মালদা, 4 জুন: মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারির পরও সরকারি জমি দখলের অভিযোগ উঠল মালদার ইংরেজবাজার পুরসভায় ৷ অভিযোগ, তৃণমূল কংগ্রেসের কাউন্সিলরের মদতেই গোটা ঘটনা ঘটছে ৷ এমনকী ইংরেজবাজার পুরসভার চেয়ারম্যানও এর নেপথ্যে রয়েছে ৷ তবে ওই কাউন্সিলর এবং চেয়ারম্যান সরকারি জমি দখলের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ৷
অভিযোগ কী ?
ইংরেজবাজার পুরসভার 3 নম্বর ওয়ার্ডের মালঞ্চপল্লি এলাকায় রয়েছে সরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ৷ প্রায় চার একর জায়গার উপর রয়েছে এই কেন্দ্র ৷ সেই সরকারি জায়গাই দখল করার অভিযোগ উঠেছে এলাকার কাউন্সিলর মণীষা সাহা মণ্ডলের স্বামীর বিরুদ্ধে ৷ অভিযোগ, শাসকদলের প্রভাব খাটিয়ে এই সরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কয়েক কোটি টাকার জমির একটা অংশ তিনি ইটের প্রাচীর ও লোহার জাল দিয়ে ঘিরে ফেলতে শুরু করেছেন ৷
সরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অফিস ইনচার্জ কার্তিকচন্দ্র সরকার বলছেন, “এটা একসময় পুলিশ বিভাগের জায়গা ছিল ৷ 1964 সালে একটি সরকারি নির্দেশিকায় জায়গাটি আমাদের দফতরকে দেওয়া হয় ৷ এই জমিতে শুধু অফিস কিংবা কলেজ নয়, হস্টেলও তৈরি হয়েছে ৷ স্থানীয় লোকজনই সরকারি এই জায়গা দখল করার চেষ্টা করছে ৷ তৃণমূলের কাউন্সিলর নিজেই এখানে জমি ঘেরার কাজ করাচ্ছেন ৷ তিনি বলছেন, খেলার জন্য তাঁরা জায়গা ঘিরছেন ৷’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘আমাদের জানিয়ে এসব কাজ করা হয়নি ৷ আমি জানিয়ে দিয়েছি, খেলার জন্য এভাবে সরকারি জায়গা ঘেরা যায় না ৷ তাঁকে আমি ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছি ৷ এখন দেখা যাক, তিনি কী ব্যবস্থা নেন ৷ প্রয়োজন হলে আমাকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানাতে হবে ৷’’
কার্তিকচন্দ্র সরকার আরও বলেন, ‘‘এই জায়গা যে কোনও মুহূর্তে কলেজের প্রয়োজন হতে পারে ৷ যা মনে হচ্ছে, কাউন্সিলর তাঁর প্রভাব খাটিয়ে সরকারি এই জায়গা ঘেরার কাজ শুরু করেছেন ৷ এখানে আমাদের দফতরের 3.96 একর জায়গা রয়েছে ৷ তার মধ্যে কত অংশ ঘেরা হচ্ছে, তা অবশ্য মাপজোক না-করে বলতে পারব না ৷”
তৃণমূল কাউন্সিলরের কী বক্তব্য ?
