কলকাতা, 11 এপ্রিল: বাম জমানা হোক বা পরবর্তী সময়, বলে বলে মাঠ ভরিয়ে সফল ব্রিগেড করেছে বামেরা । বিটিআর থেকে জ্যোতিবাবু, হরেকৃষ্ণ কোঙার, সীতারাম ইয়েচুরি থেকে প্রকাশ কারাত, কিংবা মানিক সরকার থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতো নেতারা থেকেছেন বাম ব্রিগেডের বক্তা তালিকায় । তবে এবার আগামী 20 তারিখ ব্রিগেড সমাবেশে নিয়ে বক্তা তালিকায় বড় চমক বামেদের ।
সরাসরি সিপিএমের ডাকে ব্রিগেড না-হলেও এবারের সমাবেশ তাদেরই গণসংগঠনগুলির ডাকে । একমাত্র গণ আন্দোলনের নেতা মহম্মদ সেলিম ছাড়া এবার সেই আয়োজকদের পাঁচজন নেতাই জীবনে প্রথম ব্রিগেড মঞ্চে বক্তব্য রাখবেন । এবার সিপিএমের গণ সংগঠন সারা ভারত কৃষক সভা, সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়ন, সিআইটিইউ, পশ্চিমবঙ্গ বস্তি উন্নয়ন সমিতি এই চার সংগঠনের ডাকে ব্রিগেড সমাবেশ । তাদেরই নেতৃত্ব নিরাপদ সরদার, বন্যা টুডু, অমল হালদার, অনাদি সাহু ও সুখরঞ্জন দে এবার ব্রিগেড সমাবেশের বক্তা ।

জমি আন্দোলন থেকে শুরু করে কৃষক আন্দোলন, অথবা কলকারখানার শ্রমিকের আন্দোলনকে ভরসা করেই এ রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছিল বামফ্রন্ট । তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নেতাদের মুখে গরিব খেটে খাওয়া মেহনতী মানুষের কথা শোনা গেলেও, নেতা বা দল উভয়েই এই শ্রেণি থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিল । ফলে যেমন 2011 সালে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়েছিল বাম সরকারকে, তেমনই পরবর্তী সময়ে কল-কারখানা অথবা মাঠে ঘাটে কাজ করা, ঘামঝরানো মানুষের মনে জায়গা ধরে রাখতে সক্ষম হয়নি লাল পার্টি। এবার সেই পুরনো উৎসে ফিরতে চাইছে সিপিএম । ফের মাঠে ঘাটে চাষ করা কৃষক, খেতমজুর অথবা কলকারখানার শ্রমিকদের সংকটে, তাঁদের সমস্যায় পাশে থেকে লড়াই করার অঙ্গীকার নিচ্ছে সিপিএম ।
পাশাপাশি শহর ও শহরতলি এলাকার নগরগঞ্জের বস্তির মানুষজনের সমস্যায়ও পাশে থাকতে চাইছে সিপিএম । তাই সাদা ধুতি-পঞ্জাবি পরা এলিট ক্লাসের বক্তা নয়, একেবারে মাঠে চাষ করা কৃষকদের সংকটের কথা তাঁদের প্রতিনিধিদের মুখেই বলাতে চাইছে দল । একইভাবে কল-কারখানার শ্রমিক হোক বা বস্তির মানুষের সংকট তুলে ধরবেন সেই মানুষগুলির সঙ্গে বছরভর নানা আন্দোলনে যুক্ত থাকা নেতৃত্বই ।

পশ্চিমবঙ্গ বস্তি উন্নয়ন সমিতির সাধারণ সম্পাদক সুখরঞ্জন দে জানিয়েছেন, ছাত্রাবস্থা থেকেই তাঁর ব্রিগেড সমাবেশে যাওয়া । বহু বর্ষিয়ান কমিউনিস্ট নেতৃত্বের বক্তব্য তিনি শুনেছেন । তবে এবারে তাঁদের সংগঠনের ডাকা ব্রিগেডে তিনি প্রথম বক্তব্য রাখবেন ৷ ফলে তাঁর কথাতে উঠে আসবে সেই বস্তির মানুষের মাথার উপর ছাদ, তাঁদের স্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবন যাপন করার দাবি, নানা সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চনার প্রতিবাদের কথা । যা তিনি নিজে উপলব্ধি করেছেন ।
একইভাবে বন্যা টুডু যিনি এখনও রীতিমতো মাঠে নেমে আলু চাষ করে থাকেন, তিনি এবারে ব্রিগেড সমাবেশে অন্যতম বক্তা । তাঁর কথায়, "আমাদের যাঁরা দিনমজুর, যাঁরা কৃষক, তাঁদের ফসলের দাম, সারের দাম বৃদ্ধি, কিংবা সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাওয়া, দিনমজুরি বৃদ্ধির দাবির কথা তুলে ধরব । এতদিন বেশ কয়েকটি ব্রিগেডে আমি এলাকায় প্রচার করেছি, মানুষজনকে নিয়ে গিয়েছি ৷ তবে এবার, আমাদের যে সমস্যা সেটা যেমন আমি নিজে তুলে ধরতে পারব, একইভাবে এই সমস্যার সমাধানের পথ ও সেই পথ খোঁজার আন্দোলনের বার্তাও আমি নিজে মুখে দেব আমার সাথীদের ।"

