ETV Bharat / opinion

ট্রাম্প-তত্ত্ব : মার্কিন অর্থনীতি-বিদেশ নীতির আগ্রাসী পরিবর্তন - THE TRUMP DOCTRINE

ট্রাম্প তত্ত্বের মূল কথাই হচ্ছে আরও বেশি ক্ষমতা দখল করা, দেশের রাজনীতিতে আদর্শগত পরিবর্তন আনা এবং অর্থনীতি নির্ভর বিদেশ নীতির প্রণয়ন ৷

Trump Doctrine
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প (ছবি: এপি)
author img

By Vivek Mishra

Published : June 2, 2025 at 2:22 PM IST

7 Min Read

রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফিরে আসা থেকে ট্রাম্প-তত্ত্বের শুরু ৷ এই তত্ত্বের কয়েকটি সুস্পষ্ট দিক আছে ৷ ব্যবসা নির্ভর বিশ্বদর্শনকে মাথায় রেখে এই নীতি তৈরি ৷ এই দৃষ্টিভঙ্গি আমেরিকার নিজস্ব সংস্থাগুলিকে আরও বেশি শক্তিশালী হতে সাহায্য করবে ৷ একইসঙ্গে অন্য দেশের কাছে তাদের ভাবমূর্তিতেও বদল আনবে ৷ কারও মনে হতে পারে এই সংশোধন দরকার ছিল ৷ আবার কারও মনে হতে পারে এতটা বাড়াবাড়ির প্রয়োজন নেই ৷ যে যেভাবেই দেখুক না কেন, ট্রাম্প তত্ত্বের মূল কথাই হচ্ছে আরও বেশি পরিমাণে ক্ষমতা দখল করা, দেশের নিজস্ব রাজনীতিতে আদর্শগত পরিবর্তন আনা এবং অর্থনীতি নির্ভর বিদেশ নীতির প্রণয়ন করা ৷

অভ্যন্তরীণ প্রভাব

আমেরিকার ভিতরে বৈদ্ধিক উৎকর্ষতা থেকে শুরু করে সংবাদমাধ্যম এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর মতো বিষয়ের মধ্যে যেথানে যেখানে বামপন্থার সামান্য ছোঁয়াও আছে তা মুছে দেওয়া দিয়ে ট্রাম্প তত্ত্বের শুরু ৷ এই তালিকায় সংবাদমাধ্য়মও প্রবলভাবে আছে ৷ মতাদর্শের এই প্রবল পরিবর্তন সংঘাতেরও কারণ হয়ে উঠেছে ৷ হার্ভার্ড বা কলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থবরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া, আইনি পদক্ষেপের হুমকি দেওয়া এবং রাজনৈতিকভাবে নিশানা করা এখন প্রতিদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ৷ প্রেসিডেন্টের নিজস্ব ক্ষমতা বা এগজিকিউটিভ পাওয়ারের এমন প্রয়োগ ট্রাম্প ছাড়া আমেরিকার আধুনিক ইতিহাসে আর কোনও প্রেসিডেন্টই করেননি ৷ ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ধীরে ধীরে আলঙ্কারিক হয়ে উঠছে ৷ তার কারণ, বেশিরভাগ সময় ট্রাম্পের তৈরি করা নিয়মকানুন সংবিধানের লক্ষণ রেখাকে অতিক্রম করে যায় ৷ তার ফলে নাগরিক সমাজকে আদালতের দ্বারস্থ হতে হয় ৷ অনেকে ট্রাম্পের এই সময়কালকে নির্দেশের সময়কাল বলে অভিহিত করেন ৷

Trump
ডোনাল্ড ট্রাম্প (ছবি: এপি)

ব্যবসার কৌশল

আন্তর্জাতিক স্তরে ট্রাম্প তত্ত্বের মানে হল ব্যবসা করার কৌশল রপ্ত করা ৷ প্রেসিডেন্ট মনে করেন আদর্শ যদি বাধা হয়ে না দাঁড়ায় তাহলে দুনিয়ার সব থেকে কঠিন সমস্যারও সহজ সমাধান করা সম্ভব ৷ তবে আমাদের মনে রাখতে হবে কোনও একটি বিশেষ রণনীতিকে কাজে লাগিয়ে সামান্য সময়ের জন্য সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হলেও দীর্ঘদিন ধরে সেই সাফল্য ধরে রাখা সম্ভব নয় ৷

