জলপাইগুড়ি, 19 মে: পহেলগাঁওয়ে জঙ্গিদের হত্যালীলা এবং অপারেশন সিঁদুর নিয়ে সারা বিশ্বকে বিস্তারিত তথ্য দিতে চায় ভারত সরকার ৷ সেই কারণে সাতটি সংসদীয় দল তৈরি করা হয়েছে সরকারের তরফে ৷ সেই সাতটি দলের একটিতে রয়েছেন বহরমপুরের সাংসদ তৃণমূলের ইউসুফ পাঠান ৷ একতরফাভাবে নাম চূড়ান্ত করার বিষয়ে আপত্তি তোলা হয়েছে তৃণমূলের তরফে ৷ এই নিয়ে সোমবার তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিশানা করেন বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী ৷
এদিন জলপাইগুড়ির বানারহাটে হাজির হয়েছিলেন নন্দীগ্রামের বিজেপি বিধায়ক ৷ অপারেশন সিঁদুরের সাফল্য উদযাপনে তিরঙ্গা যাত্রার আয়োজন করা হয়েছিল বানারহাটে ৷ সেই কর্মসূচিতে যোগ দেন শুভেন্দু ৷ তার পর মঞ্চ থেকে সংসদীয় দলে ইউসুফ পাঠানের নাম থাকা নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসকে নিশানা করেন তিনি ৷
বিরোধী দলনেতা বলেন, ‘‘ভারতবর্ষ থেকে সবদলের সাংসদরা যাচ্ছেন 31টা দেশে অপারেশন সিঁদুরের কথা বলতে ৷ আমাদের এয়ারফোর্স, আমাদের ডিফেন্স, আমাদের প্যারা-মিলিটারি, তাদের কথা বলতে ৷ পহেলগাঁওয়ে যে মায়েদের-দিদিদের-বোনেদের জঙ্গিরা সিঁদুর মুছিয়ে দিয়েছে, তার দুঃখের কথা বলতে ৷ সব দল প্রতিনিধি দিয়েছে ৷ একটা দল প্রতিনিধি তুলে নিয়েছে ৷ তার নাম কি জানেন ?’’
প্রশ্নের উত্তর অবশ্য শুভেন্দুকে দিতে হয়নি ৷ উপস্থিত জনতাই বলে দেন যে সেই দলের নাম তৃণমূল কংগ্রেস ৷ তার পর পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল ও বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রীকে নিশানা করেন বিধানসভার বিরোধী দলনেতা ৷ শুভেন্দু প্রথমে প্রশ্ন করেন, ‘‘কেন তুলেছে ?’’ এর পর কিছুক্ষণ থেমে নিজেই উত্তর দেন ৷ বলেন, ‘‘যাতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদেশের মাটিতে কিছু বলতে না হয় ৷ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বললে ভোটব্যাংক নড়ে যাবে ৷ তাই তিনি (মমতা) প্রতিনিধি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন ৷’’
অপরাশেন সিঁদুর
জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে গত 22 এপ্রিল 25 জন পর্যটক ও একজন স্থানীয় বাসিন্দাকে হত্যা করে জঙ্গিরা ৷ সেদিন বেছে বেছে হিন্দু পর্যটকদের হত্যা করা হয় ৷ দিন পনেরো পর পালটা জবাব দেয় ভারত ৷ পাকিস্তান ও পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের ন’টি জঙ্গিঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় ৷ তার মধ্য়ে অন্যতম পাকিস্তানের মধ্যে থাকা জয়েশ-ই-মহম্মদ ও লস্কর-ই-তইবার সদর দফতর ৷