এই নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তৃণমূলের কাউন্সিলর মণীষা সাহা মণ্ডল সাফাই তো দিয়েছেনই, সঙ্গে সংবাদমাধ্যমকে বেশ কিছু পরামর্শও দিয়েছেন ৷ তিনি বলেন, “সরকারি জমি দখলের অভিযোগ কে করেছে ? কোনও দল নাকি এলাকাবাসী ? ওই জমি দখলের কোনও পরিস্থিতি কি দেখা গিয়েছে ? আমি নিশ্চিত, এলাকার কেউ এই জায়গা নিয়ে একটাও কথা বলবে না ৷ কারণ, ওই জায়গা নিয়ে প্রচুর মানুষ ভুক্তভোগী ৷’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘ওই জায়গায় একটি খেলার পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে ৷ ওখানে কোনও ঘর, ক্লাব বা মন্দির তৈরি করা হচ্ছে না ৷ ওই মাঠে যাতে বাচ্চারা খেলতে পারে তার জন্য মাটি ফেলে মাঠটি সমান করা হয়েছে ৷ এর বাইরে কিছু হয়নি ৷ কেউ ব্যক্তিগত স্বার্থে যদি অভিযোগ করে থাকে তবে আপনারা সরেজমিনে মাঠটি দেখুন ৷’’

তিনি আরও বলেন, ‘‘ওই মাঠের পাশে এসএসসি দফতরের ভবন রয়েছে ৷ দীর্ঘদিন ধরে মাঠটিতে মাদকাসক্তদের আনাগোনা হচ্ছিল ৷ বহুবার চেষ্টা করেও আমরা সেই সমস্যার সুরাহা করতে পারিনি ৷ এটা বন্ধ করতেই সেখানে খেলার পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে ৷ বাচ্চারা যাতে দিনে ও রাতে খেলতে পারে তার জন্য কিছু আলোও লাগানো হয়েছে ৷”
এতকিছু বললেও কার টাকায় মাঠের চারপাশে প্রাচীর কিংবা লোহার জাল লাগানো হচ্ছে, তা মণীষাদেবী বলতে পারেননি ৷ সরকারি মাঠে খেলার পরিবেশ তৈরি করার জন্য পুরকর্তৃপক্ষ তাঁকে কোনও অনুমতি দিয়েছে কি না, বোর্ড অফ কাউন্সিলর্স সভায় তা নিয়ে কোনও আলোচনা হয়েছে কি না, সেসব প্রশ্নেও তিনি নিরুত্তর ৷
যদি পুরসভা ওই সরকারি মাঠে খেলার পরিবেশ তৈরি করার অনুমতি দিয়ে থাকে, তবে পুরসভা কোনও ফান্ডে সেখানে অর্থ খরচ করছে, এক লাখ টাকার বেশি কাজের জন্য কোনও টেন্ডার করা হয়েছে কি না, কোন ঠিকাদার সংস্থা এই কাজের বরাত পেয়েছে, সেসব প্রশ্নের উত্তরও তাঁর কাছে নেই ৷
ইংরেজবাজার পুরসভার চেয়ারম্যান কী বলছেন ?
ইংরেজবাজার পুরসভার চেয়ারম্যান কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী বলেন, “আমি যতদূর জানি, ওই জায়গাটিতে নোংরা পরিবেশ তৈরি হয়েছিল ৷ সাপের আখড়া হয়ে দাঁড়িয়েছিল ৷ এলাকার মানুষজন বাড়ির আবর্জনা সেখানে ফেলতেন ৷ ওখানকার ছোট ছোট ছেলেরা জায়গাটি পরিষ্কার করে খেলার উপযোগী করে তুলেছে ৷ এক্ষেত্রে জায়গা ঘেরা বা দখলের কোনও বিষয় নেই ৷ ওই জায়গায় কীর্তনের আসর বসে৷ আবার বিয়ের অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয় ৷”
মুখ্যমন্ত্রী কী বলেছিলেন ?
সম্প্রতি রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, বাংলার কোথাও সরকারি জমি দখল করা যাবে না ৷ জানুয়ারি মাসে নবান্নে আয়োজিত প্রশাসন বৈঠকে তিনি আরও জানিয়ে দিয়েছিলেন, কোথাও সরকারি জমি জবরদখলের ঘটনা ঘটলে তিনি সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপার এবং থানার আইসির বিরুদ্ধে ‘স্ট্রং অ্যাকশন’ নেবেন ৷ এক্ষেত্রে জেলাশাসকদেরও ঘরে বসে না-থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি ৷ জানিয়েছিলেন, জেলাশাসকরা যদি মনে করেন তাঁরা ঘরে বসে থাকবেন, সেটা হবে না ৷ তাঁদের সরকারি জমি জবরদখল যেভাবে হোক রুখতে হবে ৷
স্থানীয়দের আশঙ্কা
স্থানীয়দের একাংশ বলছেন, সরকারি জমি বা বিল ভরাটের সূত্রপাত এভাবেই হয় ৷ প্রথমে সেই জায়গা টিন বা অন্য কিছু দিয়ে ঘেরা হয় ৷ ভিতরে জমি সমান করার কাজ চলতে থাকে ৷ জলা হলে ট্র্যাক্টর ভর্তি আবর্জনা ফেলা শুরু হয় ৷ জমি একবার সমান হয়ে গেলে হঠাৎ একদিন রাতারাতি সেখানে গজিয়ে ওঠে কোনও মন্দির কিংবা ক্লাব ৷ তারপরেই সেই জায়গা প্লট করে বিক্রি করা শুরু হয় ৷ এক্ষেত্রেও সেটা হবে কি না সময় বলবে ৷