কলকাতা, 8 এপ্রিল: হাজার হাজার চাকরি বাতিলের ঘটনায় উত্তপ্ত রাজ্য-রাজনীতি ৷ বিতর্কের এই আবহে ঘি ঢালল তৃণমূল সাংসদদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট ৷ মঙ্গলবার বঙ্গ বিজেপি একটি হোয়াটসঅ্যাপ চ্য়াটের অংশবিশেষ সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছে ৷ গেরুয়া শিবিরের দাবি, ওই চ্যাটে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়েছে লোকসভা সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও কীর্তি আজাদের মধ্যে ৷ যদিও এই চ্যাটের সত্যতা যাচাই করেনি ইটিভি ভারত ৷
চ্যাটের পাশাপাশি বিজেপির আইটি সেলের প্রধান অমিত মালব্য একটি ভিডিয়ো ফুটেজ সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছেন ৷ সেখানে দেখা যাচ্ছে তৃণমূলের লোকসভা সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় দলেরই আরেক সাংসদের উপর চেঁচামেচি করছেন ৷ অন্যদিকে, তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন উপস্থিত অন্য সাংসদরা ৷
এদিকে এই গোলমালের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন কল্যাণ ৷ এর জন্য তিনি দলেরই এক মহিলা সাংসদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন ৷ সংবাদসংস্থা পিটিআই তাঁর বক্তব্য উদ্ধৃত করেছে ৷ কল্য়াণ বলেছেন, "আমি গত 40 বছর ধরে রাজনীতি করছি ৷ এই মহিলা সাংসদ নির্বাচন কমিশনে থাকা নিরাপত্তাকর্মীদের আমাকে গ্রেফতার করতে বলছেন ৷ ওরা আমায় জেলে পাঠানোর কে ? তিনি আমায় কটূক্তি করেছেন ৷ আমি সংসদে লড়াই করি ৷ বিশেষ কোনও শিল্পপতিকে নিয়ে মাথা ঘামাই না ৷"
Soon after the public spat between two TMC MPs in the precincts of the Election Commission of India on 4th April 2025, the irate MP continued slandering the ‘Versatile International Lady (VIL)’…
— Amit Malviya (@amitmalviya) April 8, 2025
This is the stuff legends are made of! pic.twitter.com/dsubQrmQUj
কল্যাণ প্রসঙ্গে সৌগত রায়
এই হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটের বিষয়ে কিছু জানেন না বলে দাবি করেছেন লোকসভার আরেক বর্ষীয়ান সাংসদ সৌগত রায় ৷ কিন্তু বিজেপির এই চ্যাট ও ভিডিয়ো ফাঁসের ঘটনার ফলে দলের সম্মানহানি হয়েছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি ৷ সৌগত বলেন, "ঠিক কী হয়েছিল, তা আমি জানি না ৷ আমি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সক্রিয় নই ৷ ব্যক্তিগতভাবে জানি না কী ঘটেছিল ৷ যাই হোক না কেন, এটা আমাদের দলের মানহানি করেছে ৷"
এই আবহে তিনি কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে দলের মুখ সচেতকের পদ থেকে সরানোর দাবি তুলেছেন ৷ সৌগত বলেন, "তিনি যা করেছেন, তাতে দল কালিমালিপ্ত হয়েছে ৷ অবিলম্বে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে মুখ সচেতকের পদ থেকে সরানো উচিত ৷ তিনি দলের প্রত্যেকের সঙ্গেই খারাপ ব্যবহার করেন এবং সবাইকে অপমান করেন ৷"
হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট-ভিডিয়ো নিয়ে বিজেপির কটাক্ষ
এদিন হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটের অংশ পোস্ট করে বিজেপি সোশাল মিডিয়ায় তৃণমূলকে কটাক্ষ করে লিখেছে, "4 এপ্রিল তৃণমূলের সার্কাস নতুন করে আরও একধাপ নীচে নামল ৷ একটা স্মারকলিপি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়ের মধ্যে দলের দুই সাংসদ তুমুল চিৎকার-চেঁচামেচি করছিলেন ৷ তাঁদের মধ্যে একজন সংসদে না গিয়ে সোজা নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়ে পৌঁছন ৷ অন্যজন তাঁকে আক্রমণ করেন ৷ এরপর হইচই হতে থাকে ৷ এই অবস্থায় পুলিশকে নাক গলাতে হয়েছে ৷"
On 4th April 2024, two TMC MPs had a public spat at the headquarters of the Election Commission of India, where they had gone to submit a representation. It appears the party had instructed its MPs to gather at the Parliament office to sign the memorandum before proceeding to the… pic.twitter.com/BwqQRE8FhI
— Amit Malviya (@amitmalviya) April 7, 2025
এই পরিস্থিতিতে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুই সাংসদকেই সংযত হওয়ার পরামর্শ দেন ৷ তাঁর ভূমিকা নিয়ে বিজেপি লিখেছে, "মমতা এই ড্যামেজ কন্ট্রোলে নেমেছিলেন ৷ কিন্তু ততক্ষণে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে নাটকের ছড়াছড়ি হয়ে গিয়েছে ৷ " এরপর বিজেপির প্রশ্ন, "এই সবকিছুর মধ্যে একটা প্রশ্ন জ্বলজ্বল করছে, ওই 'ভার্সেটাইল ইন্টারন্যাশনাল লেডি' কে ? টলিউডের স্ক্রিপ্টও এর কাছে হার মানবে ৷"
