বোলপুর, 6 জুন: ফের যেন স্বমহিমায় অনুব্রত মণ্ডল। কিছুই যেন হয়নি এই কয়েকদিনে। অডিয়ো-কাণ্ডে বৃহস্পতিবার এসডিপিও অফিসে হাজিরা দিয়েছেন তৃণমূল নেতা ৷ তাঁকে ঘণ্টাদুয়েক জেরা হয় বলে খবর ৷ শুক্রবার বিকেলে বোলপুর দলীয় কার্যালয়ে আসেন তিনি ৷ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন দলের নেতা-কর্মীরা। বোলপুরের নেতা-কর্মীরা ছাড়াও মুরারই থেকে শয়ে শয়ে কর্মী আসেন কেষ্টর সঙ্গে দেখা করতে ৷
বিতর্কিত অডিয়ে-কাণ্ডের ঘটনাক্রম:
1) 29 মে বোলপুর থানার আইসি লিটন হালদারের বিরুদ্ধে থানা ঘেরাও করে বোলপুর নাগরিক মঞ্চ ৷ আইসি সঙ্গে বালি মাফিয়াদের যোগসাজশ রয়েছে, শহরের নিরাপত্তা নেই প্রভৃতি অভিযোগ তুলে চলে থানা ঘেরাও ৷ বোলপুর নাগরিক মঞ্চের নামে থানা ঘেরাও হলেও সেখানে দেখা যায় অনুব্রত অনুগামীদের ভিড় ৷
2) 29 মে রাতে একটি অডিও ক্লিপ ভাইরাল হয় ৷ তাতে শোনা যায় অনুব্রত মণ্ডল পরিচয় দিয়ে বোলপুর থানার আইসি-কে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হচ্ছে ৷ এমনকি, আইসি-কে হুঁশিয়ারি দেওয়া হচ্ছে ৷
3) 30 মে বোলপুর এসডিপিও অফিসে আসেন বীরভূম জেলা পুলিশ সুপার আমনদীপ সিং। এসডিপিও রিকি আগরওয়াল, অতিরিক্ত বীরভূম জেলা পুলিশ সুপার (বোলপুর) রাণা মুখোপাধ্যায় ও বোলপুর থানার আইসি লিটন হালদারের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। পরে বোলপুর থানায় যান এসপি ৷ অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা (বিএনএস) 224 (সরকারি কাজে বাধা দেওয়া ও কর্তব্যরত কর্মীকে হুমকি), 132 (সরকারি কর্মচারীকে হেনস্থা), 75 (শ্লীলতাহানি ও হেনস্থা) ও 351 (হুমকি) ধারায় মামলারুজু হয় ৷ যার মধ্যে দু'টি জামিন অযোগ্য ধারা ৷ মামলার তদন্তকারী অফিসার হলেন বোলপুরের এসডিপিও ৷

এদিনই, বিকেলে বোলপুর দলীয় কার্যালয়ে পুলিশ গিয়ে অনুব্রতকে নোটিশ দেন ৷ 31 মে তাঁকে তলব করা হয় ৷ দিকে দিকে অনুব্রতকে গ্রেফতারির দাবিতে সরব হন বিরোধীরা ৷
4) 31 মে হাজিরা এড়িয়ে যান অনুব্রত মণ্ডল । তাঁর বদলে বিপদতারণ ভট্টাচার্যর নেতৃত্বে 4 জন আইনজীবী বোলপুর এসডিপিও অফিসে গিয়ে সময় চেয়ে চিঠি দেন ৷ ওই দিনই পুলিশের তরফে ফের একটি নোটিশ দেওয়া হয় অনুব্রতকে ৷ 1 জুন তাঁকে ফের তলব করেন তদন্তকারী অফিসার। যদিও, হাজিরা এড়িয়ে বোলপুরের নীচুপট্টীর বাড়ি থেকে 31 মে দলীয় কার্যালয়ে আসেন অনুব্রত ৷ যা নিয়ে রীতিমতো বিতর্ক তৈরি হয় ৷ অনুব্রতকে গ্রেফতারের দাবি আরও জোরালো হয়।
5) 1 জুন ফের হাজিরা এড়িয়ে যান অনুব্রত মণ্ডল৷ আইনজীবী বিপদতারণ ভট্টাচার্য ও অনুব্রতর ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত তৃণমূল নেতা গগন সরকার এসডিপিও অফিসে আসেন ৷ চিকিৎসকের মেডিক্যাল রিপোর্ট জমা দিয়ে 5 দিন সময় চান ৷ এই মেডিক্যাল রিপোর্ট নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয় ৷ বেসরকারি শান্তিনিকেতন মেডিক্যাল কলেজ থেকে এই সার্টিফিকেট দেওয়া হয়, তাতে সই ছিল চিকিৎসক হিটলার চৌধুরীর ৷ এই চিকিৎসক রামপুরহাট 1 নম্বর ব্লকের স্বাস্থ্য আধিকারিক (বিএমওএইচ)। প্রশ্ন ওঠে, একজন সরকারি স্বাস্থ্য আধিকারিক কীভাবে বেসরকারি শান্তিনিকেতন মেডিক্যাল কলেজে আরএমও পদে থাকতে পারেন। যা নিয়ে নীরব ছিলেন চিকিৎসক হিটলার চৌধুরী। তবে পুলিশ অনুব্রতকে 5 দিন সময় দেন ৷
6) 2 জুন বোলপুর থানার আইসি লিটন হালদারের বিরুদ্ধে যে তোলাবাজি, বালি মাফিয়াদের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ উঠেছিল তা নিয়ে পুলিশ বিভাগীয় তদন্ত শুরু করে। পাশাপাশি, কীভাবে অনুব্রতর সঙ্গে কথোপকথনের অডিয়ো ক্লিপ বাইরে বেরল হয়, তা নিয়েও তদন্ত শুরু হয় ৷ কারণ, গোপনীয়তার অধিকার আইন অনুযায়ী কথোপকথন রেকর্ড করা ও ভাইরাল করা বেআইনি ৷ তদন্তের স্বার্থে পুলিশ আইসি-র দুটি মোবাইল ফোন বাজেয়াপ্ত করে ৷

7) 5 জুন চেয়ে নেওয়া সময় শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই বোলপুর এসডিপিও অফিসে হাজিরা দেন অনুব্রত মণ্ডল। কোন কনভয় না-নিয়ে হঠাৎই দুপুর বেলা একটি কালো গাড়ি চড়ে তদন্তকারী অফিসার রিকি আগরওয়ালের কাছে আসেন তিনি ৷ অনুব্রত হাজিরা দেওয়ায় শান্তিনিকেতন থানা-সহ এসডিপিও অফিস নিশ্চিদ্র নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলা হয়েছিল ৷ অতিরিক্ত বীরভূম জেলা পুলিশ সুপার (বোলপুর) রাণা মুখোপাধ্যায় নিয়ে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন। এসডিপিও অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা দলীয় কার্যালয়ে যান কেষ্ট ৷ বেশ কিছুক্ষণ কার্যালয়ে থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়া দেন ৷ সেই সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নে অনুব্রত বলেন, "দু'দিন চালচলন দেখি তারপর বলব।"
8) পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রায় 2 ঘন্টার জিজ্ঞাসাবাদে অনুব্রতর কাছে জানতে চাওয়া হয় কোন ফোন থেকে তিনি আইসি-কে ফোন করেছিলেন ৷ 'মনে করতে পারছি না' জানিয়েছিলেন অনুব্রত ৷ এছাড়া, কেন আইসিকে ফোন করেছিলেন, ফোন করার সময় আপনার পাশে কে কে ছিল, তাও জানতে চাওয়া হয় ৷ জিজ্ঞাসাবাদের সময়ও আইসি-র বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দেন একাধিক অভিযোগ করেছেন অনুব্রত ৷ যদিও, তদন্তকারী অফিসার অনুব্রত মণ্ডলের ফোন বাজেয়াপ্ত করেননি ৷ ফোনটি হাতে নিয়ে দেখে তারপর ফিরিয়ে দিয়েছেন ৷
এদিন, ফের স্বমহিমায় অনুব্রত মণ্ডল। ঠিক বিকেল গড়াতেই কনভয় নিয়ে বাড়ি থেকে দলীয় কার্যালয়ে আসেন ৷ সাংবাদিকদের সঙ্গে কোন কথা বলতে চাননি ৷ কার্যালয়ে নিজের ঘরে গিয়ে বসেন ৷ জানা গিয়েছে, সেখানেই বোলপুরের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন। পরে মুরারই থেকে শয়ে শয়ে কর্মী অনুব্রতর সঙ্গে দেখা করতে আসেন ৷ সকলকে ডেকে ডেকে কথা বলেন অনুব্রত ৷ অর্থাৎ, কয়েক দিনের রেশ কাটিয়ে যেন অনুব্রত আছেন সেই অনুব্রততেই ৷