বিশ্বের বিভিন্ন সঙ্কটের সমাধান ট্রাম্প যেভাবে করছেন তা এই নীতির বাস্তবায়ন ছাড়া আর অন্য কিছু নয় ৷ ইজরায়েল-গাজার যুদ্ধ চলছে ৷ আমেরিকা যুদ্ধ বন্ধ করার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছে না ৷ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আবার ভয়াবহ জায়গায় চলে গিয়েছে ৷ সেখানে সংঘর্ষ বিরতির আলোচনা হয়েছে ৷ তা বাস্তবায়িতও হয়েছে ৷ কিন্তু তা নিয়ে সংশিষ্ট কোনও পক্ষেরই কোনও উপলব্ধি নেই ৷ ট্রাম্প ইরানেও সাফল্য পাননি ৷ তেহেরান ওয়াশিংটনের প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছে ৷ কারণ, আমেরিকা চায় তেহেরান ইউরেনিয়ামজাত সম্পদ বৃদ্ধি করবে না ৷ তারা এই প্রস্তাব মানতে নারাজ ৷ ব্যবসা না করার হুমকি দিয়ে বা আর্থিক সহয়তার লোভ দেখিয়ে কোনও দেশকে কোনও একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে রাজি করানোর ধারনা ক্রমশ বদলে যাচ্ছে ৷ তার বদলে কৌশলের সাহায্য় কারও মতামতকে প্রভাবিত করার প্রবণতা বাড়ছে ৷ কূটনৈতিক সাফল্যের জন্য দরকার আস্থা, প্রেক্ষাপট এবং দূরদৃষ্টি ৷ এর কোনওটাই শুধু আলোচনার টেবিল থেকে পাওয়া সম্ভব নয় ৷

চিন: সংঘাত না সমঝোতা

দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর ট্রাম্পের চিন-নীতি অনেকটাই বদলে গিয়েছে ৷ প্রথমবার ক্ষমতায় থাকার সময় ট্রাম্পের বিদেশ নীতির অনেকটা অংশ জুড়েছিল চিন ৷ বেজিংকে নিজেদের প্রাথমিক প্রতিযোগী হিসেব ধরে নিয়েই রণনীতি তৈরি করতেন ট্রাম্প ৷ শুধু রণনীতি তৈরি কেন চিনের সঙ্গে বাণিজ্য-যুদ্ধই শুরু করে দিয়েছিলেন ট্রাম্প ৷ মনে করা হয়েছিল, দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হয়ে ট্রাম্প চিনের আর্থিক বৃদ্ধিকে টক্কর দেওয়ার চেষ্টা করবেন ৷ ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকায় ট্রাম্প এমন পদক্ষেপ করবেন সেটা মনে করেছিলেন অনেকেই ৷ কিন্তু এখন মনে হয়, ট্রাম্প চিনের সঙ্গে বিচিত্র ধরনের দরদাম করতে চান ৷ তার হালহকিকত এমন যাতে কিছু সুবিধের পাশাপাশি অসুবিধেও থাকবে হাত ধরাধরি করে ৷ তাতে আর্থিক লাভ হবে আবার কৌশলগত সহাবস্থানও করা যাবে ৷ চিনের সঙ্গে বাণিজ্য আমেরিকাকে আর্থিক দিক থেকে সমৃদ্ধ করবে তাতে সন্দেহ নেই ৷ কিন্তু তা করতে গিয়ে নিজের দেশের সীমান্তে প্রবল ভূ-রাজনৈতিক চাপের মুখে তাদের পড়তে হবে ৷

chinese port
চিনের একটি বন্দর দিয়ে চলছে পণ্য পরিবহণ (ছবি: এপি)