ব্রিগেডের আরেক বক্তা নিরাপদ সরদার বললেন, "আমার কাছে ব্রিগেড মঞ্চে বক্তব্য রাখার বিষয়টি রহস্য রোমাঞ্চের বিষয় নয় । এতদিন যে সমস্যাগুলি ছোট ছোট অংশে গিয়ে জানতে পেরেছি মানুষের মুখে, তাঁদের 100 দিনের কাজের সমস্যা, মজুরির সমস্যা, ভাতা পাওয়ার সমস্যা, মাথার উপর ছাদের সমস্যা, সেই সংকটের কথাই এবার বড় মঞ্চে তুলে ধরতে পারব । বাংলার গ্রাম জীবনের আর্থিক স্বচ্ছলতা না-ফিরলে, সেখানে কাজের জায়গা তৈরি না-হলে, আমাদের নতুন প্রজন্মের উপর তার প্রভাব পড়বে, সেই কথাই আমি ব্রিগেডের মঞ্চে তুলে ধরব ।"
অমল হালদারের কথায়, "হরেকৃষ্ণ কোঙার, বিটিআর, জ্যোতিবাবু এদের বক্তব্য শোনা দিয়ে আমার ব্রিগেডের শুরু অর্থাৎ 70 সালে । তখন থেকে প্রত্যেকটা ব্রিগেডে এই আমি সাক্ষী থেকেছি । এবার যে শ্রেণির সঙ্গে জীবনভর মিশে থেকেছি, তাঁদের অভাব অভিযোগ ও সুরাহার পথ, আন্দোলনের পথ বলে দেওয়ার বড় মঞ্চ পাচ্ছি ।"
অনাদি সাহু ছিলেন একাধিকবারের বিধায়ক ও রাজ্যের শ্রম দফতরের প্রতিমন্ত্রী । বর্তমানে তিনি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক । তাঁর কথায়, "নির্দিষ্টভাবে সংখ্যাটা মনে নেই ৷ ছাত্রাবস্থা থেকে কোনও ব্রিগেডে যায়নি এমনটা হয়নি । কলকারখানার শ্রমিক বন্ধুদের সংকট, বা কর্মরতদের সমস্যা কীভাবে মিটবে, সরকারের ভূমিকা নিয়ে আন্দোলনের পথ কী হবে, তার সবটাই এবার ব্রিগেড মঞ্চে আমার বক্তব্যে উঠে আসবে ।"
একটা সময় বছরের পর বছর ব্রিগেড সমাবেশের বক্তা তালিকা দেখলে বোঝা যেত যে, মাঠে ঘাটে কাজ করা অথবা বন্ধ কলকারখানার খেটে খাওয়া মানুষজনের জমায়েতে বক্তব্য রাখতেন ধবধবে সাদা পঞ্জাবি-ধুতি পরা নেতারা, যাঁদের অনেকেই মাঠে ময়দানে নেমে দেখেননি সংকটটা ঠিক কোথায় ! তাঁদের বক্তব্য শুনেই বাড়ি ফিরতেন গরিবগুর্বোরা । তবে গতবার ছাত্র-যুবদের ডাকে ব্রিগেড সমাবেশের বক্তা অথবা এ বছরে চমক হিসেবে আয়োজক সংগঠনগুলির নেতাদের বক্তা হিসেবে তুলে ধরে সিপিএম অন্য এক বার্তা দিতে চাইছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ।
বিশ্লেষকদের মতে, সিপিএম চাইছে মাঠে-ঘাটে খেটে খাওয়া মানুষের কথা বলুক তাঁদেরই প্রতিনিধিরা ৷ বস্তির সমস্যার কথা বলুক বস্তির লড়াই আন্দোলনে যুক্ত থাকা নেতৃত্বই ৷ তাঁরাই নিজেদের সমস্যা ও তার সমাধানের কথা তুলে ধরুক উপস্থিত মেহনতী মানুষের কাছে ৷ তাঁদের সমস্যা নিয়ে লাগাতার লড়াই আন্দোলনে যুক্ত থাকা নেতাদের বক্তব্য শুনেই আন্দোলনের দিশা খুঁজে নিক ব্রিগেডে আসা শ্রমিক, কৃষক, ক্ষেতমজুর ও বস্তিবাসীরা ।