এই হামলার পর পাকিস্তান ভারতে ড্রোন ও মিসাইল হামলার চেষ্টা করে ৷ কিন্তু ভারতের শক্তিশালী এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম সেই হামলা রুখে দেয় ৷ পালটা জবাবে পাকিস্তানের একাধিক সেনাঘাঁটি ও বায়ুসেনা ছাউনিতে আঘাত করে ভারত ৷ এর পর গত 10 মে ভারতের কাছে সংঘর্ষ বিরতির আবেদন জানায় পাকিস্তান ৷ সেই মতো সেদিন থেকে ভারত আর পাকিস্তানে হামলা করেনি ৷ পাকিস্তানও সেভাবে ড্রোন বা মিসাইল হামলার পথে যায়নি ৷
অপরাশেন সিঁদুরের সাফল্যের প্রচার
ভারতীয় সেনার এই সাফল্য এবার বিভিন্ন দেশে প্রচারের পরিকল্পনা করেছে ভারত সরকার ৷ এই জন্য বিভিন্ন দলের সাংসদদের নিয়ে সাতটি দল তৈরি করা হয়েছে ৷ সেই দলগুলির নেতৃত্বে থাকবেন একজন করে সাংসদ ৷ নেতৃত্বে বিজেপি ও তার শরিক জেডিইউ, শিবসেনা থেকে যেমন সাংসদ আছেন, তেমনই বিরোধী কংগ্রেসের শশী থারুর, ডিএমকে-র কানিমোঝিদেরও নেতৃত্বে রাখা হয়েছে ৷

যে সাতটি দল তৈরি করা হয়েছে, তার মধ্যে একটির যাওয়ার কথা ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, সিঙ্গাপুর ও মালেশিয়ায় ৷ সেই দলের নেতৃত্বে থাকবেন নীতীশ কুমারের দলের (জেডিইউ) সাংসদ সঞ্জয় কুমার ঝা ৷ তিনি ছাড়াও আরও আটজন যাবেন ওই দলে ৷ সেই আটজনের মধ্য়ে একজন তৃণমূলের ইউসুফ পাঠান ৷
বহরমপুরের সাংসদের নাম প্রত্যাহার!
সাতটি দলের সদস্যদের নাম কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করতেই বিতর্ক তৈরি হয় ৷ অভিযোগ ওঠে যে বিরোধী দলগুলির সঙ্গে আলোচনা না করেই সাংসদদের নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে ৷ সোমবার সেই অভিযোগই শোনা যায় তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায় ৷
এদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "তৃণমূলের কেউ যাচ্ছেন না, ব্যাপারটা এমন নয় ৷ প্রতিনিধি দলে যোগ দেওয়ার বিষয়টি কেন্দ্রের তরফে সংসদীয় দলকে জানানো হয়েছিল ৷ দলগতভাবে আমাদের কাছে কোনও খবর আসেনি ৷ কিন্তু মনে রাখতে হবে, সংসদীয় দল শুধু সংসদের অধিবেশনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয় ৷ এই ধরনের ক্ষেত্রে দলের প্রতিনিধি কে হবেন, সেটা সরকার ঠিক করতে পারে না ৷ নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে পারে না ৷ আমাদের সঙ্গে কেন্দ্র যোগাযোগ করলে, আমরা অবশ্যই ভাবব ৷ কিন্তু আমরা বয়কট করছি, ব্যাপারটা এমন নয় ৷"

অন্যদিকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "যদি প্রতিনিধি দল যায়, আমাদের তাতে কোনও আপত্তি নেই । যেভাবে পাকিস্তানের দিক থেকে সন্ত্রাসবাদী হামলা হচ্ছে, তা নিয়ে বিশ্বের মঞ্চে বার্তা রাখা দরকার । কিন্তু আমার দল থেকে কে যাবেন, সেই সিদ্ধান্ত পার্টি নেবে । কেন্দ্রীয় সরকার এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, কোন দল থেকে কোন প্রতিনিধি যাবেন ।"
ফলে শুভেন্দু অধিকারী দাবি করলেও আদৌ ইউসুফ পাঠানের নাম তৃণমূল প্রত্যাহার করে নিয়েছে নাকি তাঁর জায়গায় অন্য কাউকে পাঠাতে চায়, সেটা স্পষ্ট হয়নি মমতা বা অভিষেক কারও কথাতেই ৷
বিধানসভা ভোটে উত্তরবঙ্গে শূন্য পাবে তৃণমূল!