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে কৌশলগত ভালো অবস্থান, তাইওয়ানে চিনের আগ্রাসনকে ক্রমশ প্রতিহত করার পাশাপাশি ন্যাটোর অংশ নয় এমন বন্ধুদেশগুলির পাশে থাকার বার্তা দিয়েছে আমেরিকা ৷ এসবই এক বিরাট বড় এবং সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয় ৷ তার বদলে অল্প সময়ের জন্য আর্থিক সমৃদ্ধির কথা ভাবার অর্থ দীর্ঘদিনের সুরক্ষার সঙ্গে আপস করা ৷

ভারতের দ্বিধা

ট্রাম্প তত্ত্বের জেরে ভারতের সঙ্গে আমেরিকার কৌশলী সম্পর্ক অতীতের থেকে খারাপ হয়েছে। তার কারণ ট্রাম্প প্রশাসনের নীতিই হল উৎপাদন বাড়িয়ে অন্য দেশের উপর নির্ভরতা কমানো। আর তার ফলে ভারতের মতো আমেরিকার বিশ্বস্ত বন্ধুও সমস্যায় পড়ছে। সাম্প্রতিক কালে ভারতের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্য বিষয়ক আলোচনা ঘিরে উদ্বেগের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। ট্রাম্প বাণিজ্য সংক্রান্ত আলোচনাকে অংশীদারিত্ব হিসেবে না দেখে যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে দেখতে পছন্দ করেন।

Trump
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদি (ছবি: এপি)

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষ বিরোধী সমঝোতা করিয়েছেন বলে দাবি করেছেন ট্রাম্প। সেখানেও বাণিজ্যের প্রশ্ন এসেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন, বাণিজ্য বন্ধ করে দেবেন এই শর্ত দেখিয়েই নাকি দুই দেশকে রাজি করিয়েছেন। এ ধরনের মন্তব্য কূটনৈতিক শিষ্টাচারের পরিপন্থী। একইসঙ্গে তিনি যে পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পারেননি সে কথাও স্পষ্ট হয়েছে। ভারত প্রকাশ্যে ট্রাম্পের দাবি খারিজ করেছে। কূটনৈতিক ব্যাপারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাড়াবাড়ি করেন, সেটাও ঠারেঠরে বুঝিয়ে দিয়েছে দিল্লি।

Kochi Water Metro
কোচির ওয়াটার মেট্রোয় উঠেছেন যাত্রীরা (ছবি: এপি)

মাত্র কয়েকদিন আগে অ্য়াপেলের সিইও টিম কুককে ট্রাম্প ভারতে আইফোনের উৎপাদন বন্ধ করতে বলেছেন ৷ 25 শতাংশ শুল্প আরোপের হুমকি দিয়ে কোনও সংস্থাকে এমন কোনও কাজ করতে বলা ট্রাম্পের আর্থিক তত্ত্বের মধ্যে থাকা সংঘাতের দিকটাই তুলে ধরে ৷ উৎপাদনে গতি আনার জন্য এমন পদক্ষেপ নেওয়া মানে উৎপাদনকারী সংস্থাকে আগ্রাসী পদক্ষেপ নিতে বাধ্য় করা ৷ ব্রিটেন এবং ইউোরিপায়ন ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের সমঝোতা চুক্তি সংক্রান্ত আলোচনা ট্রাম্পের পদক্ষেপগুলির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হওয়ার লক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে ৷ ওয়াশিংটনকে জোর করলে দিল্লিকে বিকল্পের সন্ধান করতে হবে ৷ অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করতে হবে ৷

Trump Doctrine
ম্যারিল্যান্ডের একটি সেনাঘাঁটিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প (ছবি: এপি)

