাসকদলের এবং পুলিশ-প্রশাসনের একাংশের মদতে বোমা বানানোর মশলা মজুত করার প্রবণতা, তা নিয়ে বরাবরই সরব হয়েছে বিরোধী শিবির ৷
আর 13 দিন পরে শুরু হবে লোকসভা ভোট ৷ 2021 সালের বিধানসভা ভোট কিংবা 2023 সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন, রাজ্যের বেশ কিছু জায়গায় অবাধ সন্ত্রাস প্রত্যক্ষ করেছে রাজ্যবাসী ৷ বলি হয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থকরা ৷
বিরোধীদের অভিযোগ ছিল, ব্যালট নয়, বুলেট-বোমায় ভোট হয়েছে রাজ্যে ৷ নির্বাচন কমিশনের হিসেব অনুযায়ী, 2023 সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্যে প্রাণ গিয়েছিল 55 জনের ৷ জুলাইয়ে সেই পঞ্চায়েত ভোটের আগে ঘটেছিল এগরা, ইংরেজবাজার, বজবজের ঘটনা ৷ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার অনুমান, ঘটনাগুলি একেবারেই বিচ্ছিন্ন নয় ৷ বরং একটির সঙ্গে অন্যটির সম্পর্ক খুবই নিবিড় ৷
গোয়েন্দাদের অনুমান, বাজি তৈরি করতে দেশি মশলার পরিবর্তে বাইরে থেকে চোরাগোপ্তা পথে আমদানি করা হচ্ছে সস্তার চাইনিজ মশলা । একে সস্তায় চাইনিজ মশলা কিনে আনা তার উপর ব্যবহার করার ক্ষেত্রে অপর্যাপ্ত কারিগরি জ্ঞান- এই দুই কারণেই বাংলায় পরপর বিস্ফোরণ হচ্ছে ৷
রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন এডিজি নজরুল ইসলাম বলেন, "স্থানীয় প্রশাসনকে কাঠের পুতুল হিসেবে ব্যবহার করছেন কোনও কোনও নেতানেত্রী । তবে পুলিশের নিজস্ব নেটওয়ার্ক রয়েছে। তাতে এলাকার কোথায় কোন পথে বেআইনি জিনিস আসছে তা পুলিশ ভালোভাবেই জানে।"
এনএসজি-র প্রাক্তন কমান্ডো দীপাঞ্জন চক্রবর্তীও একই কথা বলছেন। দত্তপুকুর-সহ আগে যে বিস্ফোরণগুলি বাংলায় হয়েছে, সেগুলি নিয়ে তিনি দুষেছেন পুলিশ ও রাজ্য় প্রশাসনকেই ৷ তাঁর কথায়, "এগরা-নৈহাটি, তারপর দত্তপুকুর এলাকায় এই ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনার দায় পুলিশ ও প্রশাসনের। পুলিশ-প্রশাসনের একটি অংশের অকর্মণ্যতার জন্য গোটা পুলিশ ব্যবস্থাটাই একেবারে ভেঙে পড়েছে । যতদিন যাবে পশ্চিমবঙ্গে ভয়াবহ বিস্ফোরণের মতো ঘটনার সংখ্যা বাড়তেই থাকবে।’’
একনজরে বিস্ফোরণের ইতিবৃত্ত
1. 2022 সালের 3 ডিসেম্বর পূর্ব মেদিনীপুরের নাড়ুয়াবিলা গ্রামের রাজকুমার মান্নার দোতলা বাড়িতে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে । মৃত্যু হয় তিনজনের । ঘটনার পর পুলিশ তদন্ত শুরু করলেও পরে এই ঘটনার তদন্তভার নেয় এনআইএ ।
2. 2023 সালের 23 মে মালদার ইংরেজবাজারের একটি গুদামে কার্বাইড ও বাজি মজুত ছিল ৷ ওই গুদামে বাজি মজুতের লাইসেন্স থাকলেও কার্বাইড রাখার লাইনেন্স ছিল না ৷ সেখান থেকেই বিস্ফোরণ ঘটে 2 জনের মৃত্যু হয় ৷
3. এগরা বেআইনি বাজি কারখানার বিস্ফোরণ ৷ 2023 সালের 16 মে কেঁপে ওঠে এগরা ৷ বিস্ফোরণে মূল অভিযুক্ত ভানু বাগ-সহ 9 জনের মৃত্যু হয়। বেআইনিভাবে ওই কারখানাটি গড়ে ওঠে।
4. দক্ষিণ 24 পরগনার বজবজেও একই ঘটনা ঘটেছিল ৷ বেআইনিভাবে মজুত করে রাখা বাজি ফেটে বিস্ফোরণ ঘটে ৷ 2023 সালের 22 মে ওই ঘটনায় একই পরিবারের তিন সদস্যের মৃত্যু হয়।
5. 2023 সালের 27 অগস্ট দত্তপুকুর বেআইনি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ ৷ কেঁপে ওঠে মোচপোল এলাকা ৷ ভয়াবহ এই বিস্ফোরণে 300 মিটার দূরে ছিটকে পড়ে দেহাংশ ৷ 3 কিমি দূরে বাড়ির কাঁচও ভেঙে পড়ে
বিস্ফোরণের সংখ্যার মতোই বিরাট বাংলার দুর্ভাগ্য। এখানে ভোট এলেও বোমা পড়ে। ভোট না থাকলেও বোমা-গুলির শব্দে ভরে ওঠে আকাশ-বাতাস। ঘটনার পর চিত্রগুপ্তর মতো 'লাশ গুনতে' থাকে সংবাদমাধ্যম। প্রশ্ন একটাই, কবে থামবে বোমা-গুলির ঝড়? কবে বোমা আর গুলির সন্ত্রাস বাদ যাবে বঙ্গের বুক থেকে? কবে এই মৃত্যু উপত্যকাকে পেছনে ফেলে শান্ত হবে আমার-আপনার বাংলা! প্রশ্ন গুলো সহজ হলেও উত্তর জানা নেই।
আরও পড়ুন: