মুটেগিরিতে পেট চলছে তিনবারের রাজ্য চ্যাম্পিয়নের, আর্থিক সুরাহার আশায় মনু পালোয়ান
সবজির বস্তা টানতে মন চায় না ৷ জাতীয় স্তরে এবার পদক জয় লক্ষ্য এবার ৷ ইটিভি ভারতকে জানালেন মনু পালোয়ান ৷

Published : October 9, 2025 at 4:40 PM IST
কলকাতা, 9 অক্টোবর: রাত বাড়লে ব্যস্ত শিয়ালদা স্টেশন চত্বরে শপিং কমপ্লেক্স ছাড়িয়ে ডানদিকে ঘুরলেই রোজ দেখা যাবে তাঁকে ৷ রাতের সঙ্গে ব্যস্ততা বাড়ে তাঁর ৷ শিয়ালদা স্টেশনে ট্রেন ধরতে যাওয়া শশব্যস্ত যাত্রী কিংবা বাস-ট্যাক্সির অপেক্ষায় থাকা যাত্রীদের দিকে তাঁর নজর নেই ৷ তবে সবজি ভর্তি ম্যাটাডোর এসে থামতেই সে তৎপর হয়ে যায় ৷ সে আর কেউ নন, তিনবারের রাজ্য চ্যাম্পিয়ন কুস্তিগীর মনু রাই ৷ কুস্তি সার্কিটে যাঁর পরিচিতি মুন্না পালোয়ান নামে ৷
সবজির ম্যাটাডোর আসতেই মনুর তৎপর হয়ে ওঠার কারণ সবজির মুটেগিরি করে পেট চলে তাঁর ৷ 70 কেজিতে স্টেট চ্যাম্পিয়ন এবং জাতীয় কুস্তিতে চতুর্থ স্থানাধিকারী মনুর কোলে মার্কেট-সহ শিয়ালদা সংলগ্ন বাজারগুলিতে নিত্য যাতায়াত ৷ পরিবারের আর্থিক অনটন মেটাতে রাতভোর সবজির বস্তা মাথায় তোলা এবং নামানোই কাজ প্রশিক্ষক ভরত রায়ের শিষ্যের ৷
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে পালোয়ানি তো আর এমনি এমনি হয় না ৷ প্রয়োজন কঠোর সাধনা অর্থাৎ, প্র্যাকটিসের ৷ তাহলে কীভাবে সম্ভব হয় সবটা ? ইটিভি ভারতকে মনু রোজনামচার যা হিসেব দিল তাতে সে রাত সাড়ে দশটা থেকে ভোর সাড়ে ছ'টা পর্যন্ত লেগে থাকে এই কাজে ৷ এরপর সোজা বেলেঘাটা কুস্তি সংঘের আখড়ায় ৷ সেখানে ঘণ্টাদু'য়েক অনুশীলনের পর বাড়ি ফিরে স্নান-খাওয়া সেরে লম্বা ঘুম ৷ বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে ফের কুস্তির আখড়ায় ৷ ঘন্টা আড়াই সেখানে ঘাম ঝরানোর পর বিশ্রাম নিয়ে ফের শিয়ালদহ স্টেশন চত্বরে কাজে লেগে পড়া ৷
বেলেঘাটা আখড়ায় রেলের লোহার বেড়ায় ঘেরা একটুকরো মন্দির চত্বর ৷ সেখানেই ম্যাট পেতে চলে মনুদের অনুশীলন। সেখানে মনুর সতীর্থ যাঁরা, তাঁদের ঝুলিতেও রয়েছে বয়সভিত্তিক সাফল্য ৷ তবে একটি বিষয়ে মিল সকলের ৷ এদের কারও আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল নয় ৷ তবে মল্লযুদ্ধ তাঁরা বেছে নিয়েছে জীবনে কিছু করার আশায় ৷ মনু বলছে, "দশবছর ধরে কুস্তি করছি ৷ বয়সভিত্তিকে রাজ্য পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি ৷ এবার সিনিয়রে 70 কেজি বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি ৷ সিনিয়র-জুনিয়র অনূর্ধ্ব-23 বিভাগেও সোনা জিতেছি আমি ৷" 70 কেজি কুস্তিতে রাজ্য চ্যাম্পিয়ন আরও বলে, "রাতে শিয়ালদা যাই ৷ সেখানে সবজি তুলি ৷ তারপর কোলে মার্কেট থেকে সবজি নিয়ে গাড়িতে তুলি ৷ 80-90 কিলো ওজনের মাল থাকে, যা মাথায় তুলতে হয়। রাত দশটা থেকে শুরু করে সকাল ছ'টা পর্যন্ত কাজ করে সাতটায় আখড়ায় চলে আসি ৷ আশুবাজার, চুনি বাজার, টালা বাজারে লোকের সঙ্গে কথা বলে মাল দিয়ে আসি ৷ দু'শো-তিনশো টাকা হয়ে যায় ৷ তাই দিয়ে নিজের খরচ চলে ৷ পরিবারকে সাহায্য করি।"

মনুর আক্ষেপ, "আমার বাবা-দাদারা এই কাজ করতেন, আমিও করছি ৷ যদি কিছু হিল্লে হয় তাহলে সবকিছু ছেড়ে দেব ৷ রাত জেগে মাল টানতে ভালো লাগে না ৷ কুস্তির জন্য বিশ্রাম দরকার ৷ সেটা পাই কোথায় ৷ আখড়ায় এলে তরতাজা হই ৷ কিন্তু সেজন্য যে ধরনের বিশ্রাম, খাওয়া-দাওয়া দরকার হচ্ছে কোথায় ৷ জানি না কতদিন এভাবে চলবে ৷"
কোচ ভরত রায়ের কাছে কুস্তির প্রশিক্ষণ নেওয়া মনু ইতিমধ্যে জাতীয় স্তরে পদকের খুব কাছে পৌঁছে গিয়েছে ৷ রাজ্য সেরা হওয়ার পরে এবার জাতীয় পর্যায়ে পদক জয়কে পাখির চোখ করা মনু বলে, "বছর তিন চার আর কুস্তি করব ৷ তার মধ্যেই জাতীয় পর্যায়ে পদক জিততে চাই ৷ তা যদি পারি তাহলে কুস্তি চালিয়ে যাব ৷ নইলে এভাবে চালিয়ে যাওয়া কঠিন ৷" মনু জানায়, অন্য রাজ্যে সাফল্য পেলে চাকরি আছে, টাকাপয়সা আছে ৷ আমাদের রাজ্যে কিচ্ছু নেই ৷ ক্রীড়ামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে সমস্যার কথা তুলে ধরতে চায় বলেও জানাচ্ছে মনু ৷ সবমিলিয়ে প্রতিশ্রুতির প্রহেলিকার পিছনে ছুটে চলা যুবকের কথাগুলো যেন 'সকলের সাথ, সকলের বিকাশ' দাবির পিছনে কঙ্কালসার চেহারার ছবি।