বিপদ-সংকেত

ট্রাম্প-তত্ত্ব মানে এক দোলাচল ৷ অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক পরিসরের মধ্যে কোনটা বেছে নেওয়া হবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েই দোলাচলের সৃষ্টি ৷ তত্ত্ব আদর্শগতভাবে দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য তৈরি ৷ তবে এর আর্থিক চাহিদা আবাব বিশ্বের অন্য দেশের উপরে নির্ভর করে ৷ আর সবথেকে বড় কথা এই তত্ত্বের কোনও নিশ্চয়তা নেই ৷ ভারতের মতো দেশ আমেরিকার শর্ত মেনে নেবে এমনটা ভাবার কোনও দরকার নেই ৷ তার বদলে তারা ওয়াশিংটনের খামখেয়ালি আচরণ বন্ধ করতে অন্য কোনও নীতিকে আপন করে নেবে ৷ ট্রাম্প যদি নিজের কর্মপদ্ধতিতে পরিবর্তন না আনেন তাহলে ভারতের মতো সহযোগী দেশের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খারাপ হবে ৷ পাশাপাশি অন্য দেশও শক্তিশালী হওয়ার রাস্তায় এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ খুঁজবে ৷ ট্রাম্পের নয়া নীতি আমেরিকার এতদিনের বিদেশ নীতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ৷ এই আমলে যে কোনও নীতি প্রণয়নের মূল কথাই হল ক্ষমতা এবং আরও বেশি পরিমাণে ক্ষমতা দখল করা ৷ দেশে নিজের শক্তি বৃদ্ধি করা এবং বিশ্ব দরবারে ব্যবসার পরিসর আরও বাড়ানো ৷ ট্রাম্পের নীতি তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবসা বাড়াতে সক্ষম ৷ পাশাপাশি এমন সমস্তও চুক্তি হওয়া সম্ভব যা সহজেই সংবাদ-শিরোনামে জায়গা করে নিতে পারে ৷ কিন্তু আগামিদিনের জন্য বিপদের সংকেতও বয়ে আনবে ৷ সহযোগী দেশগুলির মধ্যে বিশ্বাস এবং সমন্বয়ের অভাব ঘটবে ৷ তাছাড়া বিভিন্ন ইস্যুর ক্ষেত্রে বিশ্বকে নেতৃ্ত্ব দেওয়ার প্রশ্নে আমেরিকার এতদিন ধরে পালন করে আসা ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে ৷ এমন নানাবিধ প্রশ্ন নিয়ে ট্রাম্প-তত্ত্ব যত মাথা তুলে দাঁড়াবে ততই ভারতের মতো দেশ অন্য কৌশল নেওয়ার কথা ভাববে ৷ আর এমনটা করা যে তাদের কাছে স্বেচ্ছায় নেওয়া কোনও বিকল্প নয় তা নয় ৷ নয়া নীতির আশ্রয় নেওয়া তাদের কাছে সময়র দাবি, অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নও বটে ৷

রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফিরে আসা থেকে ট্রাম্প-তত্ত্বের শুরু ৷ এই তত্ত্বের কয়েকটি সুস্পষ্ট দিক আছে ৷ ব্যবসা নির্ভর বিশ্বদর্শনকে মাথায় রেখে এই নীতি তৈরি ৷ এই দৃষ্টিভঙ্গি আমেরিকার নিজস্ব সংস্থাগুলিকে আরও বেশি শক্তিশালী হতে সাহায্য করবে ৷ একইসঙ্গে অন্য দেশের কাছে তাদের ভাবমূর্তিতেও বদল আনবে ৷ কারও মনে হতে পারে এই সংশোধন দরকার ছিল ৷ আবার কারও মনে হতে পারে এতটা বাড়াবাড়ির প্রয়োজন নেই ৷ যে যেভাবেই দেখুক না কেন, ট্রাম্প তত্ত্বের মূল কথাই হচ্ছে আরও বেশি পরিমাণে ক্ষমতা দখল করা, দেশের নিজস্ব রাজনীতিতে আদর্শগত পরিবর্তন আনা এবং অর্থনীতি নির্ভর বিদেশ নীতির প্রণয়ন করা ৷