এই চ্যাট ও ভিডিয়ো দলের বাইরে প্রকাশ্যে এনেছে তৃণমূলেরই কেউ ৷ অমিত মালব্য একটি পোস্টে এই দাবি করে জানিয়েছেন, "এটা নিশ্চিত যে, এই চ্যাটের স্ক্রিনশট এবং ভিডিয়ো তৃণমূল সাংসদদের ভিতর থেকেই ফাঁস হয়েছে ৷ কে এইসব ফাঁস করল, তা খুঁজতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সাহায্য় করুন ৷"
বিতর্কের নেপথ্যে ঘটনা
সূত্রে জানা গিয়েছে, এই ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে তৃণমূলের দুই সাংসদের মতানৈক্য ৷ দু'জনের মধ্যে একজন প্রবীণ সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ 4 এপ্রিল দিল্লিতে নির্বাচন কমিশনের কার্যালয় নির্বাচন সদনে গিয়েছিলেন তৃণমূল সাংসদদের একটি প্রতিনিধি দল ৷
সেখানে লোকসভার সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ অন্য তৃণমূল সাংসদরা নির্বাচন সদনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ৷ দলের তরফে সাংসদদের প্রথমে সংসদীয় পার্টি কার্যালয়ে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ৷ কিন্তু দলের এক মহিলা সাংসদ সেখানে না গিয়ে সরাসরি নির্বাচন সদনে হাজির হন ৷
অভিযোগ, ওই মহিলা সাংসদ, সংসদে দলের কার্যালয়ে না-গিয়ে সরাসরি নির্বাচন সদনে যাওয়ায় তাঁর উপর রেগে যান কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ তখন মহিলা সাংসদকে নিশানা করে প্রকাশ্যে কটূক্তি করেন তিনি ৷ তখন ওই মহিলা সাংসদ দিল্লিতে নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়ের প্রহরায় থাকা সিআইএসএফ ও বিএসএফ জওয়ানদের ডেকে কল্যাণকে গ্রেফতার করতে বলেন ৷ এই পরিস্থিতিতে জওয়ানরাও অপ্রস্তুতিতে পড়েন ৷
নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়ের ভিতরে ঢুকেও সেই গোলমাল চলতে থাকে ৷ সেখানে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ওই মহিলা সাংসদের বিরুদ্ধে সুর চড়ান ৷ উপস্থিত অন্য় তৃণমূল সাংসদরা তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যান ৷ এরপর এই ঝামেলা নিয়ে তৃণমূল সাংসদদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে তুলকালাম গণ্ডগোল হয় ৷ সূত্রের খবর, দুই সাংসদই তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে অভিযোগ করেছেন ৷
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তৃণমূল কংগ্রেসের এক প্রবীণ নেতা বলেন, "স্মারকলিপি জমা দিতে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়ে পৌঁছন ৷ সেখানে কমিশনের কাছে জমা দেওয়ার স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করা নিয়ে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দলেরই এক মহিলা সাংসদের বচসা বাধে ৷ তখন ওই মহিলা সাংসদ অভিযোগ করেন, বর্ষীয়ান সাংসদ একজন মহিলা সাংসদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন ৷ এই অভিযোগে তিনি নিরাপত্তাকর্মীদের সাংসদকে গ্রেফতার করতে বলেন ৷"
হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট বিতর্ক
বিজেপি যে হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটটি প্রকাশ করেছে সেখানে লোকসভা সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আরেক সাংসদ কীর্তি আজাদের তর্কাতর্কি ফাঁস হয়েছে ৷ কল্যাণ কারও নাম উল্লেখ না করে লিখছেন, "আমি কলকাতায় পৌঁছেছি ৷ আপনার দিল্লি পুলিশ আর বিএসএফকে বলুন আমায় গ্রেফতার করতে ৷" তিনি মহিলা সাংসদকে 'ইন্টারন্যাশনাল গ্রেট লেডি' বলে উল্লেখ করে লিখেছেন, "স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকে আপনার যোগাযোগ তো বেশ ভালো ৷"
এদিকে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে শান্ত করার চেষ্টা করেছেন আরেক লোকসভা সাংসদ কীর্তি আজাদ ৷ তিনি লিখেছেন, "একটু শান্ত হও ৷ ছেলেমানুষী করো না ৷ দিদি তোমাকে একটি গুরুদায়িত্ব দিয়েছেন ৷" এর জবাবে কল্যাণ কীর্তিকে পাল্টা আক্রমণ করে লেখেন, "আমাকে উপদেশ দিও না কীর্তি ৷ তুমি দলের অন্দরে রাজনীতি করেছিলে বলে বিজেপি তোমায় বের করে দিয়েছে ৷ আমি তোমার চেয়ে বয়সে বড় ৷ গতকালই তুমি দলটাকে বিক্রি করতে চেয়েছিলে ৷ এখনও তুমি অন্দরের রাজনীতিতে ক্যাপ্টেন ৷"
বিজেপি নেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায়ের আক্রমণ
এই সুযোগে শাসকদলকে আক্রমণ করতে নতুন উদ্যমে মাঠে নেমেছে বিজেপি ৷ মঙ্গলবার অমিত মালব্যর শেয়ার করা ভিডিয়ো নিয়ে লকেট চট্টোপাধ্যায় বলেন, "তৃণমূলের চরিত্র কী, তা আমরা সবাই জানি ৷ এবার তা ফাঁস হয়ে গিয়েছে ৷ হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে তাঁরা একে অপরের সঙ্গে কীভাবে কথা বলেন, তাও আমরা দেখতে পাচ্ছি ৷ এমনকী তাঁরা মহিলা সাংসদকেও ছাড়েননি ৷ তৃণমূল নেতাদের নিজেদের মধ্যেই বিশ্বাস নেই ৷ সবাই জানে, তাঁরা একজন মহিলা সাংসদকে অপমান করেছেন ৷ মুখ্যমন্ত্রী মহিলা হওয়া সত্ত্বেও কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় একজন মহিলাকে অসম্মান করেছেন ৷ ৷"