এদিন বানারহাটের কর্মসূচি থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়কে নিশানা করেন শুভেন্দু অধিকারী ৷ তাঁর কথায়, তিনি 2021 সালে নন্দীগ্রামে হারিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়কে ৷ সেবার উত্তরবঙ্গেও বেশিরভাগ আসনে বিজেপি জয়ী হয়৷ এবার উত্তরের 54টি আসনেই তৃণমূলকে হারাতে হবে ৷
শুভেন্দু বলেন, ‘‘আমি যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারাতে পারি আপনারাও পারবেন ৷ উত্তরবঙ্গ গতবার থেকেই বলেছে ৷... উত্তরবঙ্গের 54টা আসনেই মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়কে খালি হাতে পাঠাব ৷’’ তিনি মমতাকে উত্তরবঙ্গ বিরোধী বলেও কটাক্ষ করেন ৷
উত্তরবঙ্গে বিজেপির কর্মসূচি
এদিন জলপাইগুড়ির বানারহাটে তিরঙ্গা যাত্রার আয়োজন করে বিজেপি ৷ সেখানে শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে ছিলেন আলিপুরদুয়ারের সাংসদ মনোজ টিগ্গা, জলপাইগুড়ির সাংসদ জয়ন্তকুমার রায়-সহ বিজেপি বিধায়ক ও নেতারা ৷ সেই কর্মসূচির শেষে মঞ্চ থেকে আগামী বৃহস্পতিবার (22 মে) উত্তরবঙ্গে আরও একটি তিরঙ্গা যাত্রার ঘোষণা করেন বিরোধী দলনেতা ৷
শুভেন্দু অধিকারী জানান, আগামী 22 মে শিলিগুড়িতে তিরঙ্গা যাত্রা করবে বিজেপি ৷ পাশাপাশি আগামী জুলাই মাসে বিজেপির তরফে উত্তরকন্যা অভিযানও করা হবে ৷ সেই অভিযান থেকে উত্তরবঙ্গের জন্য তিনটি দাবি তোলা হবে ৷ কী কী দাবি ? সেই নিয়ে বিরোধী দলনেতা জানান, উত্তরবঙ্গের নদী, অরণ্য ও চা বাগান বাঁচানোর দাবি তোলা হবে ওই অভিযান থেকে ৷
সিপিএম থেকে বিজেপিতে যোগ
গত বছর জলপাইগুড়ির ধূপগুড়ি বিধানসভায় উপনির্বাচন হয় ৷ সেই ভোটে তৃণমূলের কাছে হারতে হয় বিজেপিকে ৷ ওই নির্বাচনে ধূপগুড়িতে সিপিএম প্রার্থী করেছিল ঈশ্বরচন্দ্র রায়কে ৷ তিনি এদিন বিজেপিতে যোগদান করেন । বিজেপি যোগ দিয়েই ভাওয়াইগা গান করেন তিনি ৷ সেই গান ‘ভারতমাতার জয়, ভারত সেনা, ভারতের গৌরব জানিবেন নিশ্চয়’ তিনি ভারতমাতা ও সেনাবাহিনীকে উৎস্বর্গ করেন ।

জন বারলার তৃণমূলে যোগদান
2019 সালে জন বারলা বিজেপির টিকিটে জয়ী হয়ে আলিপুরদুয়ারের সাংসদ হন ৷ 2021 সালে তাঁকে কেন্দ্রে মন্ত্রীও করা হয় ৷ 2024 সালের লোকসভা ভোটে তাঁকে প্রার্থী করেনি বিজেপি ৷ সেই থেকেই তিনি না-খুশ ছিলেন ৷ মাসকয়েক আগে আলিপুরদুয়ারে সরকারি মঞ্চে তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা গিয়েছিল ৷ তার পর গত সপ্তাহে তিনি যোগ দেন তৃণমূলে ৷
এদিন সেই প্রসঙ্গেও মুখ খোলেন শুভেন্দু অধিকারী ৷ বিরোধী দলনেতা বলেন, ‘‘আজকে আর আমরা রাজনৈতিক কচকচানিতে যাব না ৷ কোনও ফুটা পার্টি পতাকা ধরলেও বিজেপির কিছু হবে না ৷ গঙ্গাবাবু গিয়েছিলেন মনোজ টিগ্গা জিতেছেন ৷ সুমনবাবু ভিতরে বিজেপি বাইরে তৃণমূল ৷ 38 হাজারের লিড আলিপুরদুয়ারে ৷ এই ফুটা পার্টিদের দ্বারা কিছু হবে না ৷ আমরা মমতাকে তাড়াব ৷’’