অভ্যন্তরীণ প্রভাব

আমেরিকার ভিতরে বৈদ্ধিক উৎকর্ষতা থেকে শুরু করে সংবাদমাধ্যম এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর মতো বিষয়ের মধ্যে যেথানে যেখানে বামপন্থার সামান্য ছোঁয়াও আছে তা মুছে দেওয়া দিয়ে ট্রাম্প তত্ত্বের শুরু ৷ এই তালিকায় সংবাদমাধ্য়মও প্রবলভাবে আছে ৷ মতাদর্শের এই প্রবল পরিবর্তন সংঘাতেরও কারণ হয়ে উঠেছে ৷ হার্ভার্ড বা কলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থবরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া, আইনি পদক্ষেপের হুমকি দেওয়া এবং রাজনৈতিকভাবে নিশানা করা এখন প্রতিদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ৷ প্রেসিডেন্টের নিজস্ব ক্ষমতা বা এগজিকিউটিভ পাওয়ারের এমন প্রয়োগ ট্রাম্প ছাড়া আমেরিকার আধুনিক ইতিহাসে আর কোনও প্রেসিডেন্টই করেননি ৷ ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ধীরে ধীরে আলঙ্কারিক হয়ে উঠছে ৷ তার কারণ, বেশিরভাগ সময় ট্রাম্পের তৈরি করা নিয়মকানুন সংবিধানের লক্ষণ রেখাকে অতিক্রম করে যায় ৷ তার ফলে নাগরিক সমাজকে আদালতের দ্বারস্থ হতে হয় ৷ অনেকে ট্রাম্পের এই সময়কালকে নির্দেশের সময়কাল বলে অভিহিত করেন ৷

Trump
ডোনাল্ড ট্রাম্প (ছবি: এপি)

ব্যবসার কৌশল

আন্তর্জাতিক স্তরে ট্রাম্প তত্ত্বের মানে হল ব্যবসা করার কৌশল রপ্ত করা ৷ প্রেসিডেন্ট মনে করেন আদর্শ যদি বাধা হয়ে না দাঁড়ায় তাহলে দুনিয়ার সব থেকে কঠিন সমস্যারও সহজ সমাধান করা সম্ভব ৷ তবে আমাদের মনে রাখতে হবে কোনও একটি বিশেষ রণনীতিকে কাজে লাগিয়ে সামান্য সময়ের জন্য সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হলেও দীর্ঘদিন ধরে সেই সাফল্য ধরে রাখা সম্ভব নয় ৷

বিশ্বের বিভিন্ন সঙ্কটের সমাধান ট্রাম্প যেভাবে করছেন তা এই নীতির বাস্তবায়ন ছাড়া আর অন্য কিছু নয় ৷ ইজরায়েল-গাজার যুদ্ধ চলছে ৷ আমেরিকা যুদ্ধ বন্ধ করার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছে না ৷ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আবার ভয়াবহ জায়গায় চলে গিয়েছে ৷ সেখানে সংঘর্ষ বিরতির আলোচনা হয়েছে ৷ তা বাস্তবায়িতও হয়েছে ৷ কিন্তু তা নিয়ে সংশিষ্ট কোনও পক্ষেরই কোনও উপলব্ধি নেই ৷ ট্রাম্প ইরানেও সাফল্য পাননি ৷ তেহেরান ওয়াশিংটনের প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছে ৷ কারণ, আমেরিকা চায় তেহেরান ইউরেনিয়ামজাত সম্পদ বৃদ্ধি করবে না ৷ তারা এই প্রস্তাব মানতে নারাজ ৷ ব্যবসা না করার হুমকি দিয়ে বা আর্থিক সহয়তার লোভ দেখিয়ে কোনও দেশকে কোনও একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে রাজি করানোর ধারনা ক্রমশ বদলে যাচ্ছে ৷ তার বদলে কৌশলের সাহায্য় কারও মতামতকে প্রভাবিত করার প্রবণতা বাড়ছে ৷ কূটনৈতিক সাফল্যের জন্য দরকার আস্থা, প্রেক্ষাপট এবং দূরদৃষ্টি ৷ এর কোনওটাই শুধু আলোচনার টেবিল থেকে পাওয়া সম্ভব নয় ৷

চিন: সংঘাত না সমঝোতা

দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর ট্রাম্পের চিন-নীতি অনেকটাই বদলে গিয়েছে ৷ প্রথমবার ক্ষমতায় থাকার সময় ট্রাম্পের বিদেশ নীতির অনেকটা অংশ জুড়েছিল চিন ৷ বেজিংকে নিজেদের প্রাথমিক প্রতিযোগী হিসেব ধরে নিয়েই রণনীতি তৈরি করতেন ট্রাম্প ৷ শুধু রণনীতি তৈরি কেন চিনের সঙ্গে বাণিজ্য-যুদ্ধই শুরু করে দিয়েছিলেন ট্রাম্প ৷ মনে করা হয়েছিল, দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হয়ে ট্রাম্প চিনের আর্থিক বৃদ্ধিকে টক্কর দেওয়ার চেষ্টা করবেন ৷ ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকায় ট্রাম্প এমন পদক্ষেপ করবেন সেটা মনে করেছিলেন অনেকেই ৷ কিন্তু এখন মনে হয়, ট্রাম্প চিনের সঙ্গে বিচিত্র ধরনের দরদাম করতে চান ৷ তার হালহকিকত এমন যাতে কিছু সুবিধের পাশাপাশি অসুবিধেও থাকবে হাত ধরাধরি করে ৷ তাতে আর্থিক লাভ হবে আবার কৌশলগত সহাবস্থানও করা যাবে ৷ চিনের সঙ্গে বাণিজ্য আমেরিকাকে আর্থিক দিক থেকে সমৃদ্ধ করবে তাতে সন্দেহ নেই ৷ কিন্তু তা করতে গিয়ে নিজের দেশের সীমান্তে প্রবল ভূ-রাজনৈতিক চাপের মুখে তাদের পড়তে হবে ৷

chinese port
চিনের একটি বন্দর দিয়ে চলছে পণ্য পরিবহণ (ছবি: এপি)

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে কৌশলগত ভালো অবস্থান, তাইওয়ানে চিনের আগ্রাসনকে ক্রমশ প্রতিহত করার পাশাপাশি ন্যাটোর অংশ নয় এমন বন্ধুদেশগুলির পাশে থাকার বার্তা দিয়েছে আমেরিকা ৷ এসবই এক বিরাট বড় এবং সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয় ৷ তার বদলে অল্প সময়ের জন্য আর্থিক সমৃদ্ধির কথা ভাবার অর্থ দীর্ঘদিনের সুরক্ষার সঙ্গে আপস করা ৷

ভারতের দ্বিধা

ট্রাম্প তত্ত্বের জেরে ভারতের সঙ্গে আমেরিকার কৌশলী সম্পর্ক অতীতের থেকে খারাপ হয়েছে। তার কারণ ট্রাম্প প্রশাসনের নীতিই হল উৎপাদন বাড়িয়ে অন্য দেশের উপর নির্ভরতা কমানো। আর তার ফলে ভারতের মতো আমেরিকার বিশ্বস্ত বন্ধুও সমস্যায় পড়ছে। সাম্প্রতিক কালে ভারতের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্য বিষয়ক আলোচনা ঘিরে উদ্বেগের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। ট্রাম্প বাণিজ্য সংক্রান্ত আলোচনাকে অংশীদারিত্ব হিসেবে না দেখে যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে দেখতে পছন্দ করেন।

Trump
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদি (ছবি: এপি)

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষ বিরোধী সমঝোতা করিয়েছেন বলে দাবি করেছেন ট্রাম্প। সেখানেও বাণিজ্যের প্রশ্ন এসেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন, বাণিজ্য বন্ধ করে দেবেন এই শর্ত দেখিয়েই নাকি দুই দেশকে রাজি করিয়েছেন। এ ধরনের মন্তব্য কূটনৈতিক শিষ্টাচারের পরিপন্থী। একইসঙ্গে তিনি যে পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পারেননি সে কথাও স্পষ্ট হয়েছে। ভারত প্রকাশ্যে ট্রাম্পের দাবি খারিজ করেছে। কূটনৈতিক ব্যাপারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাড়াবাড়ি করেন, সেটাও ঠারেঠরে বুঝিয়ে দিয়েছে দিল্লি।

Kochi Water Metro
কোচির ওয়াটার মেট্রোয় উঠেছেন যাত্রীরা (ছবি: এপি)

মাত্র কয়েকদিন আগে অ্য়াপেলের সিইও টিম কুককে ট্রাম্প ভারতে আইফোনের উৎপাদন বন্ধ করতে বলেছেন ৷ 25 শতাংশ শুল্প আরোপের হুমকি দিয়ে কোনও সংস্থাকে এমন কোনও কাজ করতে বলা ট্রাম্পের আর্থিক তত্ত্বের মধ্যে থাকা সংঘাতের দিকটাই তুলে ধরে ৷ উৎপাদনে গতি আনার জন্য এমন পদক্ষেপ নেওয়া মানে উৎপাদনকারী সংস্থাকে আগ্রাসী পদক্ষেপ নিতে বাধ্য় করা ৷ ব্রিটেন এবং ইউোরিপায়ন ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের সমঝোতা চুক্তি সংক্রান্ত আলোচনা ট্রাম্পের পদক্ষেপগুলির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হওয়ার লক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে ৷ ওয়াশিংটনকে জোর করলে দিল্লিকে বিকল্পের সন্ধান করতে হবে ৷ অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করতে হবে ৷

Trump Doctrine
ম্যারিল্যান্ডের একটি সেনাঘাঁটিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প (ছবি: এপি)

বিপদ-সংকেত

ট্রাম্প-তত্ত্ব মানে এক দোলাচল ৷ অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক পরিসরের মধ্যে কোনটা বেছে নেওয়া হবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েই দোলাচলের সৃষ্টি ৷ তত্ত্ব আদর্শগতভাবে দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য তৈরি ৷ তবে এর আর্থিক চাহিদা আবাব বিশ্বের অন্য দেশের উপরে নির্ভর করে ৷ আর সবথেকে বড় কথা এই তত্ত্বের কোনও নিশ্চয়তা নেই ৷ ভারতের মতো দেশ আমেরিকার শর্ত মেনে নেবে এমনটা ভাবার কোনও দরকার নেই ৷ তার বদলে তারা ওয়াশিংটনের খামখেয়ালি আচরণ বন্ধ করতে অন্য কোনও নীতিকে আপন করে নেবে ৷ ট্রাম্প যদি নিজের কর্মপদ্ধতিতে পরিবর্তন না আনেন তাহলে ভারতের মতো সহযোগী দেশের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খারাপ হবে ৷ পাশাপাশি অন্য দেশও শক্তিশালী হওয়ার রাস্তায় এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ খুঁজবে ৷ ট্রাম্পের নয়া নীতি আমেরিকার এতদিনের বিদেশ নীতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ৷ এই আমলে যে কোনও নীতি প্রণয়নের মূল কথাই হল ক্ষমতা এবং আরও বেশি পরিমাণে ক্ষমতা দখল করা ৷ দেশে নিজের শক্তি বৃদ্ধি করা এবং বিশ্ব দরবারে ব্যবসার পরিসর আরও বাড়ানো ৷ ট্রাম্পের নীতি তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবসা বাড়াতে সক্ষম ৷ পাশাপাশি এমন সমস্তও চুক্তি হওয়া সম্ভব যা সহজেই সংবাদ-শিরোনামে জায়গা করে নিতে পারে ৷ কিন্তু আগামিদিনের জন্য বিপদের সংকেতও বয়ে আনবে ৷ সহযোগী দেশগুলির মধ্যে বিশ্বাস এবং সমন্বয়ের অভাব ঘটবে ৷ তাছাড়া বিভিন্ন ইস্যুর ক্ষেত্রে বিশ্বকে নেতৃ্ত্ব দেওয়ার প্রশ্নে আমেরিকার এতদিন ধরে পালন করে আসা ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে ৷ এমন নানাবিধ প্রশ্ন নিয়ে ট্রাম্প-তত্ত্ব যত মাথা তুলে দাঁড়াবে ততই ভারতের মতো দেশ অন্য কৌশল নেওয়ার কথা ভাববে ৷ আর এমনটা করা যে তাদের কাছে স্বেচ্ছায় নেওয়া কোনও বিকল্প নয় তা নয় ৷ নয়া নীতির আশ্রয় নেওয়া তাদের কাছে সময়র দাবি, অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নও বটে ৷

ETV Bharat Logo

Copyright © 2025 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.